আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে মেধাশূন্য, আওয়ামীপন্থী ভিসি, শিক্ষকদের দুর্নীতি ও দলবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে।

"যখন তুমি এসেছিলে ভবে, কেঁদে ছিলে তুমি-হেসেছিলো সবে। এমন জীবন তুমি করিবে গঠন, মরনে হাসিবে তুমি-কাঁদিবে ভূবন। "......... মন্তব্য প্রতিবেদন : পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বব্যাপী নৈরাজ্য মাহমুদুর রহমান বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বর্তমানে মেধাশূন্য, আওয়ামীপন্থী ভিসি, শিক্ষকদের দুর্নীতি ও দলবাজির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। আমি বুয়েট এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, উভয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র ছিলাম। বুয়েটের কথাই আগে বলি—কারণ সেখানে শেখ হাসিনার বর্তমান মেয়াদের আগে কখনও রাজনীতির অনুপ্রবেশ ঘটেনি।

আমাদের ছাত্রাবস্থায় বুয়েটের শিক্ষকরা কে কোন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী, এই খোঁজ-খবর নেয়ার চিন্তা কস্মিনকালেও মনে ঠাঁই পায়নি। সেই পাকিস্তানি আমল থেকে সেখানে ভিসি নিয়োগ সর্বদাই যোগ্যতা ও জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে হওয়াটাই প্রথা ছিল। ড. রশীদ, ড. নাসের, ড. মোশাররফ হোসেন, ড. মতিন পাটওয়ারী, ড. ইকবাল মাহমুদ, ড. মো. শাহজাহান এবং সর্বশেষ ড. সফিউল্লাহর মতো অসাধারণ বিদ্বান শিক্ষকরা যে চেয়ারে বসেছেন, সেখানে শেখ হাসিনা কেবল দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দিয়েছেন ড. নজরুল ইসলামকে। এই ভদ্রলোক দীর্ঘদিন ধরে সরাসরি আওয়ামী রাজনীতিতে সম্পৃক্ত এবং তিনি সরকারপন্থী পেশাজীবী সংগঠনের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট। এই সংগঠনটির সভাপতি পদে আছেন সাংবাদিক নেতা ইকবাল সোবহান চৌধুরী।

অনেক পাঠকই অবগত আছেন, আমি নিজেও এ ধরনের রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনাবিশিষ্ট পেশাজীবী সংগঠনের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত। জাতীয়তাবাদী রাজনীতিতে বিশ্বাসী প্রকৌশলীদের সংগঠন, অ্যাসোসিয়েশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (AEB) এবং জাতীয়তাবাদী পেশাজীবীদের শীর্ষ সংগঠন, বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী পরিষদ, উভয়ের আহ্বায়কের দায়িত্ব দীর্ঘদিন ধরে পালন করছি। কিন্তু আমার মতো একজন বেসরকারি নাগরিক এবং বুয়েটের ভিসির অবস্থান ও সম্মান কোনোক্রমেই তুলনীয় নয়। তাকে অবশ্যই দলীয় চিন্তা-চেতনার ঊর্ধ্বে থেকে বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান শিক্ষকের মহান দায়িত্ব পালন করতে হবে। সে কারণেই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকবৃন্দসহ দেশের সচেতন নাগরিকরা আশা করেছিলেন যে, ভিসি নিযুক্ত হওয়ার পর অন্তত ড. নজরুল ইসলাম সরকারদলীয় পেশাজীবী সংগঠন থেকে পদত্যাগ করবেন।

দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, বুয়েটের মতো প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা রক্ষার চেয়ে বর্তমান ভিসি দলীয় লেজুড়বৃত্তিকে ঊর্ধ্বে স্থান দিয়েছেন। আওয়ামীপন্থী বাংলাদেশ সম্মিলিত পেশাজীবী সমন্বয় পরিষদের পদ রক্ষা করে তিনি কেবল দলীয় সভায় উপস্থিত থাকেননি—উপরন্তু, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পাশে মঞ্চে আসন গ্রহণ করেছেন। বুয়েটের ইতিহাসে কোনো ভিসির এ ধরনের দলীয় সভায় অংশগ্রহণের নজির নেই। এহেন ভিসির আমলে ঐতিহ্যবাহী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বুয়েটের যে হাল হওয়ার কথা ছিল, তাই হয়েছে। তিনি কয়েক ডজন সিনিয়র শিক্ষককে ডিঙিয়ে নজিরবিহীনভাবে বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী পরিষদের সভাপতি ড. হাবিবুর রহমানকে বুয়েটের প্রো-ভিসি পদে নিয়োগ দিয়েছেন এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের কেনাকাটা ও নিয়োগে ছাত্রলীগের একচ্ছত্র টেণ্ডারবাজি কায়েম করেছেন।

