বাংলাদেশের সামাজিক অবস্থানে একজন নারীর নারী হয়ে ওঠা খুব সহজ। কিন্তু মানুষ হয়ে ওঠা কি খুব সহজ? না। এখানে নারীর নারী হয়ে ওঠা কি তার একটা ব্যাখ্যা প্রয়োজন। একটি শিশু যখন জন্ম নেয় তখন সে প্রকৃতিগতভাবে কিছু শারীরিক পার্থক্য নিয়ে জন্মায়। কিন্তু মানসিকভাবে দুটি শিশু একই থাকে।
তার বেড়ে ওঠার মধ্যে দিয়ে সে হয়ে ওঠে একজন নারী অথবা একজন পুরুষ। যেমনঃ একজন শিশু জন্ম নেয়ার পর ইসলাম ধর্মে আযান দেয়ার একটা প্রথা আছে। প্রথাটি হলোঃ ছেলে হলে উঁচু স্বরে এমনভাবে আযানটি দিতে হবে যেন সে আযান সকলে শুনতে পায়, আর মেয়ে হলে সে আযান হবে কানে কানে, যেন শুধু সেই মেয়েটি শুনতে পায়। যে শোনে সে কিন্তু তার কোন মানে বুঝতে পারে না। তেমনিভাবে খাওয়া দাওয়া কাপড় চোপড় সব কিছুতেই একটি ছেলে এবং একটি মেয়ের ভিতরে পার্থক্য করা হয়।
আকিকা হলো শিশুর নাম রাখার একটি অনুষ্ঠান। এই অনুষ্ঠানে একজন ছেলে শিশুর জন্য দুটি ছাগল জবাই করতে হয়, একজন নারী শিশুর জন্য একটি ছাগল জবাই করতে হয়। মেয়ে শিশুটি সাধারণতঃ বাড়ীর মধ্যে বসে রান্নাবাড়া খেলা করে। আর ছেলে শিশুটি বাড়ীর বাইরে যেয়ে খেলাধুলা করে। মেয়ে শিশুকে শেখানো হয় সব সময় ভদ্র নম্র থাকতে।
সে যেন কখনও উঁচু স্বরে কথা না বলে, কারও চোখের দিকে তাকিয়ে কথা না বলে, সব সময় মাটির দিকে তাকিয়ে নম্র স্বরে কথা বলে। ছেলেটিকে শেখানো হয় যে সে হলো বাড়ীর কর্তা। এমন কি সে যদি ৫ বছরের শিশুও হয় তাহলেও সে একজন বয়ষ্ক নারী হোক সে দাদী, নানী, মা চাচি অথবা বড় বোন। সে কথা বলবে কর্তৃত্বের সুরে, হাসবে জোরে জোরে প্রাণ খুলে। যখন যেখানে খুশী যাবে।
সে তার ইচ্ছা মত চলতে পারবে। এরকম অনেক সামাজিক ও ধর্মীয় প্রথা আছে যা দিয়ে একটি মেয়ে এবং একটি ছেলেকে সামাজিকিকরণ করা হয়।
কিন্তু একটি মেয়ে এবং একটি ছেলে উভয়েই মানুষ। একটি পরিবারে ছেলে এবং মেয়ে উভয়কেই সমান চোখে দেখা উচিত। কোন কোন পরিবারে তা দেখাও হয়।
আবার অনেক পরিবারে তা দেখা হয়না। অবশ্য সময় এখন বদলেছে। নারীকে মানুষ হিসাবে দেখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তাকে লেখাপড়া শেখানো হচ্ছে। তাকে বিয়ে দেয়ার পরিবর্তে তার ক্যারিয়ার গড়ে তোলার কথা ভাবা হচ্ছে।
এবং আজ দেখা যাবে নারী বিভিন্ন পেশায় নিজেকে নিয়োজিত করেছে এবং সেখানে সে পুরুষের পাশাপাশি কৃতিত্বের সাথে কাজ করে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও অনেক পরিবার আছে, সমাজের কিছু নিয়ম আছে যা নারীকে মানুষের মর্যাদায় নিচ্ছেনা। তবে আমার এই লেখার বিষয়বস্তু নারীর উপরে কি কি নির্যাতন হয় তা নিয়ে কিন্তু নয়। আমি এমন একজন নারীর কথা লিখতে চাই যিনি রত্নগর্ভা । কিন্তু তিনি জন্ম নেয়ার মাত্র ১বছরের মাথায় মার কাছ থেকে আলাদা হয়ে যান।
অর্থাত্ পিতা মাতার সেপারেশন হয়ে যায়। সমাজের সেই সময়কার প্রথা অনুসারে সেই ১ বছরের বাচ্চাকে তার পিতার কাছে থাকতে হ'তো। ধরা যাক মেয়েটির নাম জোহরা। জোহরার মায়ের আগে একবার বিয়ে হয়েছিল। সেখানে সে দীর্ঘদিন সংসার করেছিল।
কিন্তু কোন বাচ্চা হয় নি। সেই পরিবারের অনেক জমিজমা ছিল। তার সেই স্বামী মারা যান। ফলে তাঁকে আবার দ্বিতীয় বিয়ে করতে হয়েছিল। ২য় বিয়ের ঘরে তার এই মেয়ে হয়।
তাই মেয়েটি তার খুব আদরের ছিল। আর জোহরাতো তথনও বুঝতে শেখেনি যে মায়ের আদর কি। ফলে জোহরাকে তার মার কাছ থেকে রেখে দেয়ার ফলে তার মা খুব আঘাত পায়। সে আঘাত সহ্য করতে পারেন নি। ফলে অসুস্থ হয়ে মারা যান।
জোহরা হয়ে পড়ে মাতৃহীন। বাবার ঘরে সত্ মায়ের কাছে মানুষ হতে থাকে।
আমরা জানি সত্ মা সাধারণতঃ ভালো ব্যবহার করেন না। জোহরাও তার সত্ মায়ের কাছ থেকে কখন ও ভালো ব্যবহার পান নি। তার একজন ফুপু ছিলেন।
