আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি: পাঠ পর্যালোচনা ০১

অধ্যাপক আবুল বারাকাত বিষয়টা নিয়ে লিখেছেন আগেই, তারপর সেটা আরও পরিবর্ধিত হয়েছে বিভিন্ন সময়। পরিবর্ধিত রূপটি একটি ছোট বই আকারে বের হয়েছে ২৬ জুন ২০১২ সালে। মাত্র ৩০ টাকা দামের বইটি পড়তে শুরু করলে এক পর্যায়ে থমকে যেতে হয়, জানা যায় বর্তমানে বাংলাদেশে মৌলবাদের অর্থনীতির বার্ষিক নীট মুনাফা ২,০০০ কোটি টাকা (২৫০ মিলিয়ন ডলার)! এবং বিগত ৩৫ বছরে (১৯৭৫-২০১০) মৌলবাদের অর্থনীতি সৃষ্ট ক্রম পুঞ্জিভূত নীট মুনাফার মোট পরিমাণ হবে কমপক্ষে ৫০,০০০ কোটি টাকা! পাশাপাশি, বিকাশ-বিস্তৃতির সম্ভাবনা হিসেবে দেখা যায়- মৌলবাদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (বার্ষিক গড় ৭.৫% থেকে ৯) মূল স্রোতের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার (বার্ষিক গড় ৫% - ৬%) এর তুলনায় বেশি!
বইটির শুরুতে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি বোঝাতে কিছু যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেছেন লেখক। তারপর পূর্ব বাংলায় ইসলাম ধর্মের উদ্ভব নিয়ে আলোচনা করতে যেয়ে সেই উদ্ভব’কে উদারনৈতিক এবং মানবিক হিসেবে দেখে এই আলোচনা শেষ করেছেন এইভাবে, “এ দেশের মুসলমানেরা ঐতিহাসিকভাবেই এক পজিটিভ ডিএনএ-র বাহক। আমাদের দেশে ইসলাম ধর্মের এ পজিটিভ ডিএনএ-র কারণেই সশস্ত্র জঙ্গীত্ব ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সহায়ক হতে পারে না।

” পরবর্তী অংশটুকু’র আলোচনায় বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি কেন বিকশিত হল এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে যেয়ে তিনি সমকালীন পশ্চদপসারণ ও ক্রমবর্ধমান বৈষম্যের উপর আলোকপাত করেছেন। তাঁর এই আলোকপাতের কারণে আমরা গত চারদশকের একটা খেরোখাতা পেয়ে যাবো, পাশাপাশি পাবো ১৯৮৪ থেকে ২০২০ পর্যন্ত বাংলাদেশে আর্থ-সামাজিক শ্রেণীর গতি প্রবণতা’র একটা তুলনামূলক চিত্র। বাংলাদেশে মৌলবাদী অর্থনীতির বিস্তৃতি ও সম্ভাবনা’র উপর আলোকপাত করা হয়েছে পরবর্তী অংশে, তিনি সেখানে মৌলবাদের আর্থ-রাজনৈতিক সাংগঠনিক একটা মডেল দিয়েছেন, ছোট পরিসরে কিন্তু তথ্য-উপাত্ত সহ আলোচনা করেছেন মূলধারার ‘ইসলামি’ দল এবং ধর্মীয় উগ্রবাদের মধ্যে সম্পর্কের পাশাপাশি তাদের অর্থের উৎস নিয়ে-ও।
পরের অংশে বাংলাদেশে মৌলবাদের অর্থনীতি, রাজনীতি এবং জঙ্গিবাদের একটা যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়াস আছে; সেখানে ১৯৯৯ সাল থেকে ২০০৫ পর্যন্ত ধর্মীয় উগ্রবাদীদের বড় ধরনের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের একটা ধারাবাহিকতা দেয়া আছে ছক আকারে। আছে মৌলবাদী শক্তি-সমূহের কৌশলিক আন্ত:সম্পর্কের একটি ডায়াগ্রাম; এই অংশটির পরিশেষে বলা হয়েছে, “স্বাধীনতা ও মুক্ত চিন্তার প্রতিপক্ষ সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী শক্তি জানে তারা কি চায়, বিপরীতে আমরা জানি না আমরা কি চাই; ওরা জানে কেমন করে তা অর্জন করবে, বিপরীতে আমরা জানি না; ওরা ওদের লক্ষ্যার্জনে সুসংগঠিত, আমরা অসংগঠিত; লক্ষ্যার্জনে ওদের মধ্যে কোন দ্বিধা-দ্বন্দ্ব নেই, বিপরীতে আমাদের দ্বিধা আছে; ওরা যা করছে তা তারা গভীরভাবে বিশ্বাস করে, আরা আমরা নিজেদের প্রতি বিশ্বাস হারিয়েছি বলে মনে হয়; ক্রমবর্ধমান দারিদ্র, যুব সমাজের বেকারত্ব হতাশাকে ওরা সংকীর্ণ স্বার্থে কাজে লাগাতে সিদ্ধহস্ত, আমরা ‘দরিদ্র মানুষ-যুব-বেকার-হতাশার’ বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম এড়িয়ে চলেছি।