এমন দুর্ভাগ্যজনক অভিযোগও শুনতে পাচ্ছি—শিক্ষক নিয়োগ ও পরীক্ষায় নম্বর দেয়া নিয়েও নাকি রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য পাচ্ছে। সেখানকার সংখ্যাগরিষ্ঠ দলনিরপেক্ষ শিক্ষকদের অব্যাহত প্রতিবাদ সত্ত্বেও এই অনাচার অব্যাহত থাকায় শেষ পর্যন্ত তারা ধর্মঘটে যেতেও বাধ্য হয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ধর্মঘটী শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে সমস্যা সমাধানে আশ্বাস প্রদান করায় শিক্ষকরা ক্লাস রুমে ফিরে গেলেও ভিসি ড. নজরুল ইসলামের প্রশাসনে এখন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন আসেনি। বুয়েটের মহান ঐতিহ্য রক্ষায় দলনিরপেক্ষ আদর্শবান শিক্ষকদের আবারও হয়তো আন্দোলনে ফিরে যেতে হবে। ড. নজরুল দীর্ঘদিন ধরে আইইবি রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থাকায় তার সঙ্গে ব্যক্তিগত পরিচয়ের সুযোগ হয়েছে।

তিনি আইইবি ঢাকা সেন্টার এবং কেন্দ্রের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। গত বছর সৌদি বাদশাহর আমন্ত্রণে একসঙ্গে পবিত্র হজও পালন করেছি। তার চরিত্রানুযায়ী দলীয় বিবেচনার ঊর্ধ্বে ওঠার শক্তি ড. নজরুল ইসলাম কোনোদিনই অর্জন করতে সক্ষম হবেন না বলেই আমার ধারণা। সুতরাং বুয়েটের অধঃপতনের জন্য তার তুলনায় তাকে যারা ভিসির অত্যন্ত উচ্চ ও সম্মানিত পদে নিয়োগ প্রদান করেছেন, তাদেরকেই অধিকতর দোষী সাব্যস্ত করতে হবে। বুয়েটের একজন প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আমি শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদ এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বুয়েটকে দলীয়করণের উদগ্র ও অসুস্থ আকাঙ্ক্ষাকেই সার্বিক বিপর্যয়কর অবস্থার জন্য দায়ী করে নিন্দা জানাচ্ছি।

ঢাকার অদূরে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে আর একজন দলবাজ উপাচার্য ড. শরীফ এনামুল কবির ছাত্রলীগের পাণ্ডাদের একাংশকে ব্যবহার করে বিশ্ববিদ্যালয়ে এমনই ধ্বংসাত্মক অবস্থার সৃষ্টি করেছেন যে, অন্যান্য ছাত্র-শিক্ষক তো বটেই এমনকি আওয়ামীপন্থী শিক্ষকদের এক বিরাট অংশ পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে আন্দোলনে যেতে বাধ্য হয়েছেন। দীর্ঘদিন ঘেরাও, বিক্ষোভ, গণঅনশন, ভাংচুর, হাতাহাতি ইত্যাদি চলার পর আবারও প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপে পরিস্থিতি সাময়িকভাবে নিয়ন্ত্রণে এসেছে। পত্রিকার সংবাদ অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রী নাকি ভিসিকে শিগগিরই তার পদ থেকে সরানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলন প্রসঙ্গে আর একটি কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার উল্লেখ না করে পারছি না। সেখানকার আন্দোলনরত ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সাংস্কৃতিক কর্মীদের অনশন ভাঙিয়ে এসেছেন আওয়ামী লীগের ফতুল্লা আসনের সংসদ সদস্য, এ দেশের চলচ্চিত্রে এক সময়ের জনপ্রিয় নায়িকা কবরী।