তিনি কোন সন্তান জন্ম দিতে পারেন নি তার আগেই তার স্বামী মারা যান, তাই দ্বিতীয়বার বিয়ে না করে বাবার বাড়ীতে একটি ঘর তুলে নিয়ে সেখানে থেকে যান। তিনি জোহরাকে মায়ের স্রেহে মানুষ করতে থাকেন।
যে ঘটনাটি লিখছি তা প্রায় ৭৫ বছর আগের ঘটনা। সেই সময়ে জোহরার বাবা ছিলেন একজন আধুনিক মনের মানুষ। তিনি মেয়েকে পিতার আদর দিয়েছেন, মায়ের আদর দিতে পারেন নি ঠিকই কিন্তু জোহরাকে মানুষ করতে চেয়েছেন।
তিনি তাঁকে স্কুলে পাঠিয়েছেন। যদিও সত্ মায়ের তাতে অনেক আপত্তি ছিল। জোহরা স্কুলে যাচ্ছে। লেখাপড়া শিখছে। পাশাপাশি তাকে ঘরের কাজ করতে হয়েছে।
বিশেষ করে ছোট ভাইবোনকে কোলে করে নিয়ে বেড়াতে হয়েছে। সংসারের অন্যান্য কাজও করতে হয়েছে। পড়ালেখার সময় পেয়েছে খুব কম। তারপরেও তার লেখাপড়া এগিয়ে চলে। তিনি ৫ম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পারেন।
তার সময়ে মেয়েদের ৫ থেকে ৭ বছর বয়সে বিয়ে হতো। কিন্তু জোহরার পিতা তাকে সেই বয়সে বিয়ে দেননি।
এখানে একটি ঘটনা বলি। জোহরার নানী তাকে একটি দুগ্ধবতী গাভী দিয়েছিলেন। জোহরা সেই গাভীটি অত্যন্ত যত্ন সহকারে পালন করতে লাগলো।
কিন্তু তার সত্ মা তাকে সেই গাভীর দুধ খেতে দিতো না। দুধের হাঁড়ি ধোয়া পানি খেতে দিতো। তাই জোহরা দুধ খাওয়াই ছেড়ে দিলো। বাচ্চা কোলে করে রাখতে রাখতে তার মাজায় কড়া পড়ে গেলো। যাহোক এমনিভাবে সে মানুষ হয়ে উঠতে লাগলো।
জোহরাদের গ্রামটি ছিল ভারী সুন্দর। গ্রামের পাশ দিয়ে চিত্রা নদী বয়ে গেছে। এই চিত্রা নদী নিয়ে একটি সিনেমা হয়েছে। এবং সিনেমাটি পুরষ্কৃত হয়েছে। গ্রামে প্রচুর বন ছিল।
সেই সব বনে যেমন ফলজ গাছ ছিল তেমনি বনজ গাছও ছিল। লতা পাতায় পেচানো সে সব জঙ্গলে বাঘ, বড় বড় শুকর, বাঘডাসা, শিয়াল ইত্যাদি বাস করতো। নদী ভরা মাছ ছিল। বাংলাদেশের বিখ্যাত বাগদা চিঙড়িও এই নদীতে প্রচুর ছিল। নদীতীরের মানুষের তাই মাছই ছিল প্রধান খাদ্য।
জোহরা ছিল খুব ডানপিটে স্বভাবের। কাজের অবসরে গ্রামের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়াতো। আম গাছ থেকে আম পাড়তো, জাম গাছ থেকে জাম পাড়তো, নারকেল গাছ থেকে নারকেল। বনের পশু পাখীদের সাথে তার বন্ধুত্ব হয়ে যায়। বিশেষ করে তার গাভীটা তার বন্ধু হয়ে যায়।
৫ম শ্রেণী পাশ করার পর জোহরার পিতা আর জোহরাকে স্কুলে পাঠাতে পারেন নি। জোহরার বাড়ী ধরে নেয়া যাক যশোর জেলার শালিখা থানার কোন এক অজ পাঁড়াগায়ে। সেখানে তখনও মেয়েদেরকে স্কুলে পাঠানোর বিষয়টি সেভাবে গুরুত্ব পায়নি। কিন্তু জোহরার পিতা ছিলেন তখনকার আধুনিক মনের একজন মানুষ। তাই তিনি ধর্মীয় শিক্ষার পাশাপাশি বাংলা লেখাপড়া শেখানোর জন্য তাকে স্কুলে পাঠালেন।
কিন্তু ৫ম শ্রেণী পাশ করার পর আর পড়াতে পারলেন না। সত্ মায়ের নিষেধ ও সামাজিক বাধা পার হয়ে তিনি আর এগুতে পারলেন না।
তিনি জোহরার বিয়ে দেন ১৩ বছর বয়সে।
ধরে নেই যার সাথে তার বিয়ে হয় তার নাম জুলমত। বিয়ের সময় তার বয়স ছিলো ৩০ বছর।
তিনি বেকার ছিলেন। তার বাড়ীর অর্থনৈতিক অবস্থা ততটা ভালো না। ১৪ বছর বয়সে জুলমত পিতৃহারা হন। তারপর তাকে তার সংসারের দায়িত্ব বুঝে নিতে হয়। জুলমতের পিতা যে সম্পত্তি রেখে যান তা ধরে রাখতে পারেন না।
কারণ জমির খাজনা বাকি পড়েছিল। তাই সেই জমি নিলামে উঠে যায়। জুলমতরা সে জমি কিনতে পারেন না। ফলে ৭টি ভাইবোনের সংসারে মা ও আরও ৬টি ভাইবোনের ভরণপোষণের দায়িত্ব তাকে কাঁধে তুলে নিতে হয়। জুলমতের বাড়ী ও বৃহত্ যশোর জেলার শালিখা থানার কোন একটি গন্ডগ্রামে।
সংসারের জোয়াল টানতে যেয়ে জুলমতেরও পড়াশোনা খুব বেশী এগোয়নি। সে মাত্র ৪র্থ শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছে।
