আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চলচ্চিত্র ‘আর্‌গো’ : সিআইএ-র প্রচারযন্ত্রের ভূমিকায় হলিউড্

আসুন আমরা ২টি ভারী বস্তু আল্লাহর কুরান ও রাসুলের(সাঃ) পরিবারকে(আঃ) অনুসরন করি। যায়নাব চীমা ও মাকসূদ জাভাদোভ্ [সম্প্রতি হলিউড্ থেকে Argo নামে যে চলচ্চিত্রটি নির্মিত হয়েছে এবং এ বছর অস্কারে সেরা চলচ্চিত্রের স্থান দখল করে নিয়েছে তাতে ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিকৃত চিত্র পরিবেশন করা হয়েছে। আর এ কারণে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গতভাবেই ইরান ও ইরানীদের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে যা আন্তর্জাতিক প্রচারমাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। চলচ্চিত্রটির বিষয়বস্তু হচ্ছে : ইরানের ইসলামী বিপ্লবের বিজয়ের কিছুদিন পরে সেখান থেকে কয়েক জন মার্কিন গুপ্তচরকে বের করে আনার ব্যাপারে মার্কিন কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা (সিআইএ)-কে মার্কিন চলচ্চিত্র জগৎ হলিউড্ থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দেয়া হয়; একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য এরা ইরানে এসেছিল এরূপ একটি মিথ্যা ধারণা তৈরি করে হলিউড্ ঐ গুপ্তচরদেরকে চলচ্চিত্র কর্মী হিসেবে ইরান থেকে বের করে নেয়। অবশ্য ইসলামী বিপ্লব ও ইসলামী প্রজাতন্ত্র ইরানের বিকৃত চিত্র পরিবেশন করা হলেও এ চলচ্চিত্র থেকে দর্শকদের কাছে সিআইএ ও হলিউডের মধ্যকার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক সুস্পষ্টরূপে ধরা পড়ে।

সাবেক সিআইএ কর্মকর্তা টনি মেন্ডেয্-এর স্মৃতিকথা থেকে সিআইএ ও হলিউডের মধ্যকার এ সম্পর্ক ও সহযোগিতার বিষয়টি অকাট্যভাবে প্রমাণিত হয়। বস্তুত টনি মেনডেয্-এর স্মৃতিকথা ও ‘আর্‌গো’ চলচ্চিত্র থেকে হলিউডের আসল চেহারাই বেরিয়ে এসেছে। এ বিষয়ে বক্ষমাণ পর্যালোচনাটি লিখেছেন কানাডা থেকে প্রকাশিত পাক্ষিক Crescent International-এর স্টাফ্ রাইটার যায়নাব্ চীমা ও মাকসূদ্ জাভাদোভ্- যা পাক্ষিকটির নভেম্বর ২০১২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। নিউজলেটারের পাঠকদের জ্ঞাতার্থে কিঞ্চিৎ সংক্ষিপ্ত আকারে লেখাটির অনুবাদ নিম্নে পত্রস্থ করা হলো। - সম্পাদক নিউজলেটার।

] মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মওসূম১ খুবই ঢিমেতালে গতিতে এগিয়ে যাচ্ছিল, এমনকি রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রম্নীর ভাবমূর্তি বেচারা বারাক্ ওবামার ওপর দিয়ে উজ্জ্বল হয়ে উঠছিল। হ্যাঁ, এটাই তো হলিউডের জন্য নাটকীয় ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়ার এবং হরমোন্ ইনজেক্ট করার২ উপযুক্ত সময়- যার ফল হলো পেন্টাগনের অর্থায়নে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আর্‌গো’- যা ১৯৭৯ সালে ইরানে মার্কিন পণবন্দী সঙ্কটকালীন সিআইএ-র অপারেশন কর্মকর্তা টনি মেনডেয্-এর স্মৃতিকথার ওপর ভিত্তি করে নির্মিত হয়। সিআইএ-র কাজ ছেড়ে দেয়ার পর টনি মেনডেয্ একজন লেখকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন এবং তিনি সিআইএ-র যেসব অভিযানে অংশগ্রহণ করেন সেগুলো সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে তাঁর ‘গল্প নয়’ (নন্-ফিকশন্) সিরিজের পুস্তকগুলো রচনা করেন এবং তা বেস্ট-সেলিং পুস্তক-এর পর্যায়ভুক্ত হয়। আমেরিকান নাগরিকদের মধ্যে নাটকীয় রচনাবলীর প্রতি যে বিরাট ঝোঁক রয়েছে এ সিরিজের পুস্তকগুলো তার খোরাক যোগাতে সক্ষম হয় এবং লেখকের জন্য ম্যারিল্যান্ডে তাঁর পল্লিবাসের জীবনযাত্রার জন্য একটি পরিচ্ছন্ন উপার্জনের নিশ্চিত ব্যবস্থা করে। তিনি তাঁর সিআইএ জীবনের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে টক-মিষ্টি-ঝালসমৃদ্ধ তিনটি পুস্তক রচনা করেন যা সিআইএ পাবলিকেশন রিভিউ বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান হলিস্টার হেড্লি-র পক্ষ থেকে ‘উল্লেখযোগ্য স্মৃতিকথা’ Landmark Memoirs হিসেবে উচ্ছ্বসিত প্রশংসা লাভ করেছে।