এই প্রবীণ অভিনেত্রীর লেখাপড়া কতদূর এবং তিনি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন, এই তথ্য আমার জানা নেই। লোকমুখে শুনেছি, তিনি নাকি স্কুলের গণ্ডিও পার হননি। কেবল নায়িকা হওয়ার সুবাদে দেশের অন্যতম শীর্ষ বিদ্যাপীঠে তার আগমন যথেষ্ট কৌতুকের সৃষ্টি করেছে। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি দলবাজিতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদ্বয়ের সঙ্গে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতায় অবতীর্ণ হয়েছেন। খুলনা প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সভাপতি মন্তব্য করেছেন, এই বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থা বুয়েট এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের চেয়েও খারাপ।

দীর্ঘদিন ধরে শিক্ষক আন্দোলনে সেখানে কর্মবিরতি চললেও ভিসি ড. মুহাম্মদ আলমগীর বহাল তবিয়তে আছেন। কুয়েটে শিক্ষক-ছাত্ররা একবাক্যে বলেছেন যে, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনে আগে কখনও রাজনীতি না থাকলেও ড. আলমগীর সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতি আমদানি করে পুরো বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিস্থিতিকে কলুষিত করেছেন। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি প্রফেসর এম আবদুস সোবহান। ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি ভিসি হিসেবে নিয়োগ পাওয়ার পর থেকে বিগত প্রায় সাড়ে তিন বছরে স্বৈরতান্ত্রিক কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালিত হচ্ছে। ছাত্রলীগের বেপরোয়া চাঁদাবাজি, ছাত্র হত্যা, গণগ্রেফতার, নিয়োগ বাণিজ্য, ছাত্রছাত্রী এবং শিক্ষক লাঞ্ছনা, সাংবাদিক নির্যাতন, ভিন্নমত হয়রানিসহ এমন কোনো অপকর্ম নেই, যা এই সময়ের মধ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ঘটেনি।

বাংলাদেশের অন্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও একই প্রকার নোংরা রাজনীতিকরণের মাধ্যমে শিক্ষার পরিবেশকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। আদালতকে ব্যবহার করে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের ৮২১ জন শিক্ষক-কর্মকর্তা-কর্মচারীকে চাকরিচ্যুত করে ক্ষমতাসীনরা আক্রোশ মিটিয়েছে। একই রকম দলীয়করণের মহোত্সব চলছে সিলেটের শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানেও যে কোনো মুহূর্তে শিক্ষক আন্দোলন বেগবান হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কর্মকাণ্ড বন্ধ হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিন্নমত দমনে ফ্যাসিবাদী কায়দায় প্রশাসন চালানো হচ্ছে।

মহাজোট সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়েই শিক্ষক নিয়োগে মেধাবীদের আর কোনো জায়গা নেই। প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শুধু দলীয় বিবেচনায় অযোগ্য শিক্ষকদের নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এমনকি পদ না থাকলেও ছাত্রলীগ কর্মীদের চাকরি দেয়ার উত্সাহে দ্বিগুণ শিক্ষক নিয়োগ দিতেও সরকারের বাধছে না। গত আড়াই বছরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ৩০টি বিভাগের বিজ্ঞাপিত ১১৭টি পদের বিপরীতে সম্পূর্ণ দলীয় বিবেচনায় ২০৭ জন শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। আরও শ’খানেক শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়া চালাচ্ছেন বঙ্গবন্ধু পরিষদ সভাপতি এবং ভিসি আবদুস সোবহান।

এই বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাণ-রসায়ন বিভাগে ৪২ জন প্রার্থীর মধ্যে যোগ্যতায় সর্বনিম্ন দুটি স্থান অধিকারী অর্থাত্ ৪১ ও ৪২ নম্বরের আবদুর রাকিব ও রওশানুল হাবিবকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে। ফার্মেসি বিভাগে ১৪ জন আবেদনকারীর মধ্যে ১১তম অবস্থানে থাকা আবদুল মুহিত চাকরি পেয়েছেন। ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যায় চাকরি পেয়েছেন একই বিভাগের আওয়ামীপন্থী প্রভাবশালী শিক্ষক জহুরুল ইসলামের প্রাইমারি স্কুল শিক্ষিকা স্ত্রী জেবুননেছা ইসলাম। শ্রেণীকক্ষে শিক্ষা প্রদানে তার অযোগ্যতার গল্প বিশ্ববিদ্যালয়ে হাসির খোরাক জোগাচ্ছে। এছাড়া একই বিভাগে দ্বিতীয় বিভাগধারী মনোজ কুমারকে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