শুরু হলো জোহরা ও জুলমতের সংসার। অবশ্য বিয়ের পরে জোহরা এক বছর পর্যন্ত তার বাবার বাড়ীতেই ছিলেন। জোহরার একটি স্বপ্ন ছিল।
তার শ্বশুর বাড়ী হবে। বাড়ীটি হবে সুন্দর ছিমছাম। টিনের ঘর হবে, গোয়াল ভরা গরু থাকবে, থাকবে পুকুর ভরা মাছ। কিন্তু হায় একি! এ দেখি ঘরে কোন রকম খড়ের ছাউনি আছে। কিন্তু কোন বেড়া নেই।
ঘরে খাওয়ার কোন চাল নেই। মাঝে মাঝে বাগান থেকে বুনো কচু তুলে নিয়ে এসে সিদ্ধ করে খেতে হয়। বাড়ীর সামনের দিকে একটি গোয়াল ঘর আছে। সেই ঘরের সামনে প্রচুর কাঁটানটে শাক হয়ে থাকে। সেই শাক তুলে নিয়ে এসে সিদ্ধ করে খাওয়া হয়।
সেই শাকে একটু মরিচ অথবা লবণও দেয়া সম্ভব হয় না। এমনই একটা বাড়ীতে তার বিয়ে হলো। এবং সংসার শুরু করতে হ'লো। জোহরা সবই হাসিমুখে মেনে নিলো। কারণ তার স্বামী তাকে খুব ভালো বাসে।
স্বামীর ভালোবাসা তাকে এই সমুদ্র থেকে তীরে ওঠার সাহস যোগালো। দেখতে দেখতে পাঁচ বছর কেটে গেল। কিন্তু জোহরার কোন ছেলে মেয়ে হয় না। সবাই তাকে বাজা বলতে শুরু করলো। অনেক সময় কোন জায়গায় যাত্রার মুখে জোহরা পড়ে গেলো।
সাথে সাথে যাত্রাকারীর মন খারাপ হয়ে গেলো। একজন বাজা মহিলার মুখ দেখে বের হতে হলো। একজন মহিলাই শুধু বাজা হয়। আজ পর্যন্ত কোন পুরুষকে বাজা হতে শোনা যায় নি যদিও তাদেরও বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা থাকে না। জোহরার খুব খারাপ লাগে।
কি করবে! বাচ্চা হওয়ার বিষয়টিতো সম্পুর্ণটা তার উপরে নির্ভর করে না। প্রতিবেশীরা জোহরার স্বামীকে আবার বিয়ে করতে বলে। কিন্তু জোহরার স্বামী কখনও দ্বিতীয় বিয়েতে মত দেয়নি। তিনি বলতেন, "আমি তাকে বিয়ে করেছি সে তো আমাকে বিয়ে করেনি। ফলে আমি আর বিয়ে করবো না।
" মাতৃহারা জোহরাকে তার স্বামী কখনও অনাদর বা অসন্মান করেন নি।
বিয়ের কিছুদিন পর জোহরার স্বামী চাকরী পায়। তার পোস্টিং হয় মেহেরপুরে। তিনি মেহেরপুরে যেয়ে কিছুটা গুছিয়ে নিয়ে জোহরাকে সেখানে নিয়ে গেলেন। মেহেরপুরে একটি মিশনারী হাসপাতাল ছিল।
জোহরার চিকিত্সা সেখানে চলতে লাগলো। এক পর্যায়ে তাকে বিশেষভাবে পরীক্ষা করার জন্য হাসপাতালে নিয়ে আসা হলো। দেখা গেলো যে জোহরা মা হতে চলেছেন। কি খুশীর সংবাদ!
এই একটা সংবাদ জোহরা ও জুলমতের জীবন বদলে দিলো। আনন্দে খুশীতে আত্মহারা।
জুলমত তার বৌকে কোথায় রাখবে ভেবে পায় না। সে জোহরাকে তার সাধ্যমতো সেবা যত্ন করতে লাগলো। নিয়মিত ডাক্তারের হেফাজতে থাকলো। তখনকার দিনে পেটের বাচ্চা ছেলে হবে না মেয়ে হবে তা আগে থেকে জানার উপায় ছিল না। ফলে জোহরা ও তার স্বামী অপেক্ষা করতে থাকলো তাদের সন্তানের জন্য ।
হোক সে ছেলে অথবা মেয়ে কিন্তু সন্তান তো, সমস্যা কি? কি আধুনিক চিন্তা। দুজ'নে স্বপ্ন দেখেন। নাম ঠিক করলেন মেয়ে হলে নাম রাখবেন রিহানা আর ছেলে হলে নাম রাখবেন সাগর। দুজ'নে একমত হলেন। আজ থেকে ৫৬ বছর আগে একজন নারী ও পুরুষ বিষয়টি নিয়ে এ ভাবে ভাবছেন।
যা আজকের এই বিংশ শতাব্দিতে অনেক পরিবার ভাবতে পারে না।
যাহোক যথাসময়ে জোহরা মিশনারী হাসপাতালে ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে বাচ্চা প্রসব করলেন। বাচ্চাটি একটি মেয়ে। তারপরেও জোহরা ও জুলমত সেই বাচ্চাটিকে সাদরে গ্রহণ করলেন। তাকে নিয়ে স্বপ্ন দেখলেন।
ঠিক সেই সময়ে তারা দু'জনে মিলে সিদ্ধান্ত নিলেন এই মেয়েকে লেখাপড়া শেখাবেন, ডাক্তার বানাবেন। শুরু হলো সেই লক্ষ্য নিয়ে মেয়ের লালন পালন।
মেয়ের নাম রাখলেন রিহানা। মেয়ের জন্য দুধ কেনা, বিশেষ খাবার কেনা ও খাওয়ানো যেন সে বুদ্ধিমান হয়। কাজ থেকে ফেরার সময় মেয়ের জন্য কিছু হাতে নিয়ে তবে বাড়ীতে ফিরতেন।
এভাবে রিহানা মা বাবার চোখের মণি হিসাবে বেড়ে উঠতে লাগলো।
