হরতাল-অবরোধে ককটেল, গুলি, বোমার পাশাপাশি 'পেট্রলবোমা' ভয়ানক মারণাস্ত্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। বানাতে সহজ ও উপকরণগুলো সর্বত্র পাওয়া যাওয়ায়, তাই পেট্রলবোমা উঠে এসেছে দুর্বৃত্তদের হাতে হাতে। বোতলে পেট্রল, কাচ ভাঙা, পাথরকুচি আর বিস্ফোরক বারুদ ভরে বানানো পেট্রলবোমার বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও অনেক বেশি। কয়েকটি ককটেল ও হাতবোমার চেয়েও ভয়ঙ্কর ক্ষতিসাধিত পেট্রলবোমায়। বড় বাস-মিনিবাস, দোকান-প্রতিষ্ঠান জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া সম্ভব হয় কয়েক মুহূর্তেই।
এসব কারণে পেট্রলবোমার প্রতিই পিকেটারদের ঝোঁকটা অনেক বেশি। সড়কপথে গাড়িচালক ও বাসযাত্রীদের জন্য মূর্তিমান আতঙ্ক এখন 'পেট্রলবোমা'। নিরাপদ দূরত্বে অবস্থান নিয়ে যানবাহনে আগুন দিতেও পিকেটাররা এটা ব্যবহার করছে।
গত প্রায় দুই মাসের টানা হরতাল-অবরোধে শুধু পেট্রলবোমার আঘাতে ও বিস্ফোরণজনিত আগুনে পুড়ে মারা গেছেন অন্তত ৬৩ জন, আহতের সংখ্যা ৮ শতাধিক। পেট্রলবোমায় জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে প্রায় ৪০০ গাড়ি।
গত ২৮ নভেম্বর রাজধানীর শাহবাগে যাত্রীবাহী বাসে পেট্রলবোমা ছুড়ে দেওয়ার ঘটনায় ১৯ যাত্রী পুড়ে দগ্ধ হওয়ার ভয়ঙ্কর ঘটনায় দেশবাসী অাঁতকে ওঠেন। ওই ঘটনায় এরই মধ্যে ১১ জনের করুণ মৃত্যু ঘটেছে, বাকিদের জীবন ধুঁকছে এখনো। উলি্লখিত সময়ে রাজধানীসহ সারা দেশে কমপক্ষে ১০ হাজার পেট্রলবোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অজস । সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরাখবর ও পুলিশ রেকর্ড সূত্রে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, 'ককটেলের চেয়ে পেট্রলবোমা তৈরি সহজ হওয়ায় এর ব্যবহার বাড়ছে। ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটলে প্রচণ্ড শব্দ হয়। এতে জনতা কিংবা পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয় থাকে। কিন্তু পেট্রলবোমা ছুড়লে সে আশঙ্কা থাকে না। বোতল ভাঙার শব্দ ছাড়া তেমন শব্দ হয় না।
তাই দূর থেকে পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করে যানবাহনে আগুন দেওয়ার ঘটনা বাড়ছে। নগর গোয়েন্দা পুলিশের বোম্ব ডিসপজাল ইউনিটের সদস্য সন্তোষ চাকমা জানান, ককটেল বিস্ফোরণে আতঙ্ক ও আংশিক ক্ষয়ক্ষতি হয়, কিন্তু পেট্রলবোমায় লক্ষ্যবস্তুতে ধ্বংসযজ্ঞ ঘটে থাকে। ' পেট্রলবোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় গ্রেফতারকৃত অপরাধীদের বরাত দিয়ে গোয়েন্দা সূত্র জানিয়েছে, ২৫০ মিলি কাচের একটি বোতলে ভরা হয় ১৪০-১৫০ মিলি পরিমাণ পেট্রল। এর পর ওই বোতলে ঢোকানো হয় কিছু ভাঙা মার্বেল বা কাচের টুকরা। এর পর হারিকেনের ফিতা ভেতরে ঢুকিয়ে ওই বোতলের মুখ ভালো করে ছেঁড়া কাপড় ও স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে দেওয়া হয়।
এর পর সময়মতো ফিতার মাথায় আগুন জ্বালিয়ে ঝাঁকিয়েই ছুড়ে দেওয়া হয় দূরে, লক্ষ্যবস্তুতে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা জানান, কিছুদিন আগেও হরতাল-অবরোধকালে ককটেল বিস্ফোরণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকত পিকেটাররা। কিন্তু বর্তমানে ককটেলের চেয়ে পেট্রলবোমাকেই প্রধান হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিয়েছে দুর্বৃত্তরা। এটি দূর থেকে যানবাহনে নিক্ষেপ করলে তাতে আগুন ধরে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয় জেনেই এগুলো ব্যবহার করছে দুর্বৃত্তরা। এদিকে একটি ককটেল তৈরি করতে যা খরচ হয় তার চেয়ে একটি পেট্রলবোমা বানাতে খরচ কম হয় বলে জানা গেছে।