বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্ত্রী, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়ামের সিনিয়র সদস্য ও দুর্দিনের কাণ্ডারি সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীন আর নেই।
গতকাল সকাল ১০টা ২০ মিনিটে তিনি রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ... রাজিউন)। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর। তার মৃত্যুতে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। তার মৃত্যুতে গাজীপুরের কাপাসিয়ায় তিন দিনের শোক পালনের কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে।এদিকে জোহরা তাজউদ্দীনের মৃত্যুর খবর শুনে দুপুর সাড়ে ১২টায় ইউনাইটেড হাসপাতালে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ছোট বোন শেখ রেহানাও ছিলেন। এ সময় শেখ হাসিনা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী পেঁৗছানোর পর হাসপাতালে আবেগঘন পরিবেশ তৈরি হয়।
প্রধানমন্ত্রী পরিবারের সদস্যদের সমবেদনা জানিয়ে স্মৃতিচারণ করেন। তিনি বলেন, তার মৃত্যুতে কেবল দলের নয় পুরো দেশের অপূরণীয় ক্ষতি হলো। আর আমি একজন আপনজনকে হারালাম। তার রাজনৈতিক দৃঢ়তার কারণেই পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছিল।
গতকাল বাদ আসর গুলশানের আজাদ মসজিদে মরহুমের প্রথম জনাজা অনুষ্ঠিত হয়।
দ্বিতীয় জানাজা শেষে লাশ ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে রাখা হয়েছে। পরিবারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ছেলে তানজিম আহমদ সোহেল তাজ যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করছেন। তিনি দেশে ফিরলে আগামীকাল রবিবার বনানী কবরস্থানে তাজউদ্দীন আহমদের কবরেই শায়িত হবেন তিনি। আজাদ মসজিদে প্রথম জানাজা শেষে জোহরা তাজউদ্দীনের কফিন বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে নিয়ে আসা হয় ৫টা ১১ মিনিটে। এরপর আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদ সদস্য ভূমিমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, শিল্পমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদসহ নেতারা তার কফিনে জাতীয় পতাকা মুড়িয়ে দেন।
জাতীয় পতাকায় জড়ানো কফিনে প্রথমে প্রধানমন্ত্রী এবং পরে দলীয় প্রধান হিসেবে ফুল দেন শেখ হাসিনা। এ সময় আমির হোসেন আমু, তোফায়েল আহমেদ, স্থানীয় সরকারমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, এইচ টি ইমাম, ড. আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, কর্নেল (অব.) ফারুক খান, এ কে এম রহমত উল্লাহ, আহমদ হোসেন, বি এম মোজাম্মেল, হাবিবুর রহমান সিরাজ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এ কে এম এনামুল হক শামীম, এস এম কামাল, অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, ফজলে নূর তাপস, হাজী মোহাম্মদ সেলিমসহ নেতা-কর্মীরা উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী চলে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগ ও বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতা-কর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষ এই জ্যেষ্ঠ নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। এরপর আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে জোহরা তাজউদ্দীনের দ্বিতীয় জানাজা হয়। পরে লাশ নিয়ে যাওয়া হয় ইউনাইটেড হাসপাতালের হিমঘরে।
জোহরা তাজউদ্দীনের স্মৃতিচারণ করে আওয়ামী লীগের প্রবীণ নেতা আমির হোসেন আমু বলেন, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জোহরা তাজউদ্দীন দলের হাল ধরেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য তিনি কাজ শুরু করেন। তোফায়েল আহমেদ বলেন, বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের কাণ্ডারি ছিলেন জোহরা আপা। তিনি দেশ ও দলকে মনেপ্রাণে ভালোবাসতেন। তার স্বপ্নই ছিল অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ।
তার মৃত্যুতে দেশ ও দলে অপূরণীয় এক শূন্যতার সৃষ্টি হলো। ইউনাইটেড হাসপাতালে মায়ের স্মৃতিচারণ করে সংসদ সদস্য সিমিন হোসেন রিমি বলেন, আমার মা স্বচ্ছ ও সুস্থধারার রাজনীতির পূজারি ছিলেন। তিনি বলেন, আমার মা সবাইকে ভালো রাখতে ও দেখতে চেয়েছেন। দীর্ঘ দিন শয্যাশায়ী থেকেও তিনি দেশের জনগণকে ভালো রাখার সংগ্রাম করেছেন। পঁচাত্তর-পরবর্তী কঠিন সময়ে আওয়ামী লীগের হাল ধরে দলকে সংগঠিত করেছেন।
এ জন্য দেশ ও জাতি তাকে সারা জীবন স্মরণ করবে।
কাপাসিয়ায় তিন দিনের শোক : আমাদের গাজীপুর ও কাপাসিয়া প্রতিনিধি জানান, তার মৃত্যুর সংবাদে কাপাসিয়ায় শোকের ছায়া নেমে পড়ে। আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তিন দিনের শোক ঘোষণা করা হয়েছে। দলীয় পতাকা অর্ধনমিত রাখা, কালো পতাকা উত্তোলন, আজ শনিবার সব ইউনিয়নে শোকসভা ও দোয়া মাহফিল করা হবে। রবিবার কাপাসিয়া পাইলট উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এবং গ্রামের বাড়ি দরদরিয়ায় জানাজা অনুষ্ঠিত হবে।
বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবন : বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী, স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নেতা ছিলেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। তার পাশে থেকে অকৃত্রিম প্রেরণা জুগিয়েছিলেন সহধর্মিণী জোহরা তাজউদ্দীন। ১৯৩২ সালের ২৪ ডিসেম্বর সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের জন্ম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞানে পড়াশোনা করেন। ১৯৫৯ সালে তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে বিয়ে হয়।
ষাটের দশকের আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন তিনি। '৬৮ সালে গঠিত 'রাজবন্দী সাহায্য কমিটি'র যুগ্ম-আহ্বায়ক ছিলেন জোহরা। '৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর যখন আওয়ামী লীগের চরম দুর্দিন চলছিল তখন (১৯৭৭) তাজউদ্দীনপত্নী আওয়ামী লীগের আহ্বায়ক হিসেবে হাল ধরে দলকে সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন।
রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতার শোক : সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ তার শোকবাণীতে বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর তিনি রাজনৈতিক কর্মী ও সংগঠক হিসেবে যে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন, জাতি তা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করবে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার শোকবাণীতে বলেন, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে দেশ এক নিবেদিতপ্রাণ ও দেশপ্রেমিক রাজনীতিবিদকে হারাল।
তিনি বলেন, তার মৃত্যু জাতি এবং আওয়ামী লীগের জন্য এক অপূরণীয় ক্ষতি। বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া তার শোকবাণীতে বলেন, দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য তিনি যে অবদান রেখে গেছেন তা জাতি কোনো দিন ভুলবে না। এ ছাড়াও শোকপ্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরী, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন, যোগাযোগমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, ডাক ও টেলিযোগাযোগমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, আওয়ামী লীগ নেতা মোহাম্মদ নাসিম, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান, গণতন্ত্রী পার্টির নুরুর রহমান সেলিম, গণআজাদী লীগের হাজী আবদুস সামাদ, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, ন্যাপের ইসমাইল হোসেন, কমিউনিস্ট কেন্দ্রের ডা. ওয়াজেদুল ইসলাম খান। আরও শোকপ্রকাশ করেছে যুবলীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ, কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোটসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।