জোহরার আর কোন বাচ্চা হচ্ছে না। ফলে রিহানাই হলো চোখের মণি। তাকে মাটিতে রাখেনা পিঁপড়ায় খাবে আর মাথায় রাখেনা উঁকুনে খাবে। এতটাই যত্ন করে তাকে বড় করে তুলতে লাগলো।
তাদের মেয়েকে তারা ডাক্তার বানাবে। মেয়ে বড় হয়ে ডাক্তার হবে, মা বেশীর ভাগ সময় অসুস্থ থাকে তার সেবা করবে, সমাজের মানুষের সেবা করবে। একসময় তাদের মেয়ের সুনাম ছড়িয়ে পড়বে সারা দেশে। জোহরা জুলমত স্বপ্ন দেখে আর স্বপ্ন দেথে।
ছোট বেলা থেকে রিহানা অসাধারণ বুদ্ধিমান।
তার গলার স্বর অত্যন্ত সুরেলা। এতটুকু বয়সে সে এত সুন্দর করে গুছিয়ে কথা বলে যে তা সবার তাক লেগে যায়। ছোট্ট রিহানাকে সকলেই আদর করে। তাকে কোলে নিয়ে তার কথা শোনে। রিহানাকে জোহরা ৩ বছর বয়স থেকে বাড়ীতে লেখাপড়া শেখানো শুরু করেন।
অক্ষরজ্ঞান, হাতের লেখা শেখানো হয়। জুলমত তখন ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস-এ চাকরী পায়। তার পোস্টিং হয় ভোলাহাটে। ফলে জুলমত জোহরাকে নিয়ে ভোলাহাটে নিয়ে আসে।
ভোলাহাটে একটি পরিবারের সাথে জোহরা, তার মেয়ে ও জুলমত থাকে।
সেই পরিবারের সদস্যরা কি বলে তা জোহরা বুঝতে পারেনা। তাদের রান্না করার স্টাইল, কথা বলার ধরণ, বড়দের সমীহ করা ইত্যাদি কেমন যেন আলাদা। জোহরাদের গ্রামের বাড়ী এবং শ্বশুর বাড়ীর অধিবাসীরা যেভাবে কথা বলে তা থেকে সম্পুর্ণ ভিন্ন। জোহরার বাপের বাড়ী ও শ্বশুরবাড়ীর সকলে মুরুব্বীদের আপনি করে কথা বলে। বয়সে ছোট ও অত্যন্ত আপনজনকে তুই করে বলে।
আর অন্য সকলকে তুমি করে বলে। কিন্তু এ পরিবারের সদস্যরা সবাইকে তুই বলে সম্বোধন করে। জোহরা খুবই অবাক হয়। যখন শোনে পুত্রবধু তার শ্বশুরকে বলছেঃ আজ তুই কি দিয়ে ভাত খাবি? অথবা, তোকে আর ভাত দেব? ইত্যাদি।
সেই বাড়ীতে একটি ছেলে ছিল।
তার নাম রশিদ। সে ছিল তোতলা। কখনও কখনও একটা শব্দ উচ্চারণ করতে তাকে লাফ দিতে হতো। এ সবই জোহরা অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে অবলোকন করতো। ঐ বাড়ীতে আরও একজন সুশ্রী বউ ছিলো।
সে লেখাপড়া জানতো। জোহরার সাথে বই-এর কথ্য ভাষায় সুরেলা আওয়াজে কথা বলতো। এই একজনের কথা জোহরার ভালো লাগতো। তার সাথে জোহরার সখ্যতা গড়ে ওঠে। তো একদিন রশিদ এসে ঐ বধু অর্থাত্ রশিদের ভাবীকে বলছেঃ বো বো বো বো বো বলে আর বলতে পারে না।
তখন ভাবী শব্দটা শেষ করলোঃ কি বোতক? তখন রশিদ মাথা হেলিয়ে সম্মতি জানায়। তারপরে বলে বোতকে ডি ডি ডি ডিঃ শেষ করতে পারে না। আবার তার ভাবী সে শব্দটি শেষ করে। এভাবে প্রায় ১৫ মিনিট ধরে সে বাক্যটি শেষ করে। বাক্যটি শুনতে এমন হ'লোঃ পাশের পুকুর পাড়ে গাছের ডালে একটি বোতক ডিম পেড়েছে।
জোহরা খুব অবাক হয়। বোতক আবার কি। কিন্তু সে লজ্জায় কাউকে জিজ্ঞাসা করতে পারে না। তবে এটুকু বোঝে যে বোতক কোন পাখি টাখি হবে। কারণ গাছের ডালে ডিম পাড়ে।
তক্কে তক্কে থাকে কখন সামনা সামনি কেউ বললে সে দেখে জেনে নেবে। কিন্তু কেউ সামনা সামনি কিছু বলে না। অগত্যা কি করা! লজ্জা শরমের মাথা খেয়ে এই মিষ্টি সুরেলা কণ্ঠের অধিকারিনীকে জিজ্ঞাসা করতেই হলো। তখন সে হেসে ফেলে বললোঃ ও বোতক? বোতক মানে হাঁস। তখন জোহরা মনে মনে বললোঃ ও হাঁস এখানে এসে হয়েছে বোতক হয়েছে! ও আমার পোড়া কপাল! এভাবে এই পর্বের শেষ হলো।
এভাবে অনেক নতুন নতুন শব্দের সাথে তার পরিচয় হলো।
১৯৫৯-৬০ সালের ঘটনা। ঐ সময়ে ভারত ও পুর্বপাকিস্তানে হিন্দু মুসলিম রায়ট লাগে। ভোলাহাট মহানন্দা নদীর পাড়ে অবস্থিত। এই নদীর এ পারে পুর্বপাকিস্তানের ভোলাহাট আর ও পারে হিন্দুস্তানের মুর্শিদাবাদ জেলা।
হিন্দু মুসলিম রায়টে প্রচুর মানুষের প্রাণ চলে যায়। প্রতিদিন নদীতে মানুষের লাশ ভেসে যায়। জোহরা ভালো করে মনে করতে পারে। মহানন্দা নদীর পানিতে খুব স্রোত। কোথাও পানি খুব গভীর।
