1
ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৪৪ সালের মার্চ মাসের এক স্নিগ্ধ সকালে। অ্যামি রাফনার নামের সাত বছর বয়সী কৃষ্ণাঙ্গ অ্যামেরিকান কিশোরীটি তার ভাইয়ের সাথে মিলে তাদের গরুগুলোকে ঘাস খাওয়াচ্ছিল।
ঠিক তখনই কোথা থেকে হঠাৎ ওদের সামনে এসে উদয় হল দুটি শ্বেতাঙ্গ কিশোরী। মুহূর্তের জন্য অ্যামির মনে হল আকাশ থেকে নেমে এসেছে দুটি শুভ্র পরী।
অ্যামির দিকে তাকিয়ে শ্বেতাঙ্গ কিশোরীদ্বয়ের একজন জিজ্ঞেস করলো- এখানে বুনোফুল কোথায় পাওয়া যাবে?
কিংকর্তব্যবিমূঢ় অ্যামি ঘাড় ঘুড়িয়ে তার চৌদ্দ বছর বয়সী ভাই জর্জ স্টিনি’র দিকে তাকায়।
স্টিনি’র অবস্থাও তখন তথৈবচ। মিনমিন করে কোনমতে বলল যে সে ও বুনো ফুলের সন্ধান জানেনা।
অতঃপর বেণী দুলিয়ে শ্বেতাঙ্গ কিশোরীদ্বয় ফিরে গেল আর দুই ভাইবোন অ্যামি আর জর্জ মিলে ব্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের গরুগুলোকে নিয়ে।
আপাতদৃষ্টিতে নির্জন তৃণভূমিতে চারজন কিশোর কিশোরীর এভাবে দেখা হয়ে যাবার ঘটনাটিকে বেশ সাধারণ মনে হলেও ১৯৯৪ সালের পটভূমিতে দৃশ্যটি কিন্তু মোটেও স্বাভাবিক ছিলনা।
দুই কৃষ্ণাঙ্গ ভাইবোন অ্যামি (৭) আর স্টিনি (১৪) এর সাথে স্বর্ণকেশী শ্বেতাঙ্গ দুই কিশোরী ম্যারি (৮) আর বেটি’র (১১) আকস্মিক সাক্ষাৎটি ঘটেছিল দক্ষিণ ক্যারোলিনার অ্যালক্যালু গ্রামে, যেখানে শ্বেতাঙ্গদের প্রবেশাধিকার ছিল সীমিত।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সে সময়টায় তখন জাপানিজ সৈন্যরা ব্রিটিশ শাসিত ভারতের আসাম রাজ্যে কেবলমাত্র আক্রমণ শুরু করেছে।
আর ঠিক সেই সময়েই ভূগোলকের বিপরীতপার্শ্বে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বাতাস ভারি হয়েছিল ঘৃণা আর বর্ণবৈষম্যের তীব্র বাষ্পে।
আট আর এগারো বছর বয়সী ম্যারি আর বেটি তো আর তখন এতো কিছু বুঝে উঠতে পারেনি। বুনোফুল আর প্রজাপতির পেছন পেছন দৌড়ে দৌড়ে ওরা অতঃপর ঢুকে পড়েছিল কালো অ্যামেরিকানদের এলাকায়।
সেবারই শেষ, এরপর সেই কিশোরীদ্বয়কে আর জীবিত দেখা যায়নি।
পরদিন সকালে ওদের মৃতদেহ খুঁজে পাওয়া যায় পার্শ্ববর্তি এক পরিত্যক্ত পুকুরে, আততায়ী লৌহদণ্ড দিয়ে নির্মমভাবে পিটিয়ে গুড়িয়ে দিয়েছে ওদের নরম করোটি।
এ ঘটনার কয় ঘণ্টার মধ্যেই পুলিশ এসে জর্জ স্টিনিকে বাসা হতে উঠিয়ে নিয়ে যায়। বিচার শুরু হবার আগ পর্যন্ত স্টিনিকে তার পরিবারের সদস্যদের সাথে আর দেখা করতে দেয়া হয়নি।
স্টিনিকে গ্রেপ্তারের পরপরই স্থানীয় মিলের চাকরীটি থেকে তার বাবাকে ছাটাই করা হয়। হুমকি আসে জর্জের মামলা নিয়ে বাড়াবাড়ি করলে পরিনতি আরো খারাপ হবে।
পরিস্থিতি বেগতিক দেখে জর্জের পরিবার চুপ মেরে যায়। শোনা যায় কেবলমাত্র একটি আইসক্রিমের লোভ দেখিয়েই পুলিশ জর্জকে রাজি করিয়ে ফেলে জবানবন্দীতে সাক্ষর করার জন্য।
মাত্র দশ পয়সার আইসক্রিমের বিনিময়ে কিশোর স্টিনির জীবনের বাকি সময়টুকু কিনে নিলেন ক্যারোলিনা ষ্টেটের শ্বেতাঙ্গ জেলার।
ঠিক পুরোটা নয়, আরো কিছুদিন স্টিনি সময় পেল আনুষ্ঠানিকতা পূরণ হবার জন্য। অতঃপর শ্বেতাঙ্গ কিশোরীদ্বয়ের হত্যাকাণ্ডের প্রায় চুরাশি দিন পর স্টিনিকে ইলেকট্রিক চেয়ারে বসিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়।
পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চি উচ্চতা আর চল্লিশ কেজি ওজনের জর্জ স্টিনির জন্য ক্যারোলিনা জেলের ইলেকট্রিক চেয়ারটি একটু বড়ই হয়ে গিয়েছিল। জেলার সাহেব অনেক চেষ্টা করেও প্রমান সাইজের ক্যাপ, বেল্ট আর ইলেক্ট্রোডগুলো স্টিনির শরীরে যথাযথভাবে বসাতে পারছিলেননা।
প্রথম প্রচেষ্টায় ইলেকট্রিক চেয়ার ঠিকঠাক কাজ না করলে স্টিনি আঁচ করে ফেললো কি ঘটতে যাচ্ছে। অসহায় কিশোর তখন অশ্রুসজল চোখে জেলারের দিকে তাকাচ্ছিল। ব্যস্ত জেলারের তখন সেদিকে দিকপাত করার সময় কোথায়!
