জামায়াত একাত্তরে রাজনৈতিক কারণে কেবল মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা নয়, যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধ করেছে। জামায়াতের এ ভূমিকা ঐতিহাসিকভাবে সত্য এবং আইনগতভাবেও প্রমাণিত। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পর যখন তাদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়েছে তারা তখন ফিরে গেছে পুরনো চেহারায়। এবার তাদের যুদ্ধ স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে! তাদের জঙ্গী ও সন্ত্রাসী তা-বে গোটা দেশে আজ নৈরাজ্য আর আতঙ্ক। পুলিশ, রেল, বিদ্যুত কেন্দ্র, ব্যাংক, সরকারী অফিস, মসজিদ-মন্দির, কোরান-গীতা, সংখ্যালঘুদের বাড়ি, দোকান কিছুই বাদ যায়নি তাদের ধ্বংসলীলা থেকে।
নিজ গৃহেও মানুষ নিরাপদ নয়। আগুনে পুড়িয়ে, রগ কেটে, জবাই করে প্রতিপক্ষকে তারা হত্যা করছে। সাধারণ মানুষের ওপর তাদের এ প্রতিহিংসা গণহত্যায় রূপ নিয়েছে।
একাত্তরের পরে নামে-বেনামে জামায়াত নানাভাবে বাংলাদেশে জঙ্গীবাদী তৎপরতা চালিয়েছে। বিশেষ করে বিগত চারদলীয় জোট সরকারের আমলে (২০০১-২০০৬) সরকারে থেকে জামায়াত বাংলাদেশে উগ্র জঙ্গীবাদের বিস্তার ঘটায়।
বর্তমান সরকার যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের পর থেকে তারা মরিয়া হয়ে উঠেছে। একেকটি রায়ের পর গোটা দেশে তারা নৈরাজ্যের হোলিখেলায় মত্ত হয়েছে। কেবল সাঈদীর মামলার রায়ের পরেই নিহত হয়েছে ৫০ জনের বেশি মানুষ। বিএনপি’র নেতৃত্বে ১৮ দলীয় জোটের হরতাল-অবরোধে ধ্বংসযজ্ঞের মূল কাজটি করে জামায়াত-শিবির। কুখ্যাত রাজাকার ‘মিরপুরের কসাই’ কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ঢাকাসহ সারাদেশে তারা নৈরাজ্যের উন্মাদনায় মেতে ওঠে।
রাতের আঁধারে ঘুমন্ত প্রতিপক্ষকে মধ্যযুগীয় বর্বরতায় হত্যা করেছে। পবিত্র জুমার নামাজ শেষে সাধারণ মনুষের ওপর হামলে পড়েছে হিংস্র্র পাশবিকতা নিয়ে।
জামায়াত তাদের রাজাকার নেতৃবৃন্দকে বাঁচাতে সম্ভব সবকিছু করেছে। আদালতে আইনী লড়াই ছাড়াও অহেতুক কালক্ষেপণ, গুজব, ষড়যন্ত্র, অপপ্রচার হেন উপায় নেই যা তারা অবলম্বন করেনি। সর্বোচ্চ আইনগত সুবিধা তারা নিয়েছে।
কিন্তু আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়নি কখনও। জামায়াতপন্থী বিভিন্ন ব্লগে আদালত সম্পর্কে অবজ্ঞা, অশ্রদ্ধা ও অসম্মান করে অনেক বিভ্রান্তিমূলক লেখা প্রকাশ করা হয়েছে। কোটি কোটি ডলার খরচ করে লবিস্ট নিয়োগ করে বিদেশী গণমাধ্যম ও ব্যক্তিবর্গের মাধ্যমে আদালত সম্পর্কে প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। এতকিছুর পরেও সমস্ত আইনগত প্রক্রিয়া অনুসরণ শেষে মামলার রায় যখন বিপক্ষে গেছে জামায়াত-শিবির সারাদেশে নারকীয় তা-বলীলায় মেতে উঠেছে। ট্রাইব্যুনালের রায়ের পর এর বিরুদ্ধে আইনজীবীরা উচ্চ আদালতে আপীল করেছেন (বিশ্বের খুব কমসংখ্যক আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই আপীলের সুযোগ থাকে)।
আইনী লড়াইয়ের মাধ্যমে তারা সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন গণহত্যা, খুন, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের অভিযোগ থেকে তাদের নেতৃবৃন্দকে মুক্ত করতে। অন্যদিকে দল হিসেবে জামায়াত ও নব্য আল-বদর শিবির হরতাল-অবরোধ ও বিক্ষোভের নামে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, লুটতরাজ, ভাংচুরের উৎসবে মেতেছে। তারা মামলার সাক্ষীকে হত্যা করছে, হুমকি দিচ্ছে, বিচারপতি ও আইনজীবীদের বাড়িতে বোমা হামলা ও অগ্নিসংযোগ করছে। একাত্তরে সংঘটিত বিভিন্ন অপরাধের পুনরাবৃত্তি করে তারা যেমন আদালতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করছে, তেমনি প্রতিশোধ নিচ্ছে একাত্তরে তাদের শোচনীয় পরাজয়ের।