আবার কোথাও মাত্র হাটু পানি। নদীর উপর দিয়ে হেঁটে ওপারে চলে যাওয়া যায়। নদীর অপর পারে কি হচ্ছে তা এপার থেকে ভালোভাবে দেখতে পাওয়া যায় ও বোঝা যায়। একদিন নদীতে গোসল করতে যেয়ে জোহরা নদীর অপর পারে তাকিয়ে দেখে যে একজন মানুষের গলাটা কেটে নদীতে ভাসিয়ে দিলো। জোহরা খুব ভয় পায়।
কষ্টও পায় মানুষের নিষ্ঠুরতা দেখে। কিন্তু সে মানুষকে বোঝাবে কি করে যে এমন হিংসাত্মক কাজ করা মোটেই ঠিক নয়। এই সময় প্রচুর গল্প শোনা যায়। অনেক গুজবও আসে। গল্পগুলি এমনঃ একজন গর্ভবতী মাকে চিত্ করে শুইয়ে দিয়ে তার পেটে পাড়া দিয়ে বাচ্চাটাকে বের করে দেয়া হয়।
এভাবে বাচ্চাটি ও মা দুজনকেই মেরে ফেলা হয়। একজন মেয়েকে দেয়ালে আটকে রাখা হয়. তার দুই হাত ওপরে তুলে ঘরের দেয়ালের সাথে পেরেক ঠুকে একাজটি করা হয়। এরকম বহু অত্যাচারের কাহিনি। এসব কাহিনি শুনে জোহরা আঁতকে ওঠে। মানুষের নিষ্ঠুরতা বর্বরতা তাকে খুব কষ্ট দেয়।
কিন্তু সে কিছুই করতে পারে না। এক নিষ্ফল আক্রোশে নিজের ভেতরে নিজে গুমরে মরে।
এই ভোলাহাটে জোহরার মেয়ে রিহানার প্রথম স্কুলের পাঠ শুরু হয়। এখানে জোহরা তার পরিবারের সাথে ৬ মাস থাকে। এরপর জুলমতের পোস্টিং হয়ে যায় চাঁপাই নবাবগঞ্জে।
সে এখানে এসে বাসা নেয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরটি খুব ছোট ছিল। শহরে মাত্র ৯টি গাড়ী ছিল। শহরে অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু ছিল। জুলমত তার পরিবার নিয়ে প্রথমে যে জায়গায় ছিল সে জায়গাটি আমের জন্য খুবই বিখ্যাত।
এখানে রিহানাকে সবাই খুব ভালোবাসতো। সে গাছে উঠে আম পেড়ে খেতো, পেয়ারা পেড়ে খেত। একদিন কাপে করে চা পান করছে। সেই ছোট্ট মেয়েটি চার কাপে ছোট্ট ছোট্ চুমুকে চা খাচ্ছে, তাই দেখে প্রতিবেশী সকলে বলছেঃ দেখেছো মেয়েটির সংস্কার। সে অন্যদের মতো এক চুমুকে চা খেয়ে শেষ করে না।
আস্তে আস্তে ভদ্র লোকেদের মতো ছোটছোট চুমুকে চা খায়।
চাঁপাইনবাবগঞ্জে বেশ কয়েকটি এলাকায় জোহরারা থেকেছে। একটি বাড়ীতে ছিল। সেই বাড়ীটি একবারে মহানন্দা নদীর পাড়ে। বাড়ী থেকে কুলি ফেললে তা নদীর মধ্যে যেয়ে পড়তো।
এই বাড়িটির মালিক ছিল একজন হিন্দু, নাম ফড়িং। একটু অদ্ভুত নাম না। ফড়িং-এর বাড়ীতে ছিল একটি ডাকসাইটে কুকুর। একদিন রিহানা ঘুমিয়ে পড়েছে। তার মা ফড়িং-এর বাড়ীতে বেড়াতে গেছে।
ঘুম ভেঙ্গে রিহানা দেখে তার মা বাড়িতে নেই। সে মাকে খুঁজতে ফড়িং-এর বাড়ীতে গেল। তখন কুকুরটি তাড়া করলো। রিহানা পড়ি মরি করে ছুটে চলে এলো। সেই থেকে রিহানা কুকুরকে বেশ ভয় পায়।
চাঁপাই নবাবগঞ্জে আর একটি বিষয় ছিল। এখানে খুব সাপের উত্পাত ছিল। দরজার আড়ালে, চাউলের ভান্ডের মধ্যে, চুলার মধ্যে বিভিন্ন জায়গায় সাপ শুয়ে থাকতো। সেই সাপের কামড় খেয়ে অনেকে মারা যেত। এখানে একরকমের সাপ ছিল যার নাম ছিল দোআঁশলা সাপ।
এই সাপের বিষ ছিল অনেক। এবং এরা রাত্রে রাস্তায় বের হতো। রাস্তার উপরে আড়াআড়ী শুয়ে থাকতো। অনেক সময় পথচারীর পায়ের নিচে পড়ে গেলে তাকে দৌড়ে যেয়ে কামড় দিত।
এটি ১৯৬১/৬২ সালের কথা।
পুর্বপাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের পশ্চিমবঙ্গে আবার হিন্দু মুসলিম রায়ট হয়। তখন পশ্চিম বঙ্গ ও পুর্বপাকিস্তানের মধ্যে ট্রেন চলাচল করতো। একবার কলকাতা থেকে একটি ট্রেন আসার সময় ট্রেনের পিছনের বগীতে আগুন ধরিয়ে দেয়। সেই ট্রেনটি ঈশ্বরদি এসে থামে। পিছনের বগীগুলোতে আগুন ধরে যায়।
অনেক যাত্রী মারা যায়। সেই সব যাত্রীদের মধ্যে নারী ও শিশুও ছিল। এদিকে পুর্বপাকিস্তানেও প্রচুর হিন্দু জনগণকে মারা হয়। সেই সময় ভয়ে পুর্ব পাকিস্তান থেকে অনেক হিন্দু পরিবার বাড়ী ছেড়ে ভারতে চলে যায়। আবার পশ্চিম বঙ্গ থেকে অনেক মুসলিম পরিবার ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসে।
