আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছোটদের রম্য নাটিকা--‌‌‌অকার্যকর গণতন্ত্রঃ পশুদের বিচার



যখন কমরেটদের হাতে লেখা পোষ্টার, আঁঠা আর হারিকেন নিয়ে অন্ধকারে আলোর খুঁজে বের হতাম, বিশ্ব বেহায়া এরশাদের ভূয়া গণতন্ত্রের পাছায় লাথ্থি মারতাম আর শ্লোগান দিতাম, ‌‌‌‌‌‌‌‌‌‌কেউ খাবে কি কেউ খাবে না, তা হবে না তা হবে না, ভোটের বাক্সে লাথি মার সমাজতন্ত্র কায়েম কর। তখন আমার বিদ্যার জোর ৬ষ্ঠ কি ৭ম শ্রেণী হবে। কিন্তু গান, কবিতা, নাটক আর বই নিয়ে শ্রেণী সংগ্রামের আন্দোলনে ছিলাম বয়সের তুলনায় খানিকটা এগিয়ে। সেই সময়ের রাজনীতিবিদদের নিয়ে রচনা করেছিলাম হাসির নাটক ‘পশুদের বিচার’। নাটকের আবেদন মনে হয়, বর্তমানে আরো বাড়ছে।

এখনো অপরাধ ধরা পড়ে না, পড়লেও বিচার হয় না। পড়ুন, ভাবুন--এ দেশের বিচার ব্যবস্থা ছোটদের ধারাবাহিক রম্য নাটিকা ‌'অকার্যকর গণতন্ত্রঃ পশুদের বিচার' এর মত কিনা। পশুদের বিচার -শাশ্বত স্বপন স্টপ্, স্টপ্, স্টপ্ সবাই কর চুপ, আমি হচ্ছি হাতি সবার দেহের চাইতে বড় তাইতো বিচার পতি। সবার বিচার করব আমি হোক না কেহ আমার নাতি। বটবৃক্ষ হার মেনে বলে সে নাকি আমার ছাতি ।

তাহলে নির্বোধ পশুগণ, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ আমি কত বড় হাতি! প্রথমে আমি গরুকে বলছি, গরু, তোমার কি অভিরুচি? গরু বলে, হুজুর, আপনি নিজেই জানেন আমি কত উপকারী, করি নাকো কারো ধারধারী । অথচ বাঘ কেন আমাকে খায়! আমি যে বড় অসহায়! বাঘ বলে, হুজুর, আমি খেতে চাই হরিণ বান্দর বড় মলিন আগে থেকেই বলে দেয়, বাঘ আসছে হরিণ ভাই, বাঘ আসছে হরিণ ভাই। হরিণ বলে, হুজুরগো-- এই বাঘকে আমার সবচেয়ে বড় ভয়, ওর জ্বালা নাহি সয় । ছাগল, ভেড়া, ঘোরা বলে, হুজুর-- ও শুধু আমাদের সবাইকে খায়। হাতি বলে, না, না, না- এটাতো, মোটেই ভাল নয়, কিহে, পেটুক বাঘ, মাথা নিচু করে আছ কেন, ভাই? বুকে ঠ্যাং দিয়ে বল- এতগুলো কথার মধ্যে একটুও মিথ্যা নাই।

বাঘ বলে, জেঁ হুজুর-- ওরা যা বলেছে তাই । হাতি বলে, কেন? কেন? কেন? তুমি ওদের খাও কেন? বাঘ বলে, নইলে আমার বাঁচার উপায় যে নাই। হাতি বলে, তাই? নিজের খাবার নিজে খাবে অন্যদেরকে কেন কাঁদাবে! তুমি পানি খাবে, ঘাস খাবে ট্যাংরা খাবে, ইঁচা খাবে, বিছা খাবে তারপর ঘুম যাবে। হঠাৎ করে চিৎকার করে বলে পাতিহাঁস, পড়ল আমার গলায় ফাঁস। পানিতে যদি যায় বাঘ মামা আমরা থাকব কই, মাছতো আমার সই কেমন বিচার করলেন আপনি আমরা যাই কই? হঠাৎ করে শৃগাল বলে, হুক্কা হুয়া হুয়া হুজুর, নালিশ করব গুজুর গুজুর।