আমাদের অস্বচ্ছতা ও অনৈক্য ওদের ভীত শক্তিতে সহায়ক হচ্ছে। ”
সর্বশেষ অংশে বাংলাদেশে মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি ও সাম্প্রদায়িকতার “সীমানা’ তুলে ধরার পাশাপাশি করণীয় হিসেবে অধ্যাপক আবুল বারাকাত বেশ কিছু প্রস্তাবনা দিয়েছেন। পরিশিষ্ট হিসেবে দেয়া আছে বাংলাদেশে জঙ্গি কর্মকাণ্ডে সংশ্লিষ্ট অথবা জঙ্গিবাদ সমর্থনকারী ১২৫ টি ইসলামী সংস্থা’র নাম।
বইটির সার কথাতে তিনি জানিয়ে দেন, “বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক উগ্র সাম্প্রদায়িকতা বিষয়টি আর সমস্যা পর্যায়ে নেই, তা উত্তরিত হয়েছে সংকটে। গুনগত দিক থেকে সাম্প্রদায়িকতার উত্থানে এ এক নতুন পযায়।

” শাহবাগে গণজাগরণ সেই সাম্প্রদায়িক উত্থান’কে আরও এক ধাপ চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে বলেই তিনি মনে করেন এবং তিনি বলেন- চ্যালেঞ্জটি তারা গ্রহণ করেছে আপাতত হেফাজতে ইসলাম এর ব্যানারে। পুরো বইটি পড়লে নতুন করে টের পাওয়া যাবে বাংলাদেশের মৌলবাদ সাংগঠনিক একটি কেন্দ্রিকতা ধারণ করে এবং এটি নতুন নয়, শুরু থেকেই একটা কাঠামো তৈরি করা হয়েছে। সেই কাঠামো’র বিষয়ে তিনি প্রথমেই বলেন, “ধর্মীয় মৌলবাদ হচ্ছে যুদ্ধংদেহী এক ধর্মপ্রীতি। ” বড় প্রতিটি ধর্মের অনুসারীদের মধ্যে ধর্মীয় মৌলবাদের অস্তিত্ব আছে তিনি একমত পোষন করেন, তারপর বলেন, “সব ধর্মের মৌলবাদীরা নির্দিষ্ট এক ছকের অনুসারী। মৌলবাদীরা তাদের এই সংগ্রাম/সংঘর্ষকে প্রচলিত রাজনৈতিক সংগ্রাম হিসেবে মূল্যায়ন করেনা.... অস্তিত্ব হারানোর এক প্রচ্ছন্ন এক ভীতি মৌলবাদীদের প্রতিনিয়ত তাড়িত করে।

এ অবস্থা থেকে মুক্ত থাকার জন্য প্রায়শ তারা সমাজের মূলধারা থেকে বেরিয়ে এসে নিজরাও বিকল্প এক চেতনার উদ্ভব ঘটায়....”
আলোচনার শুরুতে তিনি স্পষ্টত ধর্মীয় মৌলবাদের উত্থানের জন্য সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলোকে দায়ী করেন (এই দেশগুলাই সেই দেশ!); সাম্রাজ্যবাদ মৌলবাদের উত্থান ত্বরান্বয়নে কোথাও কোথাও প্রধান ভূমিকা পালন করেছে বলতে যেয়ে উদাহরণ হিসেবে তিনি তালেবানইজম এর কথা বলেন, সরাসরি প্রশ্ন করেন, ‘মোল্লা ওমর, বিন লাদেন কাদের সৃষ্টি??’ আবার কোথাও কোথাও যে স্বার্থ উদ্ধারের পর তাদের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করা হয় তিনি সেটাও স্বীকার করে নেন, তারপর তিনি বলেন, এসবই শেষ পর্যন্ত নির্ধারিত হয় মুনাফা সমীকরণ দিয়ে। মানে হচ্ছে: সাম্রাজ্যবাদ কখন কোথায় কোন ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে তা নির্ভর করছে তার নিজস্ব রাজনৈতিক-অর্থনীতির সমীকরণে স্বার্থ সংশ্লিষ্টতার উপর- যেখানে শেষ পর্যন্ত অর্থনৈতিক স্বার্থটাই প্রদান। সেখানে তিনি ফুটনোটেই মূল জায়গাটুকু চিহ্নিত করে দেন, তথ্য-উপাত্ত দিয়ে দেখিয়ে দেন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যুদ্ধ কেন সবচাইতে লাভজনক ব্যবসা। নোয়াম চমস্কির ‘ইম্পেরিয়াল এম্বিশন’ থেকে তিনি যুক্তি খুঁজে নেন কিন্তু নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ মিল্টন ফ্রিডম্যান তার লেখায় মূল বিষয়টিকে এড়িয়ে যান বলে ফ্রিডম্যান এর দেয়া ফর্দ’কে তিনি গুরুত্ব দেননি।
এই যোগসূত্র স্থাপনের জন্য তিনি শুরুতেই বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে আমাদের জানান: বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর সবচাইতে বড় দেনাদার দেশ, তার সর্বমোট দেনার পরিমাণ দুই ট্রিলিয়ন (২,০০০ বিলিয়ন) ডলার, যা তার জিডিপির ২০ শতাংশ এবং এইভাবে চলতে থাকলে ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের দেনার পরিমাণ দাঁড়াবে তার জিডিপির ৬৭ শতাংশ।