যে বাড়ীতে জোহরা ভাড়া ছিল তার পাশে একটি হিন্দৃ বাড়ির সকলে বাড়ী ছেড়ে চলে যায়। শুধু একজন বয়ষ্ক মহিলা চলতে ফিরতে পারে না তাকে রেখে চলে যায়। সেই মহিলা ঘরের মধ্যে একা একা থাকতে লাগলো। একসময় মারা যায়। সেই মৃত লাশ ঘরের মধ্যে বেশ কয়েকদিন পড়ে ছিল।
ইতোমধ্যে জোহরার একটি ছেলে হয়। তার নাম রাখে পপি। এই ছেলেকেও তারা খুব ভালোবাসে। বুকের দুধের পাশাপাশী তাকে গুড়ো দুধ খাওয়ানো হয়। ছেলেকে যেন ঠান্ডা দুধ খেতে না হয় এ জন্য ফ্লাক্স কেনা হয়।
দুধ বানিয়ে ফ্লাক্সে রাখা হয়। খিধে পেলে ছেলেকে সেই দুধই খাওয়ানো হয়। কিন্তু জোহরা জানতোনা যে ফ্লাক্সের মধ্যে দুধ বানিয়ে রেখে খাওয়ালে বাচ্চার পেটে অসুখ হয়। শুরু হলো পপির পেটের অসুখ। ডায়রিয়া।
সে কি ডায়রিয়া। পিচকারীর মতো পায়খানা হয়। জোহরার গায়ে তো পায়খানা থাকেই। জুলমতের গায়েও পায়খানা থাকে। কখনও সেই অবস্থায় সে অফিসে চলে যায়।
ছেলেকে ডাক্তার দেখানো হয়। আস্তে আস্তে সে সেরে ওঠে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহরে তখন একটি মাত্র সরকারী বালিকা বিদ্যালয় ছিল। জুলমত ও জোহরা রিহানাকে সেই বিদ্যালয়ে তৃতীয় শ্রেণীতে ভর্তি করে দেয়। ভর্তি করার সময় তার জন্য নতুন ফ্রগ কিনে দেয়, জুতা কিনে দেয়, বই কিনে দেয়, ব্যাগ ও কিনে দেয়।
শুরু হয় রিহানার স্কুল জীবন। রিহানার যেন কোন সমস্যা না হয়, হাতে টাকা না থাকলে যেন খাওয়ায় কষ্ট না হয় তার জন্য শহরের সকল দোকানদারকে বলে দেয়ঃ আমার মেয়ে এসে যা চাইবে তাই যেন দেয়া হয়। আমি পরে এসে দাম দিয়ে দেব। এভাবে জুলমত তার মেয়েকে একটি স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে বেড়ে উঠতে সাহায্য করেছে।
জোহরার নিজের পড়ার খুব শখ।
সেই সময় এখনকার মতো এস এস সি ছিলনা। ছিল মেট্রিক। জোহরা চাইলো সে মেট্রিক পাশ করবে। স্বামীর কাছে আবদার করলো। স্বামী বললো এই বয়সে আবার লেখাপড়া শেখার কি প্রয়োজন।
তুমি তো জজ ব্যারিস্টার হতে পারবে না। তার চাইতে তুমি বাচ্চাদের লেখাপাড়া শেখানোর কাজটি মনযোগ দিয়ে করো। তাহলেই চলবে। এভাবে জোহরার স্বপ্রটি অঙ্কুরেই মরে গেলো।
এই সময়ে বাংলাদেশে প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হতে থাকে।
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক হতে গেলে তাকে ৫ম শ্রেণী পাশ হতে হবে। জোহরা ৫ম শ্রেণী পাশ। অতএব তার শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেয়ার যোগ্যতা আছে। স্বামীকে বললোঃ আমি প্রাইমারী স্কুলে পড়ানোর চাকরী নেবো। জুলমত হেসে বলেঃ কেন আমি কি তোমাকে খেতে পরতে দিতে পারছিনা! আমি কি তোমার স্বাদ আহলাদ পুরণ করতে পারছিনা যে তোমাকে চাকরী করতে হবে।
তুমি আমার বাচ্চা দুটিকে দেখো, তাদেরকে মানুষ করো। তাহলেই হবে। এর কিছুদিন পর পরিবার পরিকল্পনা বিভাগে পরিবার পরিকল্পনা সহকারী পদে কর্মী নিয়োগ হচ্ছে। সেখানেও ৫ম শ্রেণী পাশ হলে সে এই চাকরী পেতে পারে। এখানে চাকরী করার যোগ্যতাও জোহরার ছিল।
কিন্তু জুলমতের একই কথাঃ তুমি চাকরীতে গেলে আমার সংসার আমার বাচ্চাদের কে মানুষ করবে। তাছাড়া সংসারে তো অভাব নেই। তাহলে তোমার চাকরী করা কি প্রয়োজন।
জোহরা মোকছুদুল মোমিনিন বই পড়ে। আনোয়ারা মনোয়ারা পড়ে।
সেখানে একজন আদর্শ বউএর গুণাবলী লেখা আছে। সেই গুণাবলী অর্জনের জন্য প্রাণান্তকর চেষ্টা করে। স্বামীর পায়ের তলায় বেহেশত। স্বামীর অবাধ্য হলে এ জীবনে তো সুখ হবেই না, ছওয়াবও হবে না। ফলে পরকালে যেয়ে দোযখের আগুনে পুড়তে হবে।