কুকুর আমার জন্ম শক্র ওর বিচার আমি চাই, যখন তখন দেখলে আমায় করে শুধু খাই খাই। রাজার বাড়ী করব চুরি মুরগী আর হাঁস কুকুর মিয়া ঘেউ ঘেউ করে কইরা দেয় সব ফাঁস। মুরগী বলে, হাতি দাদা-- শিয়াল আমাকে খাওয়ার জন্য চোরের মত করে ভান, সামনে পাইলে ঠ্যাং ধরে ফস্ কইরা দেয় টান। এই শিয়ালের জন্য পারি না যাইতে বাড়ীর বাইরে পাটক্ষেতে, শিয়াল সিকদার বড় পাজী শয়তানের মত থাকে ওত্ পেতে। হাঁস বলে, হাতি দাদা-- আপনি হলেন গিয়া জ্ঞান দাতা।

এই বাঘডাসা আর শিয়াল মিয়ার বড়ই খারাপ চোখ আর মুখ পানি থেকে ডাঙ্গায় উঠে বিশ্রাম করব সেখানেও ওদের জন্য নাই সুখ। ঘোড়া বলে, জাঁহাপনা বানর নাকি ফলগাছের বয়ে এনেছে দুখ, সে নাকি ফলবৃক্ষ কূলের ক্ষতি করছে যুগ যুগ। সেনাপতি বানর বলে, শান্তির পূজারী জাঁহাপনা-- আমি বলছি কি, শিয়াল আর বাঘডাসার নাই কোন সাজ, কবর থেকে খায় শুধু মরা, পঁচা লাশ। আমার বাণী না শুনেন যদি ওদের গন্ধে আপনার হইব খুব বড় রকমের সর্দি। তাই আজকের মত ছাড়েন আপনি শ্রদ্ধেয় বিচারের গদি।

(প্রচন্ড হৈ চৈ । বিচার চাই- বিচার চাই-বিচার চাই-- সেনাপতির বিচার চাই) স্টপ্, স্টপ্, স্টপ্ সবাই কর চুপ্ । (প্রস্থান) (পরের দিন) স্টপ্, স্টপ্, স্টপ্ সবাই কর চুপ আমি হচ্ছি হাতি সবার দেহের চাইতে বড় তাইতো বিচার পতি। সবার বিচার করব আমি হোক না কেহ আমার নাতি। বটবৃক্ষ হার মেনে বলে সে নাকি আমার ছাতি তাহলে নির্বোধ পশুগণ, নিশ্চয় বুঝতে পেরেছ আমি কত বড় হাতি।

প্রথমে আমি সেনাপতিকে বলছি, সেনাপতি, তোমার কি আরজি? সেনাপতি বলে, পর্বতসম জাঁহাপনা আপনি জানেন, ছোট বড় সবাই আমার কাছে একেবারে সমান, তাই এমন কাজ করি আমি যাতে বিচার পায় সবাই সমপরিমাণ। তাই, আপনার অনুমতি পেলে শুরু করতে পারি বিচার। হাতি বলে, হ্যাঁ, হ্যাঁ পেশ কর তোমার মনের আচার-অনাচার । সেনাপতি বলে, ইঁদুর ভাই-- তোমার কথা পেশ কর ভাই। ইঁদুর বলে, মহাগুরু-- আপনি জানেন, আমি অতি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মনুষ্য জীবের উচ্ছিষ্ট খাবার গ্রহণ করা বড়ই দুরুহ।