এই চরম অনিয়মের বিষয়ে অনার্স ও মাস্টার্সে যথাক্রমে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং প্রথম শ্রেণীতে দ্বিতীয় স্থান লাভকারী শারমীন লীনা ইউনিভার্সিটি গ্রান্টস কমিশনে (ইউজিসি) লিখিত অভিযোগ করলেও আজ পর্যন্ত তদন্তের কোনো অগ্রগতি হয়নি। রসায়ন, মনোবিজ্ঞান, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন ও বিচার, ফোকলোর, সমাজ বিজ্ঞান, ব্যবস্থাপনা, অর্থনীতি, মার্কেটিং এবং পদার্থ বিজ্ঞানসহ অন্যান্য বিভাগেও শিক্ষক নিয়োগে একইভাবে প্রথম শ্রেণীতে উচ্চস্থান অধিকারীদের বঞ্চিত করে দলীয় বিবেচনায় মেধাতালিকার তলানিতে অবস্থানকারী চূড়ান্ত অযোগ্যদের অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছে। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার মানের ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। অবশ্য শিক্ষক নিয়োগে এই অনিয়ম যে কেবল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে করা হয়েছে, তা নয়। বর্তমান সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর থেকে দেশের প্রতিটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একই পরিস্থিতি বিরাজ করছে।

সব বিশ্ববিদ্যালয়ের কাহিনী বর্ণনা করতে গেলে লেখার কলেবর বৃদ্ধি পেয়ে পাঠকের বিরক্তি উত্পাদন করবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকটি উদাহরণ টেনেই শিক্ষক নিয়োগ বিষয়ে আলোচনার সমাপ্তি টানব। চারুকলা বিভাগে সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তকে বঞ্চিত করে নিয়োগ দেয়া হয়েছে এসএসসি ও এইচএসসিতে দ্বিতীয় বিভাগপ্রাপ্ত এবং পাসকোর্সে ডিগ্রি ও প্রিলিমিনারি মাস্টার্স পাস নাসিমুল কবির ও নাসিমা হককে। ড্রয়িং ও পেইন্টিং বিভাগে তালিকার ১ থেকে ৬ পর্যন্ত সব পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তদের পরিবর্তে শিক্ষক হয়েছেন তিনটি দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত ছাত্রলীগের সাবেক অনুষদ সভাপতি দুলাল চন্দ্র গাইন। দুলাল বাবু সিলেকশন কমিটির তালিকার ৩৫ জনের মধ্যে ৩৩ নম্বর প্রার্থী ছিলেন।

ইসলামের ইতিহাস বিভাগে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তদের বাদ দিয়ে চাকরি দেয়া হয়েছে অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৩২তম স্থান পাওয়া আবদুল রহীমকে, পালি ও বুদ্ধিস্ট স্টাডিজে নিয়োগ পেয়েছেন অনার্সে মাত্র ৪৬ শতাংশ নম্বর পাওয়া নীরু বড়ুয়া। অবশ্য তার প্রধান যোগ্যতা হলো তিনি একই বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক বিমান চন্দ্র বড়ুয়ার স্ত্রী। পদার্থ বিজ্ঞানে বিজ্ঞাপনের শর্ত লঙ্ঘন করে সহযোগী অধ্যাপক পদে নিয়োগ দেয়া হয়েছে স্বপন কুমার ঘোষকে। শিক্ষা ও গবেষণা ইন্সটিটিউটে প্রথম শ্রেণীপ্রাপ্তদের হটিয়ে চাকরি পেয়েছেন অনার্সে দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত তাপস কুমার বিশ্বাস ও দেবদাস হালদার। এই ইন্সটিটিউটে ১১ জনকেই দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে।