তাই জোহরা স্বামী যা বলে তাই শোনে। অতএব জোহরা চাকরী করার বাসনা ত্যাগ করলো। এখানে উল্লেখ্য যে যে জুলমত তার মেয়েকে সম্পদ ব্যক্তিতে পরিণত করার জন্য বদ্ধ পরিকর কিন্তু সে নিজের স্ত্রীকে কিন্তু সে সুযোগ দিতে রাজী হয় নি।
ছেলে মেয়ে দুটিকে সে বড় করতে লাগলো। এরপর ১৯৬৫ সালে পাকিস্তান হিন্দুস্তান যুদ্ধ বাধলো।
জোহরা বাচ্চাদের নিয়ে গ্রামের বাড়ীতে চলে এলো। হঠাত্ একদিন সংবাদ এলো জুলমতের স্মল পক্স হয়েছে। জোহরা রিহানাকে বাড়ীতে রেখে ছেলেটিকে নিয়ে যশোর শহরে চলে এলো স্বামীকে সেবা করার জন্য। জুলমত সুস্থ হয়ে উঠলো। এই সময়ে জোহরা আবার মা হতে চললো, এবং একটা ছেলে হলো।
এই ছেলেটি একটু প্রতিবন্ধি মতো। যশোর শহরে জুলমতের নানী বাড়ী। জোহরা মামাশ্বশুর বাড়ী বেড়াতে এসেছে। মামাশ্বশুর বাড়ী হলো কাঁচা বাড়ী। গোলপাতার ছাউনি, মাটির দেয়াল।
তো ঘরের বারান্দায় ছোট ছেলেকে বসিয়ে রেখে জোহরা কাজ করছে। ছেলেটি বসে আছে কিন্তু মাথা স্থির রাখতে পারছে না। একটু একটু দুলছে। বিষয়টি জোহরার চোখে পড়েনি। মামী শ্বাশুড়ী জোহরাকে ডেকে দেখালো।
এবং বললোঃ পাশে গরীব পীর সাহেবের দরগা আছে। সেখানে ছেলেকে নিয়ে যাও। মানত করো। হয়তো ভালো হয়েও যেতে পারে। জোহরা তাই করলো।
ছেলের মাথা দোলানো কমলো। কিন্তু ছেলে হলো আলাভোলা।
জোহরার জীবনে আর একটি মোড় এলো। জোহরার স্বামী তখনও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (ইপিআর)-এ সিপাহী পদে চাকরী করছে। তার পোস্টিং যশোর শহরে ষষ্টিতলা পাড়ায় ভোলা ট্যাংকের পাশে ইপিআর-এর ক্যাম্প আছে সেখানে থাকে।
সেই ক্যাম্পের পাশে একটি বস্তীতে কিছু খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষ বসবাস করে। তাদের মধ্য থেকে একটি মেয়েকে জুলমতের খুব পছন্দ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে তার সাথে তার আবার প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে। মজার ঘটনা হলো এই কথা সে জোহরার কাছে গোপন রাখে নি। এক পর্যায়ে জুলমত গ্রামের বাড়ী থেকে জোহরাকে যশোর শহরে বাসা ভাড়া করে নিয়ে আসে।
জোহরা মকছুদুল মোমিনিন বই পড়ে, মনোয়ারা পড়ে, আনোয়ারা পড়ে। হাদিস শোনে, এবং একজন ভালো বধু হতে চায়। সে বিশ্বাস করে যে স্বামীর কথা মতো চললে তার স্বামী তাকে সারা জীবন ভালোবাসবে। তার সাথে সংসার করবে। পরকালে আল্লাহর দীদার লাভ করবে।
ফলে সে তার স্বামীকে এই ২য় প্রেমে সহযোগিতা করে। অবশ্য নিজের স্বামীর ভাগ অন্য এক নারীকে দেয়া খুব কঠিন। জোহরা তার আজন্ম সংস্কারের কাছে হার মানে। অনেক ঝগড়া হয়, সংসারে অশান্তি আসে। এত আদরের রিহানা তার পড়ালেখায়ও বাধা আসে।
এক পর্যায়ে জোহরা সেই মেয়ের সাথে নিজের স্বামীর বিয়ে দিয়ে দেয়। শুরু হলো সতীনের সাথে জোহরার সংসার। সে এক অবর্ণনীয় ঘটনা।
রিহানা তখন নবম শ্রেণীতে পড়ে। তার পড়ালেখা বন্ধ হয়ে গেল।
জোহরা ও জুলমতের সংসারে সব সময় ঝগড়া লেগেই থাকলো। ইতোমধ্যে জুলমত চাকরী থেকে অবসর নেয়। গ্রামের বাড়ী সীমাখালী বাজারে মুদি দোকান দেয়। ২য় বিয়ের এক বছরের মাথায় দু'জনেরই দু'টো ছেলে হয়। সতীনের সংসারে অশান্তির আগুনে পুড়ে না থাকতে পেরে জোহরা তার বাপের বাড়ী চলে যায়।
জোহরার বাবা জোহরাকে আবার বিয়ে দিতে চায়। কিন্তু জোহরা বলেঃ না মেয়েদের বিয়ে একবারই হয়। আমার বিয়েও একবার হয়েছে। আমি আর বিয়ে করবোনা। আমার বাচ্চারা রয়েছে তাদেরকে সত্ মায়ের ঘরে রেখে আমি আর কোন ঘরে যেয়ে শান্তি পাবো না।
ফলে জোহরার আর বিয়ে হলো না। কিন্তু জোহরা তার পিতার সহানুভুতি হারালো। এভাবে সে জুলমতের সংসারে থেকে গেল।
এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলো। জোহরার তখন ১ মেয়ে ও ৩ ছেলে ।