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা গেছে, ককটেল বা বোমা তৈরিতে রাসায়নিক নানা উপকরণের দরকার হয়, সেগুলো বহন-পরিবহন ও প্রস্তুত করার কার্যক্রমও সহজলভ্য নয়। অথচ একটি বোতলে পেট্রল ভরে তাতে একগোছা সুতা ব্যবহার করেও পেট্রলবোমা তৈরি করা যায়। ওই সুতায় আগুন ধরিয়ে ছুড়ে দিলেই লক্ষ্যবস্তুতে আগুনের হলকা ছড়িয়ে পড়ে। ডিবির এক দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলেন, বোমাবাজরা চুক্তিভিত্তিক নাশকতা করছে। কোনো বোমা ছোড়ার পর ক্ষয়ক্ষতি বেশি হলে বোমাবাজদের পারিশ্রমিকও বেশি দেওয়া হয়।
আর বোমা ছোড়ার অভিযান সফল হলে নগদ তাদের পাওনা পরিশোধ করা হয়। ঘটনাস্থলে বোমা ফাটানোর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বোমাবাজ সবাই গোপন জায়গায় একত্রিত হয়। সেখানেই টাকার ভাগ-বাটোয়ারা হয়। বোমাবাজ গ্রুপের কোনো সদস্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়লে তাদের সহযোগিতার জন্যও রয়েছে আলাদা ফান্ড। কয়েকটি গ্রুপে রয়েছে নারী বোমাবাজ।
কারা বানাচ্ছে, কোথায় কোথায়? : গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন বলেন, রাজধানীতে শতাধিক গ্রুপ পেট্রলবোমা তৈরি ও সরবরাহের কাজে লিপ্ত রয়েছে। বিভিন্ন সময় ককটেল উদ্ধারের পাশাপাশি গ্রেফতার করা কারিগরদের জিজ্ঞাসাবাদের মাধ্যমে জানা গেছে, যারা ককটেল বানান, তারাই এ পেট্রলবোমা তৈরি করেন। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) তালিকায় পেট্রলবোমা তৈরি ও বিস্ফোরণ ঘটানোদের নাম-পরিচয় উঠে এসেছে। তাদের গ্রেফতারের জন্য নানামুখী অভিযান চালানো হচ্ছে বলেও দাবি করেছেন ডিসি (ডিবি, দক্ষিণ) কৃষ্ণপদ রায়। তালিকায় থাকা সদস্যরা হলো- সাবি্বর, জহির, আরমান, উজ্জ্বল, রকি, চাচা সোহেল, পাভেল ওরফে পারভেজ ও সোহেল।
রাজধানীতে একসময় বোমা তৈরির সঙ্গে জড়িত থাকলেও এখন পেট্রলবোমা বানানোর কাজে লিপ্ত থাকা সদস্যরা হচ্ছে- বোমা মানিক, জুবায়ের, বোমা কামাল, মিল্টন, জাকির, হাফিজুর, ফিরোজ, লরেন্স, জাহিদ, আশরাফ, রাজন, বালতি জাহাঙ্গীর, ফারুক, মামুন, আমির প্রমুখ। পুরান ঢাকার ডলি আক্তার নামে বোমা তৈরির এক নারী কারিগরও পুলিশের নজরদারিতে। এ ছাড়া কাকরাইল এলাকার সেন্টু, মাহবুব, শাহাবুদ্দিন ও কামাল বোমা তৈরির সঙ্গে জড়িত। তবে এসব কারিগর রাজনৈতিক সহিংসতা শুরুর পরপরই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়েছে। যেহেতু ককটেলের মতো পেট্রলবোমা বানিয়ে সরবরাহ দিতে হয় না, সেক্ষেত্রে যে এলাকার চাহিদা সেখানেই কারিগর চলে যাচ্ছেন এবং চাহিদা অনুযায়ী পেট্রলবোমা বানিয়ে হাতে তুলে দিচ্ছেন।
পেট্রলবোমার প্রধান উপকরণ হিসেবে পেট্রল জোগাড় করা সবচেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে পড়ে। পুলিশ প্রতিটি পেট্রল পাম্পে পাহারা বসিয়ে খুচরা পেট্রল-ডিজেল বিক্রি নিষিদ্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু পেট্রলবোমা প্রস্তুতকারীরা নিজেদের মোটরসাইকেল নিয়ে পেট্রল পাম্পগুলো থেকে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পেট্রল কিনে টাঙ্কিতে ভরছেন, পরে সুবিধাজনক স্থানে নিয়ে প্লাস্টিকের পাইপের সাহায্যে ট্যাঙ্কি থেকে পেট্রল সংগ্রহ করে নিচ্ছেন। ফলে ইদানীং পুলিশ মোটরসাইকেলে পেট্রল নেওয়ার ক্ষেত্রেও বিশেষ নজরদারি চালাচ্ছে বলে পেট্রল পাম্পগুলো সূত্রে জানা গেছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।