গোপালগঞ্জের আশরাফ সাদেক, কুমিল্লার এক কলেজের সাবেক ছাত্রলীগ নেতা শাহরিয়ার হায়দার, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির দায়ে ইন্সটিটিউট থেকে একদা বহিষ্কৃত ছাত্রলীগ নেতা মাহবুব রহমান এবং প্রয়াত অধ্যাপক হুমায়ুন আজাদের আত্মীয় পরিচয়ে সুমেরা আহসান পুরোপুরি দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পেয়েছেন। এছাড়া প্রায় প্রতিটি বিভাগে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম এবং দ্বিতীয় স্থান অধিকারীদের নির্লজ্জভাবে বঞ্চিত রেখে দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ দেয়া হয়েছে মেধা তালিকায় অনেক নিচের স্থান অধিকারীদের। এসব নিয়োগের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বিবেকসম্পন্ন সিনিয়র অধ্যাপক আপত্তি জানিয়ে ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দিলেও সেগুলোকে উপেক্ষা করা হয়েছে। অবশ্য যে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি নিজেই প্রায় সব পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত, তার মেধাবীদের প্রতি এক প্রকার ঈর্ষাপ্রসূত বিদ্বেষ থাকাটাই স্বাভাবিক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান ভিসি টেলিভিশনের অতি চেনা মুখ, বিশিষ্ট আওয়ামী ‘বুদ্ধিজীবী’ ড. আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক।

বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার বাইরে বিটিভিসহ সব টিভি চ্যানেলে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে তিনি অহরহ জাতিকে জ্ঞান বিতরণ করে চলেছেন। এই বিশিষ্ট সুশীল (?) বুদ্ধিজীবীর শিক্ষাগত যোগ্যতার দিকে খানিক দৃষ্টিপাত করা যাক। ভদ্রলোক ১৯৬৯ সালে অর্থাত্ আমাদের সঙ্গেই এসএসসি পাস করেছিলেন। সেই পরীক্ষায় খুলনার এক স্কুল থেকে তিনি দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিলেন। ১৯৭২ সালে প্রকাশ্যে বই খুলে গণটোকাটুকির এইচএসসি পরীক্ষায় অবশ্য তার একটি প্রথম বিভাগ রয়েছে।

এসএসসি এবং এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়ার সুযোগ না পেয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি ঢাকা কলেজ থেকে পাসকোর্সে বিএসসি পাস করেন ১৯৭৫ সালে। রেজাল্ট সেই দ্বিতীয় বিভাগ। ১৯৭৬ সালে প্রিলিমিনারিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগ থেকে আবারও দ্বিতীয় শ্রেণীপ্রাপ্ত হন এবং শেষাবধি ওই দ্বিতীয় শ্রেণীতেই মাস্টার্স শেষ করেন ১৯৭৮ সালে। ১৯৮৫ সালে পিএইচডি করেছেন সব আওয়ামীর তীর্থভূমি ভারতের মহিশূর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। এহেন দিকপাল চাকরি জীবন আরম্ভ করেছিলেন বুয়েটে PIO (Publication Information Officer) পদে।