যুদ্ধ যে যুক্তরাষ্ট্রের জন্য সবচাইতে লাভজনক ব্যবসা এই কথাটি তিনি উল্লেখ করেন; তারপর, এই কারণেই ইরাক আক্রমণ, ‘আরব বসন্ত’ এবং সেই বসন্তের লাভের গুড় যে যুক্তরাষ্ট্র, তার মিত্র দেশগুলো, বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, জাতিসংঘ চেটেপুটে খেয়ে নিচ্ছে সে কথা বলতেও ভুলে যান নি। সুতরাং নিজের স্বার্থের বিপরীতে কিছু হলেই আরেকজনের ভাল কাজে নাক গলানো, আরেকজনের সম্পদ দখল করা কিংবা যাদের মাধ্যমে তার সম্পদ নিশ্চিত থাকে তাদের বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করতে জোরপূর্বক সেটাকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করাটাই এদের জন্য স্বাভাবিক।
বইটির প্রতিটি অংশের আলোচনা খুবই সংক্ষেপিত। সংক্ষেপিত হওয়ার কারণে “মৌলবাদের রাজনৈতিক-অর্থনীতি আসলে কি” এই অংশের শুরুতে-ও তিনি জানিয়ে দেন যে এটি তুলনামূলক নতুন একটি ধারনা কিন্তু এই ধারনার উপর পর্যাপ্ত আলোচনা আমরা পাই না, কেবলমাত্র একটা অনুসন্ধিৎসা জাগ্রত হয়। তিনি কিছু যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করেন বিষয়টিকে বোঝানোর জন্য এবং তা করতে যেয়ে বলেন, “মৌলবাদের অর্থনীতি ধর্মভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির এক ঘনীভূত অংশ (concentrated expression of religious communal politics)।

তারপর এক কথায় প্রকাশ করেন- মৌলবাদের অর্থনীতি অসাম্প্রদায়িক চেতনা বিরুদ্ধ। আমরা তারপর জানতে পারি- জনকল্যাণমুখী বিকাশ-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে ব্যর্থতা এবং অসাম্প্রদায়িক-গণতান্ত্রিক মানস কাঠামো সৃষ্টির ব্যর্থতা থেকেই পুষ্ট হয় মৌলবাদ ও তার অর্থনীতি; এবং এই ব্যর্থতাই যে মৌলবাদের অর্থনীতির উৎপাদন এবং পুনরুৎপাদনের প্রধান ভিত্তি যা ধর্মের নামে জোর করে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে উদ্যত জঙ্গিবাদের সীমাহীন জঙ্গীত্বের প্রধান কারণ। সংক্ষেপে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ এর পর তিনি যোগসূত্র স্থাপনের প্রয়াসে সর্বশেষে সংযোজন করেন,
“...গোলাকায়নের গোলকধাঁধায় ইলেকট্রনিক মিডিয়ার অপসংস্কৃতি প্রচার, আর অন্যদিকে আমাদের দেশে দুর্বৃত্তায়িত আর্থ-রাজনৈতিক-সামাজিক পরিবেশে ব্যাপক জনগোষ্ঠীর দু:খ-দুর্দশা-বঞ্চনা-বিপন্নতা বৃদ্ধি ও দৈনন্দিন জীবনে মানুষের ক্রমবর্ধমান অসহায়ত্ব-- এসব কিছুই ধর্মের উদার ধ্যান-ধারনার বিপরীতে সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গির বিকাশে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন মাত্রায় অবদান রাখছে। এসব সুযোগ ধর্ম-ভিত্তিক সাম্প্রদায়িক রাজনীতির চাহিদা বৃদ্ধিতে সহায়ক, আর সে চাহিদা পূরণেই মৌলবাদী অর্থনীতির উদ্ভব বলা যায়। এ দু’টি একে অন্যের পরিপূরক-- যৌথভাবে তাদের মূল লক্ষ্য ধর্মের নামে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল।


চলবে...

সোর্স: http://www.sachalayatan.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.