দ্বিতীয়বার ইলেকট্রিক চেয়ার আর ঝামেলা করলোনা।
পরপর দুটি প্রবল বৈদ্যুতিক ঝাপটাতেই প্রাণবায়ু বের হয়ে গেল স্টিনির।
আর সাথে সাথেই চৌদ্দ বছর বয়সী জর্জ স্টিনি ঢুকে পড়লো ইতিহাসের পাতায়, হয়ে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে সবচেয়ে কমবয়সী মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত আসামি।
স্টিনির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার প্রায় সত্তর বছর পর আবার তার এই মৃত্যুদণ্ড নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে।
জর্জ ফ্রিয়েরসন নামের একজন মার্কিন নাগরিক আদালতে আবেদন করেছেন যাতে স্টিনির মৃত্যুদণ্ড সংক্রান্ত মামলাটি আবার চালু করা হয়।
জর্জ স্টিনির গ্রামেই জন্ম নেয়া এই সমাজকর্মী জর্জ ফ্রিয়েরসনের এমন পুরনো কাসুন্দি ঘাটা দেখে অনেকে ভ্রূ কুচকাচ্ছেন।
তবে জর্জ ফ্রিয়েরসন তাতে খুব একটা পরোয়া করছেননা। তার মতে জর্জ (স্টিনি) কে তো আর ফিরিয়ে আনা যাবেনা জানা কথা, এই মামলা পুনরায় চালু করে তাকে অন্তত নির্দোষ ঘোষণা করা হোক।
আপীলকারী জর্জ ফ্রিয়েরসন যতই চেষ্টা করুকনা কেন কাজটি কিন্তু মোটেও সহজ হবেনা। ক্যারোলিনা ষ্টেটের আদালত পূর্বে নিষ্পত্তি হয়ে যাওয়া কোন মামলা পুনর্বিবেচনার জন্য চালু করাটাকে কখনোই উৎসাহিত করেনা।
এর চাইতেও বড় সমস্যা, স্টিনির বিচারকার্যে ব্যবহৃত তৎকালীন নথিপত্রের কিছুই আর অবশিষ্ট নেই, তার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হবার পরপরই মামলার যাবতীয় নথিপত্র ধ্বংস করে ফেলা হয়।
ফ্রিয়েরসনের হাতে যদি কিছু থেকে থাকে তবে সেটি হচ্ছে স্টিনি’র বোন অ্যামির হাতে লেখা কিছু নোট। তবে আইনজ্ঞরা মনে করছেন- এতো পুরনো মামলা পুনরায় চালু করার জন্য অ্যামির নোটগুলো খুব বেশি কার্যকর হবেনা।
জর্জ স্টিনির মামলা পুনরায় চালু করা নিয়ে মূলত দুভাগ হয়ে গেছে অ্যামেরিকা। আফ্রিকান বংশোদ্ভূত প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার প্রশাসনকেও এক্ষেত্রে খুব বেশি সহানুভূতিশীল বলে মনে হচ্ছেনা।
স্টিনির মৃত্যু, কিংবদন্তী ম্যান্ডেলার আত্মত্যাগ কিংবা লুথার কিংদের প্রতিরোধ- এতো কিছুর পরও কিন্তু পরিস্থিতি আজো খুব একটা পাল্টায়নি।
এখনও নিরস্ত্র কৃষ্ণাঙ্গ কিশোর ট্রেভন মারটিনদের গুলি করে মেরে ফেললেও শ্বেতাঙ্গ অ্যামেরিকান জর্জ জিমারম্যানদের কোন সাজা পেতে হয়না।
নেলসন ম্যান্ডেলা চলে গেছেন। তার অনুপস্থিতিতে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসে (এএনসি) আবার শোনা যাচ্ছে ভাঙ্গনের সুর, মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে বর্ণবৈষম্যের সুর আবার।
তবুও, জর্জ ফ্রিয়েরসনের মত মানুষগুলো যতদিন পৃথিবীর বুকে শ্বাস নেবেন, দূর দ্বীপের বাতিঘরটির মত করেই শোষণমুক্ত পৃথিবীর স্বপ্নটি ঠিকই জ্বলে রইবে, মানুষের হৃদয়ে ...
সুত্রঃ http://en.wikipedia.org/wiki/George_Stinney
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।