বঙ্গবন্ধুর ‘একনিষ্ঠ সৈনিক’ বিস্ময়করভাবে জেনারেল জিয়াউর রহমানের আমলে ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগে লেকচারার পদে নিয়োগ পান। সেই সময় তার রাজনৈতিক চিন্তা-চেতনা কোন দিকে ছিল, সেই প্রশ্ন উত্থাপিত হলে আশা করি, ভিসি মহোদয় মনে কষ্ট পাবেন না। ১৯৭২ সালে গণটোকাটুকির সুযোগ না পেলে যে ব্যক্তির জীবনে কোনো পরীক্ষায় প্রথম বিভাগ পাওয়ার সৌভাগ্য হতো না, তাকে শেখ হাসিনা ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি বানিয়েছেন। ভাগাভাগি সংক্রান্ত বিবাদে সম্প্রতি আওয়ামী শিক্ষক ক্যাডার এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির সাধারণ সম্পাদক, অধ্যাপক ওহিদুজ্জামান চাঁন ভিসি প্যানেল নির্বাচনের জন্য উচ্চ আদালতে মামলা ঠুকে দিয়েছেন। উচ্চ আদালত থেকে এ ব্যাপারে রুলও ইস্যু করা হয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের দলনিরপেক্ষ ও বিএনপিপন্থী সাদা দলের শিক্ষকরাসহ দেশের আমজনতা সরকারি দলের এই গৃহবিবাদ ভালোই উপভোগ করছেন। দেশের তাবত্ পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অযোগ্যদের শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিয়ে আমাদের আগামী প্রজন্মকে শিক্ষায় দুর্বল করে সক্ষমতায় পিছিয়ে দেয়ার সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্রের দায়ভার বর্তমান সরকার বিশেষ করে শিক্ষামন্ত্রী নূরুল ইসলাম নাহিদকেই বহন করতে হবে। শিক্ষামন্ত্রী কেবল উচ্চ শিক্ষাতেই নৈরাজ্য সৃষ্টি করছেন না, বিগত তিন বছরে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাতেও আজগুবি ফলাফল বানিয়ে দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থাকেই মহাবিপর্যয়ের দিকে ঠেলে দিয়েছেন। বর্তমান মন্ত্রিসভার গুটিকয়েক সত্ ব্যক্তির মধ্যে শিক্ষামন্ত্রীর নামও বিভিন্ন স্থানে উচ্চারিত হয়ে থাকে। জেনারেল জিয়াউর রহমানের শাসনকাল এবং বেগম খালেদা জিয়ার প্রথম মেয়াদের মন্ত্রিসভা ব্যতীত স্বাধীন বাংলাদেশের ৪১ বছরের অসংখ্য মন্ত্রীর মধ্যে সত্ ব্যক্তির সংখ্যা নিতান্তই হাতে গোনা।

সেক্ষেত্রে আমাদের উচিত ছিল সাবেক বামনেতা নূরুল ইসলাম নাহিদকে সমর্থন ও সহযোগিতা করা। কিন্তু প্রশ্ন হলো, সততা কি কেবল টাকা-পয়সা না খাওয়া, নাকি নৈতিক সততা বলেও একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয় রয়েছে? শিক্ষামন্ত্রীর চোখের সামনে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দলবাজ অযোগ্য ভিসিরা উচ্চ শিক্ষার বারোটা বাজিয়ে চলেছেন, অথচ তিনি চোখ বুজে আছেন। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ইঙ্গিতে ও সহযোগিতায় বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে শিক্ষক নিয়োগের নামে সর্বত্র অর্ধশিক্ষিত ছাত্রলীগ নেতা-কর্মীর জন্য চাকরির বাজার খুলে দেশের শিক্ষার মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়া হচ্ছে। এদিকে এসএসসি ও এইচএসসিতে সৃজনশীল পদ্ধতিতে পরীক্ষার বাগাড়ম্বরে জিপিএ-৫ ও পাসের হারের উত্তরোত্তর যে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটানো হচ্ছে, তাতে মেধার প্রকৃত মূল্যায়ন হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এই সরকারের আমলে এ পর্যন্ত এসএসসির চারটি এবং এইচএসসির তিনটি পরীক্ষার ফল প্রকাশিত হয়েছে।

এই ফলাফলগুলো পর্যালোচনা করলেই যে কোনো সচেতন নাগরিক বুঝতে পারবেন আমাদের দেশপ্রেমবিবর্জিত বর্তমান সরকার জাতির জন্য কী ভয়ঙ্কর মরণ খেলায় অবতীর্ণ হয়েছে। পরীক্ষা পাসের হার ২০০৯ ২০১০ ২০১১ ২০১২ এসএসসি ৭০.৮৯ ৭৯.৯৮ ৮২.৩১ ৮৬.৩৭ এইচএসসি ৭২.৭৮ ৭৪.২৮ ৭৫.০৮ —— এসএসসি পরীক্ষার সর্বশেষ ফলাফলে মন্ত্রীর নিজ বিভাগ সিলেটে ৯১ শতাংশ পাস করার যে রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে, তার সত্যতা নিয়ে জনমনে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমার সহকর্মীদের মধ্যে অনেক সাংবাদিকই বৃহত্তর সিলেট জেলার অধিবাসী। সেই বিভাগের ছাত্রছাত্রীদের এই হঠাত্ মেধার বিস্ফোরণে তারাও বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে পড়েছেন। পরীক্ষায় নম্বর দেয়ার ক্ষেত্রে যে ডিজিটাল কারচুপির গুজব চারদিকে উত্থাপিত হচ্ছে, তাতে জনগণ অবস্থাদৃষ্টে বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছেন।