আবার আর একটি বাচ্চা হবে। জুলমত ইপিআর-এ চাকরি করতো, রাজনৈতিক ভাবে আওয়ামী লীগে বিশ্বাসী। তাই মুক্তিযুদ্ধের সময় সে বাড়ীতে থাকতে পারে নি। বাড়ি থেকে কোথায় চলে যায় কেউ জানে না। জোহরা সেই ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে দিন কাটাতে লাগলো।
রিহানা এস এস সি পরীক্ষা দেবে। সে ১৬ বছরের তরুণী। এই এলাকায় ছিল নক্সালদের প্রাধান্য, পাশাপাশী রাজাকারদের প্রাধান্যও ছিল। ফলে রিহানাকে বাড়িতে রাখা নিরাপদ মনে করলো না। অপরদিকে রিহানা ছাত্রলীগের রাজনীতির সাথে জড়িত।
ফলে তাকে নিয়ে জোহরা পড়লো মহা বিপদে। এক পর্যায়ে তার এক আত্মীয়ের সাথে রিহানাকে ভারতে পাঠিয়ে দেয়। ৯ মাস রিহানার কোন খবর পায় নি। বড় ছেলেটির বয়স মাত্র ৯ বছর। সেই ছেলেটিকে দিয়ে বাজারে ফল তরকারী ইত্যাদি বিক্রি করে নিজের সংসার চলিয়েছে।
অনেকে এসে বলেছেঃ নদীতে তোমার রিহানার লাশ ভেসে যেতে দেখলাম। কেউ বলেঃ রিহানাকে মেলেটারীরা ধরে নিয়ে গেছে। জোহরা শোনে আর কাঁদে। কিছু বলতে পারে না। দীর্ঘ ৯ মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীন হলো।
জুলমত রিহানা ফিরে এলো। আবার শুরু হলো সেই সংসার। মুক্তিযুদ্ধের শেষের দিকে জোহরার আর একটি মেয়ে হয়। ১৯৭৮ সালের দিকে জোহরার আর একটি ছেলে হয়। সর্বসাকুল্যে জোহরার ৪ ছেলে ২ মেয়ে হয়।
এর মধ্যে বড় ছেলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম এ পাশ করেছে পি এইচ ডি ডিগ্রি নিয়েছে। সরকারী কলেজে অধ্যাপনা করে। মেঝ ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ফিন্যান্সে এম এ করে ব্যাংকে চাকরী করছে, সেঝ ছেলে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে ইংলিশ-এ এম এ করে চাকরী না করে নিজে ইংরেজী শিক্ষা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে সাভারে। পরে সে ব্লাড ক্যান্সারে মারা যায়। বড় মেয়ে রিহানা বি এড সম্পন্ন করে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে এবং নিজেকে উন্নয়ন কর্মী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে, ছোট মেয়ে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে এম এ করে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হয়েছে।
শুধু ছোট ছেলেটি এইচ এস সি ফেল করে আর উচ্চ শিক্ষা নেয় নি। প্যারামেডিক কোর্স সম্পন্ন করে এখন গ্রামে ডাক্তারী করছে। বড় ছেলের বউ ইংলিশ-এ এম এ একটি কলেজে অধ্যাপনা করছে। মেঝ ছেলের বউ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ব বিদ্যালয় থেকে পদার্থবিদ্যায় এম এ করে এখন চাকরী খুঁজছে। সেঝ ছেলে যে মারা গেছে তার বউ জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম এ করে এখন সেখানেই অধ্যাপনা করছে।
ছোট ছেলের বউ গৃহীনী। জামাই দু'জনই উন্নয়ন কর্মী। বড় মেয়ে রিহানার দুই মেয়েই স্কলার। তারা দুজনেই জাহাঙ্গীর নগর ইউনিভার্সিটিতে পড়ছে। বড় মেয়ে এম এ ফাইনাল পরীক্ষা দিয়েছে।
ছোট মেয়ে অনার্স ৩য় বর্ষে পড়ছে। বড় ছেলের বড় ছেলে ৫ম শ্রেণী থেকে ট্যালেন্ট পুলে বৃত্তি পেয়েছে। ছোট মেয়েটি এবার ১ম শ্রেণীতে উঠেছে। তার পরীক্ষার খাতায় কোন শিক্ষক এক নম্বরও কাটতে পারে নি। মেঝ ছেলের একটি মাত্র ছেলে।
সে ও স্কলার। সেঝ ছেলের কোন ছেলেমেয়ে হওয়ার আগেই সে চির বিদায় নিয়েছে। ছোট মেয়ের দুইটি মেয়ে ও ছোট ছেলের একটি মেয়ে। প্রত্যেকে যার যার জায়গায় একজন স্কলার। ১৯৯৮ সালে জুলমত এই পৃথিবী থেকে চির বিদায় নেয়।
জোহরা এখন ৭৫ বছর বয়স পার করছে। এখন সে সুখী এবং একজন রত্নগর্ভা মা। সত্যিই সে সুখী এবং সফল একজন নারী। সে থাকে তার ছোট মেয়ের কাছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।