জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদ্যার্থীরা আন্দোলন করছেন, বেহাত হয়ে যাওয়া তাঁদের হলগুলো পুনরুদ্ধারের জন্য। ‘হল’ নামের এগুলো আসলে পুরোনো বাড়ি। জগন্নাথ কলেজের শিক্ষার্থীরা সেখানে একসময় হোস্টেলের মতো থাকতেন। এখন ছাত্রছাত্রীরা আন্দোলন করছেন সেগুলো উদ্ধার করার জন্য। উদ্যোগটি ভালো।
কিন্তু উদ্ধার করার পর সেটা কি আবার হয়ে যাবে হোস্টেল বা হল? ছাত্র বা শিক্ষকদের আবাসস্থলে পরিণত করা হবে সেটা, নাকি একাডেমিক ভবন হবে?
বিশ্ববিদ্যার আলয় হলো বিশ্ববিদ্যালয়—এ কথা সর্বজনবিদিত। বিশ্ববিদ্যালয়ে বিশ্বজ্ঞানের চর্চা ও প্রসার হবে এবং হতেই থাকবে। এর জন্য চাই অনুশীলন ও চর্চার কেন্দ্রের সম্প্রসারণ। পাশ্চাত্যে ‘স্কুল অব থট’ এক কেন্দ্র থেকে আরেক কেন্দ্রে পরিশীলিত হয়ে বিকশিত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোও ছিল এর বাতিঘর।
আমাদের দেশে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বিশ্ববিদ্যাচর্চা খুব যে অবহেলিত (যেমনটি হরহামেশা বলা হয়) তা নয়। তবে এখানে বিশ্ববিদ্যার নবতম ধারাসমূহের চর্চার ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যায় না, সূচনাটা করা যায় মাত্র। এর একটি প্রধান কারণ আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিশ্ববিদ্যাচর্চাকেন্দ্রের বদলে পরিণত হচ্ছে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপদ আবাসস্থলে। সরকারের অর্থায়নে পরিচালিত দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে এ কথা বলা চলে। পাশ্চাত্যে নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্তদের অনেকেই থাকেন কোন না-কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে গবেষণা ও অধ্যাপনাসূত্রে সংশ্লিষ্ট।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো নোবেল পুরস্কার অর্জনের মতো গবেষণার সূতিকাগার হতে পারছে না।
১৯২১ সালে প্রতিষ্ঠিত দেশের প্রথম বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরম্ভ করে যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক অবকাঠামো ও পরিচালনার দিকে লক্ষ করলে দেখা যাবে, সেখানের মোট ভূমির সিংহভাগ ব্যয় হয়েছে শিক্ষা ভবন বা একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের জন্য নয়, ছাত্রছাত্রী-শিক্ষক-কর্মচারীর আবাসন খাতে। এর পরও ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-কর্মচারীদের প্রধান দাবি, স্ব-স্ব আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য, একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণ নয়। ছাত্রসংগঠনগুলোও হল নির্মাণের দাবিতে যতটা সোচ্চার, একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের দাবিতে ততটা অনড় নয়। ফলে আগামী ৫০ বছর পর আমাদের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি পরিপূর্ণভাবে আবাসিক এলাকায় পরিণত হয়, তাহলে অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই ধরা যাক: এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামূল্যবান ভূমি এখন ব্যবহূত হচ্ছে শিক্ষকদের আবাসিক ভবন ও ছাত্রছাত্রীদের আবাসিক হল নির্মাণে। কর্মচারীরা পিছিয়ে থাকবেন কেন? তাঁদের আবাসনের জন্যও নির্মিত হয়েছে এবং হচ্ছে আবাসিক ভবনগুলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ৬০ শতাংশ ভূমি এখন আবাসিক এলাকা, ২৫ শতাংশ অঞ্চল রাস্তা ও প্রশাসনিক ভবনের আওতায়। আর মাত্র ১৫ শতাংশ ভূমি শিক্ষা ভবন বা একাডেমিক বিল্ডিংয়ের অধীনে।
কর্তৃপক্ষ ছাত্রছাত্রীদের হল ও শিক্ষক-কর্মচারীদের জন্য আবাসিক ভবন নির্মাণের জন্য যতটা চাপে থাকে, একাডেমিক বিল্ডিং নির্মাণের জন্য ঠিক ততটাই চাপমুক্ত।
