আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবহেলিত ও নীরব অধ্যায়- "রেপ ক্যাম্প'৭১ এর নির্যাতিত নারীরা"

আমার "কত অজানা রে" সিরিজের সব গুলো পোষ্ট সংগ্রহে থাকা বই, গুগোল মামা ও বিভিন্ন সাইট থেকে অনুবাদ করা, তবে কোন ভাবেই কপি-পেষ্ট নয়। জানার জন্য পড়ন, ভুল হলে সঠিকটি বলার দায়িত্ব আপনাদের। আনন্দের সাথে পড়ুন। আমার ব্লগ কেচাল মুক্ত।

আজ সকালে রেডিও এফএম শুনছিলাম যেখানে সবাই এসএমএস করে শুভেচ্ছা শেয়ার করছিলো।

আরজে বারবার বলছিল "প্লিজ আপনারা এডুক্যাটেড, আমাদের নিঊ জেনারেশন, একটু নজর রাখবেন, আজ বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস না"। পথে যেতে যেতে চিন্তা করলাম এর জন্য আসলে দায়ী কারা? যেই হোক না কেন, দায় আমাদের সবার। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একটা কালো অধ্যায় হলো পাকিস্তান আর্মিদের "রেপ ক্যাম্প"। ফরেন আর্টিকেলগুলো বলে যে আনুমালিক ২ লক্ষ থেকে ৪ লক্ষ নারী যুদ্ধের ৯ মাসে নির্যাতিত হয়েছিলো যাদের বয়স হবে ১৩ থেকে ৫৫। যদিও বাস্তবতা বলে সে সময় ৯ বছরের বাচ্চাদেরও যেমন নির্যাতন করা হতো তেমনি ৬৫ বছরের বৃদ্ধরাও রেহাই পেতো না।

সে সময় একজন আস্ট্রেলিয়ান ডাক্তার আসেছিলেন নির্যাতিত নারীদের শরীর থেকে নির্যাতনের চিহ্ন মুছে দিতে। তিনি Dr. Geoffrey Davis। (বাঙালী হিসাবে আমাদের দুর্ভাগ্য বলেন আর লজ্জা বলেন এই যে, আমরা আমাদের বন্ধুদের সম্মান দিতে পারিনা। Dr. Geoffrey Davis ২০০৮ সালে মৃত্যুবরন করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের "রেপ ক্রাইম"এর তিনি একজন প্রত্যক্ষদর্শী) ২০০২ সালে দেওয়া তার একটি ইন্টারভিউতে তিনি বলেন, “It is difficult to put a figure in it. About 100 a day in Dhaka and in variable numbers in lot of other towns. And some would go to Calcutta…(for abortions)”।

ইন্টারভিউটি নেন Dr. Bina D’Costa। দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমরা মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের কাহিনী শুনতে আগ্রহী, কিন্তু নির্যাতিত নারীদের হাহাকার এরিয়ে গেছি বারবার। আর আমাদের জাতীয় লজ্জা হলো এই যে, যেখানে মুক্তিযোদ্ধারা "জাতীয় বীর" হিসাবে পরিবার, সমাজ ও জাতির কাছে সম্মানিত সেখানে এই সব নির্যাতিত নারীরা ছিলো তার পরিবারের জন্য লজ্জার, ফলাফলে তাদের বেছে নিতে হয়েছে আত্মহত্যার পথ, কিংবা পরিবার থেকে হয়েছে পরিত্যাক্ত, হয়েছে সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন। ইন্টারভিউ এ Dr. Geoffrey Davis আরও বলেন,“And the men didn’t want to talk about it at all! Because according to them the women had been defiled. If they had been defiled they had no status at all. They might as well be dead. And men killed them. I couldn’t believe it!” (আমার মতে, Dr. Geoffrey Davis এই মন্তব্যটি আমাদের সঙ্কীর্ণ মানসিকতার স্বাক্ষর হয়ে থাকবে, জাতি হিসাবে আমরা চিরদিনের জন্য তাঁর কাছে ছোট হয়ে গেছি) "রেপ ক্যাম্প" গুলোতে অনেক গর্ভবতী মেয়েদেরও ধরে আনা হতো যারা ক্যাম্পগুলোতে বাচ্চাদের জন্ম দিয়েছিলো। এই বাচ্চাদের নিয়তিতে কি ছিলো তার প্রমান পাওয়া যায় John Hastings (যিনি ১৯৭১ সালে একজন মেথডিস্ট মিশনারি হিসাবে বাংলাদেশে কর্মরত ছিলেন) এর মন্তব্য তে।