আদালতের প্রতি জামায়াত-শিবিরের এই ঔদ্ধত্য প্রদর্শনের জন্য মানবতাবিরোধী মামলার আসামি পক্ষের আইনজীবীদের কোন জবাবদিহিতা করতে হয়েছে বলে আমার জানা নেই।
কিন্তু এটি বাঞ্ছনীয় ছিল। কারণ মামলার প্রধান আইনজীবী জামায়াতের অন্যতম শীর্ষ নেতা। বিভিন্ন মামলার প্রতিক্রিয়ায় জামায়াত-শিবির যে বর্বর ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে তার দায় শীর্ষ নেতৃবৃন্দ কোনভাবেই এড়াতে পারেন না। কারণ সহিংসতা বন্ধে তারা দল থেকে কোন নির্দেশনা দেননি বা উদ্যোগ গ্রহণ করেননি। ঘটনার পরে তারা এর দায় অস্বীকার করেননি।
এমনকি এসব ঘটনার নিন্দা জানিয়ে কোন বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। (যদিও অস্বীকার করলে কিংবা বিবৃতি দিলেই ঘটনা মিথ্যা হয়ে যায় না কিংবা জামায়াত দায়মুক্তি পেতে পারে না)। একটি মামলায় আদালতে আইনী লড়াইয়ের সমান্তরালে রাজপথে পরিকল্পিত সহিংসতা চলতে পারে না। জঙ্গী ও সন্ত্রাসী কর্মকা-ের মাধ্যমে দলগতভাবে জামায়াত যে ঔদ্ধত্য প্রদর্শন করছে তা কেবল জনজীবনের জন্য হুমকি নয়, আইনের শাসন এবং আদালতের প্রতি প্রকাশ্য অবজ্ঞা। কাদের মোল্লার স্ত্রীও উল্টোভাবে ‘ভি’ প্রদর্শন করে এ অবজ্ঞা প্রকাশ করেছেন।
তারা আদালতের প্রতি ওপেন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এই অবজ্ঞা ও চ্যালেঞ্জের অবশ্যই আইনগত প্রতিকার হওয়া প্রয়োজন।
জামায়াত-শিবিরের নৈরাজ্য মোকাবেলায় সরকারকেও নতুন কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। পাশাপাশি প্রয়োজন জনপ্রতিরোধ। পাড়া-মহল্লা কিংবা প্রতিটি গলিতে পুলিশ-বিজিবি মোতায়েন সম্ভব নয়।
সাধারণ মানুষ সাহসী ও সোচ্চার হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুললে, অন্তত অপরাধীদের ধরে পুলিশে সোপর্দ করলে এই অপশক্তির দৌরাত্ম্য না কমার কোন কারণ নেই। জামায়াত-শিবিরের প্রতি কোন অনুকম্পা নয়। তারা দেশের শত্রু, মানবতার শত্রু, উন্নয়ন ও প্রগতির শত্রু। এদেশকে আজ পর্যন্ত তারা ভালবাসা দূরে থাক, নিজের বলেই ভাবতে পারেনি। সম্প্রীতির এই বাংলাদেশ তারা অভিশপ্ত পাকিস্তান-আফগানিস্তান বানাতে চায়।
সর্বস্তরের মানুষকে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে হবে। পাশাপাশি আদালত ইতোমধ্যে জামায়াতকে সন্ত্রাসী দল হিসেবে রায় দিয়েছেন। তাদের কর্মকা-েও তা বার বার প্রমাণিত হয়েছে। সুতরাং আইনগতভাবে দলটিকে নিষিদ্ধ করার বিষয়টি সরকারের সক্রিয়ভাবে চিন্তা করা উচিত।
ধারণা করা হচ্ছে, আগামীতে জামায়াত-শিবির আরও হিংস্র্র হয়ে উঠবে।
সরকারের শেষ সময়ে তারা কেবল অস্থিতিশীলতা নয়, সরকারের পতন ঘটাতে সর্বশক্তি নিয়োগ করবে। কারণ বর্তমান সরকার বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রীর বিদায় ছাড়া রাজাকার নেতাদের বাঁচার আর কোন পথ নেই। সেকারণে অবাধ সুষ্ঠু নির্বাচন নয়, মূল দাবি শেখ হাসিনাকে সরে যেতে হবে। এ লক্ষ্যেই তারা বিএনপিকে নির্বাচন বর্জনে বাধ্য করেছে। তারা ব্যাপক সহিংসতা ও নাশকতা করে নির্বাচন ভ-ুলের মাধ্যমে তৃতীয় শক্তির আগমনের প্রত্যাশায় আছে।
এক-এগারো পরবর্তী সরকারের সময় রাজনৈতিক দল হিসেবে সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছিল জামায়াত। তারা ধারণা করে, আগামীতেও তৃতীয় শক্তি হিসেবে যারাই আসুক, জামায়াতের জন্য তারা হুমকি নয়। সুতরাং সামগ্রিক পরিস্থিতি সামাল দেয়া সরকারের জন্য নিঃসন্দেহে চ্যালেঞ্জিং। পাশাপাশি টানা হরতাল-অবরোধে দেশের অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রা স্থবির নয়, বলা যেতে পিছন দিকে যাচ্ছে। সুতরাং সঙ্কট বহুমুখী এবং সমাধানের পথও বের করতে হবে দ্রুত।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।