‘আবাসিক ভবন’ নির্মাণের জন্য প্রশাসনের ওপর চাপ প্রয়োগের ক্ষেত্রে শিক্ষক সমিতি বা কর্মচারী-কর্মকর্তা সমিতি এমনকি ছাত্রসংগঠনগুলোর চিন্তার কোনো পার্থক্য নেই। পার্থক্য এখানেই, তারা শুধু নিজেরা নিজেদের আবাসিক ভবন তৈরি করতে বলে। যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামাজিক বিজ্ঞান ভবন দীর্ঘ ছয় বছরেও সম্পূর্ণতা পেল না। কবে সেটা শেষ হবে—কে জানে! কলাভবনের মূল পরিকল্পনার ব্যত্যয় ঘটিয়ে কিছু বিভাগ যথেচ্ছভাবে সম্প্রসারণ করে চলেছে। এ ক্ষেত্রে তাদের বক্তব্য, ভবন সম্প্রসারণের অর্থ যেহেতু তারা বাইরের দাতাদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে, সেহেতু নিজেদের প্রয়োজনমতো তারা সম্প্রসারণকাজ করছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর থেকে আজ অবধি বিশ্ববিদ্যায়তনের অনেক নতুন শাখা অধ্যয়নের সুযোগ করে দিয়েছে, খোলা হয়েছে নতুন নতুন বিভাগ। কিন্তু সেই বিভাগগুলোতে নেই শিক্ষা ও গবেষণার উপযুক্ত ভৌত কাঠামো। নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ, সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগ, জিন-প্রকৌশল ও জীবপ্রযুক্তি বিভাগ কিংবা সেন্টার ফর জেনোসাইড স্টাডিজ, বায়োটেকনোলজি রিসার্চ সেন্টার, ব্যবসায় গবেষণা ব্যুরো, অর্গানিক পল্যুট্যান্টস গবেষণাকেন্দ্র ইত্যাদির মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিভাগ ও কেন্দ্র সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে খোলা হলেও এসব ক্ষেত্রে আধুনিক পঠন-পাঠনের শিক্ষা-পরিবেশ সৃষ্টির জন্য যে ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ করা প্রয়োজন, কর্তৃপক্ষ সেদিকে নজর দিতে পারছে না। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নিগ্ধ-নৈসর্গিক পরিবেশ ধ্বংস করে উঠছে একের পর এক হল ও শিক্ষক-কর্মচারীর আবাসন। প্রতিষ্ঠার প্রায় ৪০ বছর পর সেখানে রাস্তার ওপর একটি ‘কলা ভবন’ (অনেকে নাকি ঠাট্টা করে ‘কলার ভবন’ বলে) নির্মিত হয়েছে—যেটি অন্ধকারাচ্ছন্ন এবং যেখানে স্থাপত্য-মনোযোগ ও নান্দনিকতার কোনো ছাপ নেই।
কিছুদিন পর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিও আবাসিক ভবনে ছেয়ে যাবে হয়তো; থাকবে এর ফাঁকে ফাঁকে এক-দুটি একাডেমিক বিল্ডিং!
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলগুলোতে এখন প্রথম সেমিস্টারের ছাত্রীদের আসন দেওয়া সম্ভব হয় না। ফলে তাঁরা ভাড়া বাসায় বা বাইরের হোস্টেলে থাকেন। ছাত্ররাও প্রথম বর্ষে হলে আসন বরাদ্দ পান না। বলা চলে, প্রথম বর্ষের নবীন শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে (যখন তাঁদের জন্য সাহায্যের অতীব প্রয়োজন) হলব্যবস্থা এখন সম্পূর্ণ ব্যর্থ। বরং বলা চলে, ‘ছাত্ররাজনীতি’র তুরুপের তাস হিসেবে সিট-বাণিজ্য ছাত্রনেতাদের বিপথে নিয়ে যাচ্ছে এবং হত্যা ও আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে মারামারিতে কলুষিত করছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা-পরিবেশ।
শিক্ষকদের জন্যও আবাসনব্যবস্থা একটি লোভনীয় টোপ। শিক্ষক-রাজনীতি অনেকটাই এই টোপ দিয়ে নিয়ন্ত্রিত। অথচ, শিক্ষক পদে চাকরি বা ছাত্রভর্তির বিজ্ঞাপন কোথাও শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর আবাসনের দায়িত্ব বিশ্ববিদ্যালয় নেবে, এ কথা উল্লেখ থাকে না। তাহলে কেন আজও প্রতিনিয়ত বিশ্ববিদ্যালয়ের মহামূল্যবান ভূমি নাশ করে শিক্ষাঙ্গনে গড়ে উঠছে আবাসিক ভবন? এভাবে ভূমি নাশ করে নির্বিচারে আবাসিক ভবন নির্মিত হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অতি দ্রুতই কি তার প্রকৃত চরিত্র হারাবে না?
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আশু প্রয়োজন হলো, এখনই বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যেকোনো রকমের আবাসিক ভবন নির্মাণ বন্ধের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এ-প্রক্রিয়া আরম্ভ হতে পারে।
চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ও হতে পারে এই প্রক্রিয়ার পথিকৃৎ। আর তাই বেহাত হওয়া ভবনগুলো উদ্ধার করার পর জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সেখানে চালাতে পারে একাডেমিক কার্যক্রম।
সৌমিত্র শেখর: অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
scpcdu@gmail.com।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।