তিনি বলেন, “I am certain that troops have thrown babies into the air and caught them on their bayonets”। পাকিস্তানী আর্মিদের বর্বরতা শুধুমাত্র গণধর্ষণেই থেকে থাকতো না। ধর্ষণের পর এই সব মেয়েদের নিষ্ঠুর উপায়ে মেয়ে ফেলা হতো। John Hastings বলেন যে,“I am certain that troops have raped girls 'repeatedly', then killed them by pushing their bayonets up between their legs.” যারা মরে যেতো তারা বেঁচে যেতো তাদের অবস্থা ছিলো ভয়াবহ। একাত্তরের ভয়াবহ ধর্ষণ সম্পর্কে একমাত্র জবানবন্দিদানকারী সাহসিক ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী তার সাক্ষাৎকারে (একাত্তরের দুঃসহ স্মৃতি, সম্পাদনা শাহরিয়ার কবির) জানান, “রাতে ফিদাইর (উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানি সেনা কর্মকর্তা) চিঠি নিয়ে ক্যাপ্টেন সুলতান, লে. কোরবান আর বেঙ্গল ট্রেডার্সও অবাঙালি মালিক ইউসুফ এরা আমাকে যশোরে নিয়ে যেত।

যাওয়ার পথে গাড়ির ভেতরে তারা আমাকে ধর্ষণ করেছে। নির্মম, নৃশংস নির্যাতনের পর এক পর্যায়ে আমার বোধশক্তি লোপ পায়। ২৮ ঘন্টা সঙ্গাহীন ছিলাম”। সুসান ব্রাউনি মিলার তার গ্রন্থের ৮৩ পাতায় উল্লেখ করেছেন, কোনো কোনো মেয়েকে পাকসেনারা এক রাতে ৮০ বারও ধর্ষণ করেছে। ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির “যুদ্ধ ও নারী” গ্রন্থ থেকে জানা যায়, এক একটি গণধর্ষণে ৮/১০ থেকে শুরু করে ১০০ জন পাকসেনাও অংশ নিয়েছে।

আর কথাসাহিত্যিক শওকত ওসমানের একটি উপন্যাস আছে নাম ‘নেকড়ে অরণ্য’। পাকিস্তানি ক্যাম্পে কীভাবে নির্যাতন করেছে শুয়োরের বাচ্চারা, আর সেই নির্যাতনের প্রকট দৃশ্য দেখে কী স্বাভাবিক আত্মতৃপ্তিতে মজেছিলো এ দেশীয় রাজাকাররা- তার চাবুক বর্ণনা পাওয়া যায় এই উপন্যাসে। পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্যাতনের ধরণ সকল সভ্যতা বিবর্জিত মানুষের আচরণের চেয়েও নিকৃষ্ট ছিলো। তাদের কোনো কোনো আচরণ ছিলো ভয়ঙ্কর বিকারগ্রস্থ। এই বিকারগ্রস্থতা এতোটাই বেশিমাত্রায় ছিলো যে- মনোবিজ্ঞানের ভাষায় এদের সাইকোপ্যাথ শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত করা যায়।

অসংখ্য পাকিস্তানি সৈন্য ও অফিসার একের পর এক অসহায় নারীকে সবার সামনে বিবস্ত্র করে নিষ্ঠুর যৌন নির্যাতনে রক্তাক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি; তারা এইসব নারীর পায়ুপথ ছিন্নভিন্ন করে তাদের সকল বর্জ্য ও যৌনাঙ্গ নারীদের মুখে ঢুকিয়ে দিয়েছে। অল্প বয়সী নারীরা যখন বিভৎস যন্ত্রণায় কাতরিয়েছে, তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা বেয়নেটের খোঁচায় ছিন্নভিন্ন করে দিয়েছে তাদের যোনীপথ। পাকিস্তানি সৈন্যদের ধর্ষণের বীভৎসতার ধরন সম্পর্কে পুনর্বাসন সংস্থায় ধর্ষিতাদের নিবন্ধীকরণ ও দেখাশোনার সঙ্গে যুক্ত সমাজকর্মী মালেকা খান জানান, সংস্থায় আসা ধর্ষিত নারীদের প্রায় সবারই ছিল ক্ষত-বিক্ষত যৌনাঙ্গ। বেয়োনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে ছিড়ে ফেলা রক্তাক্ত যোনিপথ, দাঁত দিয়ে ছিড়ে ফেলা স্তন, বেয়োনেট দিয়ে কেটে ফেলা স্তন-উরু এবং পশ্চাৎদেশে ছুরির আঘাত নিয়ে নারীরা পুনর্বাসন কেন্দ্রে আসতো। পাকিস্তানি সৈন্যরা আমাদের নারীদের একাত্তরে কতো বীভৎসভাবে ধর্ষণসহ যৌন নির্যাতন করেছে তার ভয়াবহতা সবচেয়ে বেশী ধরা পড়ে ১৮ ফেব্র“য়ারীর ৭৪ সালে গৃহীত রাজারবাগ পুলিশ লাইনে একাত্তরে সুইপার হিসেবে কাজ করা রাবেয়া খাতুনের বর্ণনা থেকে।