তাই মনুষ্য জীবের খাবার মাঝে মাঝে করি চুরি, তবে তেমন কিছু নয় শুধু খই, চিড়া আর মুড়ি। কিন্তু— এই বিড়াল গোয়ার বড় হিংসুটে পাজী, আমাকে সে দেখলে হয়ে যায় কাজী। টেঁনে ছিঁড়ে নাড়ি-ভূড়ি করে সে বাড়াবাড়ি। আমাদের ছানারা কেঁদে মরে কান্নায়, বিড়াল গোয়ার ওদেরও মারে আমরা যে বড় অসহায়! হাতি বলে, কি! এত বড় অন্যায়! বাঘের মত চেহারা তোমার তুমি মার কিনা ইঁদুর। তোমার কপালে শুকনো সুপারী রেখে খরম দিয়ে দিয়ে পিটাতে হয়, এত বড় অন্যায়।

সেনাপতি বলে, আদেশ করুন হুজুর, করব না কাজের ফাঁকি-ফুজির ওর লেজের মধ্যে আগুন লাগিয়ে ইতিহাসে রাখব নজির। বিড়াল বলে, ওগো জ্ঞানদাতা-- তার আগে একটা কথা শুনতে হয় যথাতথা ঐ কুত্তা মিয়া দেখলে আমায় কুরকুর করে করমড়ায় মোর ছাওগুলিকে দাঁত ঢুকিয়ে নিচ্ছে যে কবর খোলায়। শিয়াল বলে, হুজুর, হুজুর কুকুর মিয়ার বিচার করুন না কাঠ গড়ায় তাহলে সবাই শান্তি পায়। ইঁদুর বলে, জেঁ না হুজুর কুকুর মামা বড় ভাল গৃহস্তের মঙ্গল হয়, শিয়াল কিন্তু ভাল নয়। সেনাপতি বলে, শূকর মিয়া আইছে হুজুর হঠাৎ করে এই কি ভুজুর গন্ধ যে গুজুর গুজুর, শূকর, তুমি হও দূর।

শূকর বলে, না, আমি হব না দূর কেউ তাড়াতে আসলে গন্ধ ছাড়িব ভূর ভূর। দেখাব বিচার আজ হয় কি সুমধুর! হাতি, ঘোড়া, ময়ূর বলে, একটু দূরে যাও-- সেনাপতি বানর বলে, তুমি ‘গু’ কেন খাও? শূকর বলে, শ্রদ্ধেয় পশুপতি-- আমি পশুদের সবচেয়ে বেশী ভালবাসি, তাই আমি খাই আপনাদের মলমূত্রবাসী। এই দেখুন, আপনাদের ভালবেসে মলমূত্র সারা গায়ে মেখেছি, পেটের ক্ষুধার দুঃখ, সব ভুলেছি। আপনাদের খাওয়া খাদ্য পেট থেকে বের হলে গন্ধ কেন হয় বের, না জানি, আপনাদের পেটের মাঝে হাজার নরকের ফের। তাই বলি, সবার আগে করুন বিচার আপনাদের পেট আর এই গন্ধের।

সেনাপতি বলে, এত বড় সাহস! এতদিন দেখনি তোমার কবর সিপাহী, হত্যা কর শূকর! সিপাহী বলে, হুজুর, গন্ধ যে ভূর ভূর! সেনাপতি বলে, লেজ দিয়ে নাক ঢাক বিমূঢ়। ঘোড়া বলে, সেনাপতির বিচার কি হল হুজুর? সেনাপতি বলে, চুপ কর! আরে কর একটু সবুর। আজকে দেখলে না হুজুরকে কেমনে অপমান করল শূকর, হুজুর, আজকের মত বিচার হোক না হয় উদর? (হৈ চৈ বিচার চাই...) স্টপ্, স্টপ্, স্টপ্ সবাই কর চুপ্! (প্রস্থান) (পরের দিন-দরবারে হৈ চৈ, হাতির প্রবেশ) স্টপ্, স্টপ্, স্টপ্ সবাই কর চুপ্। সেনাপতি আজ কোথায়? ময়ূর বলে, আজ ছোট হুজুরের প্রথম বধূর বিদায়। জাঁহাপনা, মনুষ্যকূল বড়ই পাজী ওরা আপনার বিরুদ্ধে করেছে নির্মম আর্জি।