আগেই উল্লেখ করেছি আমি এসএসসি পাস করেছিলাম ১৯৬৯ সালে। যতদূর স্মরণে আছে সেই বছর ঢাকা বোর্ডে মাত্র ৬৪ জন স্টার এবং ১৪০০ জন প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হয়েছিল। আমাদের সবার মেধা বর্তমানের তুলনায় এতটাই নিম্নস্তরের ছিল মনে করলে লজ্জায় অধোবদন হয়ে পড়ি। সেই সময়কার স্টারকে যদি বর্তমান সময়ের জিপিএ-৫ প্রাপ্তি সমতুল্য মনে করি, তাহলে ঢাকা বোর্ডে এবারের পরীক্ষায় স্টারপ্রাপ্তদের সংখ্যা ২৫০০০ ছাড়িয়ে গেছে। আমাদের সময় ঢাকা কলেজ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ কলেজ হিসেবে বিবেচিত হতো।

১৯৬৯ সালের এসএসসিতে যারা ৭০ শতাংশ নম্বর পেয়েছিল, তারাই ঢাকা কলেজে ভর্তি হতে পেরেছিল। আজকে জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের বিপুল সংখ্যা বিচার করলে তাদের মধ্যে কতজন এখনকার ভালো কলেজগুলোতে ভর্তি হতে পারবেন সে প্রশ্ন এসেই যায়। জিপিএ-৫ প্রাপ্তরাও যদি তাদের পছন্দের কলেজে ভর্তি হতে না পারেন, তাহলে আর এই বিপুল নম্বর প্রাপ্তির সফলতা কোথায় রইল? নূরুল ইসলাম নাহিদের আমলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মে মনে হচ্ছে বর্তমান সরকারের মেয়াদের মধ্যেই তারা এসএসসিতে শতভাগ পাসের রেকর্ড গড়ে দেশবাসীকে তাক লাগিয়ে দিতে চান! এসএসসিতে পাসের হার এবং জিপিএ-৫ প্রাপ্তদের সংখ্যা প্রতি বছর অস্বাভাবিকভাবে বাড়িয়ে নূরুল ইসলাম নাহিদ এক নৈরাজ্যকর পরিস্থিতির জন্ম দিচ্ছেন। এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা কার স্বার্থে, সেটা শিক্ষামন্ত্রীই ভালো জানেন। তথাকথিত সৃজনশীল শিক্ষা পদ্ধতি যে প্রজন্মের জন্ম দিচ্ছে, তারা তীব্র প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে আন্তর্জাতিক সক্ষমতায় টিকে থাকতে পারবে কীনা, সেই আলোচনা আজ সর্বত্র।

শিক্ষামন্ত্রী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ধ্বংসের পাশাপাশি মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে যে ভারসাম্যহীন পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছেন, সেটাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিপর্যয়কর হিসেবেই বিবেচনা করি। আমি শিক্ষাবিদ নই, একজন কলামিস্ট ও সম্পাদক মাত্র। এই বিষয়ে কোনো চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত দেয়ার যোগ্যতাও আমার নেই। বাংলাদেশের সব প্রবীণ, স্বনামধন্য শিক্ষাবিদরা এত বড় তুঘলকীকাণ্ড দেখেও বিস্ময়কর নীরবতা অবলম্বন করায় কিছুটা হতাশাও বোধ করছি। বিরোধী দল থেকেও এ বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না।

কেবল অর্থকড়ির বিষয়ে সততা অবলম্বন না করে নূরুল ইসলাম নাহিদের প্রতি নৈতিক সততাও বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে এ সপ্তাহের লেখার ইতি টানছি। দেশের একজন নাগরিকের কর্তব্য বিবেচনা করেই আমার এই আহ্বান। আশা করি, শেষ পর্যন্ত শিক্ষামন্ত্রীর পরিণতিও সিলেট বিভাগেরই অপর সাবেক বাম নেতা, কালো বিড়ালখ্যাত সুরঞ্জিত বাবুর মতো হবে না। View this link ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.