প্রামান্যকরন প্রকল্পের অষ্টম খন্ডে গ্রন্থিত ঐ বর্ণনায় কয়েকটি অংশ: রাবেয়া খাতুন জানান, ‘উন্মত্ত পান্জাবি সেনারা নিরীহ বাঙালী মেয়েদের শুধুমাত্র ধর্ষণ করেই ছেড়ে দেয় নাই অনেক পশু ছোট ছোট বালিকাদের ওপর পাশবিক অত্যাচার করে ওদের অসার রক্তাক্ত দেহ বাইরে এনে দুজনে দুপা দুদিকে টেনে ধরে চড়াচড়িয়ে ছিড়ে ফেলে ছিল। পদস্থ সামরিক অফিসাররা সেই সকল মেয়েদের ওপর সম্মিলিত ধর্ষণ করতে করতে হঠাৎ একদিন তাকে ধরে ছুরি দিয়ে তার স্তন কেটে, পাছার মাংস কেটে, যোনি ও গুহ্যদ্বারের মধ্যে সম্পূর্ণ ছুরি চালিয়ে দিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে ওরা আদন্দ উপভোগ করতো । ’ রাবেয়া খাতুনের আরেকটি বর্ণনায় জানা যায়, ‘ প্রতিদিন রাজারবাগ পুলিশলাইনের ব্যারাক থেকে এবং হেডকোয়ার্টার অফিসে ওপর তলা থেকে বহু ধর্ষিত মেয়ের ক্ষত-বিক্ষত বিকৃত লাশ ওরা পায়ে রশি বেধে নিয়ে যায় এবং সেই জায়গায় রাজধানী থেকে ধরে আনা নতুন মেয়েদের চুলের সঙ্গে বেধে ধর্ষণ আরম্ভ করে দেয়। ’ ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জনের পরও পাকিস্তানি সৈন্যরা বাঙ্কারে আটকে রেখে নির্বিচারে ধর্ষণ করেছে বাঙালী নারীদের। বিচারপতি কে এম সোবহান প্রত্যক্ষ দর্শনের অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, ‘ ১৮ ডিসেম্বর মিরপুরে নিখোঁজ হয়ে যাওয়া একজনকে খুঁজতে গিয়ে দেখি মাটির নিচে বাঙ্কার থেকে ২৩জুন সম্পূর্ণ উলঙ্গ, মাথা কামানো নারীকে ট্রাকে করে নিয়ে যাচ্ছে পাক আর্মিরা।

’ পরবর্তীতে আচরণগত বিচ্যুতির ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত দিতে গিয়ে জেনারেল নিয়াজি নিজেদের নির্দোষ জাহির করে বলে- "..…..The psychopath is one whose conduct is satisfactory to himself and to no one else." (G.D.Partridge)। তাদের এই বিকৃত মানসিকতার পিছনে তাদের মতে একটা ধর্মীয় যুক্তি ছিলো,''Gen Tikka in turn briefed his Army Senior Commanders and picked up a staff who would understand why a Muslim Massacre by a Muslim Army, Hindu slaughter, why all intellectuals were to be killed in cold blood, why all young Bengali Muslim girls were to be raped, not to satisfy lust but as a religious duty to produce a new generation of blue-blooded true Muslims.” (muktadhara.net) আর কিছু লিখবো না। ইতিহাস তুলে ধরতে হয় না, ঘেটে বের করতে হয়। তার আগে থাকতে হয় দেশের প্রতি ভালবাসা আর দেশের পতাকা ও অতীতের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তা জানার আগ্রহ। অতীত কখনো মুছে ফেলা যায় না।

অতীত সবাই ভুলে যায় না। তবে আমরা বাঙালী, আমাদের দিয়ে সব সম্ভব। আমাদের বলা হয় "গোল্ডফিস ম্যামরি" জাতি। কেন বলা হয় তা পাকিস্তানের খেলা থাকলে স্টেডিয়ামের দিকে তাকালেই বুঝা যায়। ধন্যবাদান্তে, ডাঃ আব্দুল্লাহ বিন সাঈদ (নাঈম) [বিভিন্ন বই, ফরেন আর্টিকেল ও ব্লগবন্ধুদের কাছে থেকে ধার করে] ১৬-১২-২০১



এর পর.....

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.