কলাগাছ কর্তনে আপনি ঘুরেন বনে বনে। ওদের কথা হল ওরা হবে আপনার কাজী । দেখুন জাঁহাপনা ওরা কত বড় পাজী! হাতি বলে, বলে কি? সেনাপতি নেই, ওরা বিচার করবে? না, না, না...বলে দেও বিচার হবে আরো পরে। (প্রস্থান) (পরের দিন, সেনাপতি বানর হাতির সিংহাসনে বসে, হাতির মত অভিনয় করছে) স্টপ্, স্টপ্, স্টপ্ সবাই কর চুপ্ আমি হচ্ছি বানর নামটা বড় সুন্দর। আকারে আমি ছোট হলেও বুদ্ধিতে আমার বড় কদর।

তাইতো সেনাপতির আসন করেছি আমি জয়, মনুষ্য জাতির সাথে যুদ্ধ করে পশু জাতির আনিব বিজয়। উপস্থিত পশুগণ, কথা বলেন কম, বড় সুসময় আজকের এ লগণ জানেন পশুগণ? আজ হুজুরের মেয়ের বিয়ে তাই তিনি হাঁটে গিয়ে আনবেন কিনে কলা আর মূলো লক্ষ টাকা দিয়ে, তাই আজকের মত বিচার হোক না ইয়ে। (আদরের সুরে) কি বলেন, ঘোড়া ও ময়ূর ভাইয়ে ঘোড়া ও ময়ূর বলে, হ্যাঁ, ইয়ে ইয়ে...? (বনে ভিতরে) হাতি বলে, কলা আর মূলো যদি হয়ে যায় শেষ মনুষ্য জাতি আর খরগোশ-ছাগলের থাকবে না বিশেষ। তার চেয়ে সিংহ তুমি কয়েকটা মস্ত বড় ষাড় নিয়ে বন থেকে আজ দুর্বল গরু মেরে ষাড়ের ঘাড়ে দেবে চড়িয়ে অতঃপর তুমি সামনে যাবে এগিয়ে ষাড়েরা সব মরা নিয়ে যাবে বন পেরিয়ে । গোস্তসব তৈরী হলে ষাড়ের পিঠে বেঁধে সারি সারি, তুমি চলে যাবে আমার মেয়ের শ্বশুরবাড়ী।

সিংহ বলে, আজ্ঞে হুজুর-- তাইতো মাংসের সাথে আজ আমার আড়ি । আমি মাংস নিয়ে চলে যাব আপনার শ্বশুর বাড়ী। ক্ষমা করুন হুজুর-- আপনার মেয়ের শ্বশুর বাড়ী। ষাড় বলে, আমাদের জ্ঞাতি ভাইদের মাংস আমরা বহন করব। হুজুর, ওদের বাচ্চারা কাঁদবে, হাতি বলে, চুপ, একেবারে চুপ! আমার হুকুমে বাঘ তোমাদের মারবে।

আমার কথা না শুনলে বনে থাকার মজাটা বুঝাব তোমাদের বেতন কেটে রাখব। মনুষ্য জাত করেছে নিষেধ আমার ছোট মেয়ের বিয়ে বরপক্ষ গরুর মাংস করব ইয়ে সিংহ, সবাইকে যাও নিয়ে। ষাড়েরা বলে, সবার বিচার আছে হুজুর আপনাদের বিচার নাই, চলেন সিংহ ভাই, আপনাদের কথা না শুনলে তো আমাদেরও বাঁচার উপায় নাই। রচনাকালঃ ১৯৮৫-৮৬

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।