ইরান থেকে মার্কিন গুপ্তচরদের বের করে নেয়া সংক্রান্ত টনি মেনডেয্-এর বইটির (যা তাঁর তৃতীয় স্মৃতিপুস্তক) পুরো শিরোনাম Argo: How the CIA and Hollywood Pulled off the Most Audacious Rescue in History (আর্‌গো : সিআইএ ও হলিউড্ যেভাবে ইতিহাসের সবচেয়ে দুঃসাহসিক উদ্ধার অভিযান আঞ্জাম দেয়)। এ পুস্তকে তিনি (একাই কি?) যেভাবে ইরানস্থ মার্কিন দূতাবাসের ছয় জন কর্মীকে উদ্ধার করেছিলেন তার বর্ণনা দিয়েছেন। ইতিপূর্বে ইরান থেকে পালিয়ে যাওয়া ক্ষমতাচ্যুত শাহকে বিচারের জন্য ইরানের হাতে প্রত্যর্পণের দাবীতে ইরানীরা তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাস দখল করে সেখানকার কূটনীতিক ও দূতাবাস-কর্মীদেরকে আটক করার সময় এ ছয় জন দূতাবাস-কর্মী সেখান থেকে পালিয়ে রাস্তায় নেমে আসতে সক্ষম হয়েছিল। ‘আর্‌গো’ চলচ্চিত্রের শুরু হয় একটি মোটেল কক্ষের বিছানায় টনি মেনডেযকে গা ছেড়ে দিয়ে থাকা অবস্থায় যখন সেখানে চীন থেকে আসা কয়েকটি বাক্স এলোমেলোভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতে দেখা যায়। এখানে আমরা তাঁকে তাঁর স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন স্বীয় ভাগ্যের ওপর নির্ভরশীল একজন সিআইএ-কর্মকর্তা হিসেবে দেখতে পাই।

(অবশ্য এতে তাঁর স্ত্রী থেকে বিচ্ছিন্ন থাকার কারণ দেখানো হয় নি, তবে এটা তাঁর নিজের কোনো মনস্তাত্ত্বিক সঙ্কটের কারণে বলে আমরা ধরে নিতে পারি। ) এরপর চলচ্চিত্রটিতে ইসলামী বিপ্লবের কিছু দৃশ্যপট ও উক্ত ছয় জন মার্কিন দূতাবাস-কর্মীকে দেখানো হয়; অবশ্য এতে উক্ত দূতাবাস-কর্মীদেরকে বেশ সাহসী ভূমিকায় দেখানো হয়, যদিও সাধারণমার্কিন নাগরিকদেরকে সন্ত্রাস ও নিষ্পেষণের ঘূর্ণাবর্তে ঘুরপাক খেতে দেখা যায়। ইরানীদের দ্বারা মার্কিন দূতাবাস দখল হওয়ার পর কানাডীয় রাষ্ট্রদূত কেন্ টের্ল কর্তৃক তেহরানস্থ কানাডা দূতাবাসে আশ্রয়প্রাপ্ত সাধারণ মার্কিন নাগরিকরা সেখানে মদ ও সুস্বাদু খাদ্যসহ বেশ আরাম-আয়েশে থাকলেও চলচ্চিত্রটিতে এদের অবস্থা দেখানোর নামে কয়েকটি আতঙ্কিত চেহারার ক্লোজ-আপ শট দেখনো হয়। চলচ্চিত্রে দেখা যায় যে, সিআইএ-র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা টনি মেনডেযকে ডাকিয়ে এনে যথাশীঘ্র সম্ভব একটি উদ্ধার পরিকল্পনা তৈরীর জন্য নির্দেশ দেন। আর এ বীর গুপ্তচর ব্যক্তিটি হলিউডের কভার-আপ্ দিয়ে উক্ত ছয় জন গুপ্তচরকে উদ্ধার করার প্রস্তাব পেশ করেন।

তিনি এ কাজে মেক্-আপ্ শিল্পী জন চেম্বারস্-কে কাজে লাগাবার এবং হলিউডের বিশ্ববিখ্যাত প্রডিউসার লেস্টার সিগেল্-কে (উভয়ই কাল্পনিক চরিত্র) দিয়ে একটি ভুয়া চলচ্চিত্র তৈরীর কর্মসূচি ব্যবহারের প্রস্তাব দেন। মূল চলচ্চিত্রের গল্পের এ চলচ্চিত্রটির নামও ‘আর্‌গো’। এ গল্পটি একটি সায়েন্স ফিকশন্ যাতে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন বাজারের এবং মরু এলাকার কতগুলো দৃশ্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে (এ প্রসঙ্গে ‘স্টার-ওয়ার : এপিসোড্-৪’-এর কথা স্মর্তব্য)। এরপর মেনডেযকে ইরানের সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয় থেকে চলচ্চিত্রটির চিত্রায়ণের অনুমতি নিতে দেখা যায় যাতে তিনি প্রমাণস্বরূপ বিভিন্ন পত্রিকা ও সাময়িকীতে প্রকাশিত এ চলচ্চিত্রের বিজ্ঞাপন প্রদর্শন করেন। এরপর তিনি উক্ত ছয় জন দূতাবাস-কর্মীকে চলচ্চিত্রকর্মীর ছদ্মবেশ পরিয়ে ইরান থেকে বের করে নিয়ে যান।

আমরা যেন হলিউড্ কর্তৃক বিভিন্ন ধরনের চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য বেছে নেয়া সময়গুলোর প্রতি দৃষ্টি দিতে ভুলে না যাই। এর আগে ১৯৯৬ সালে উইল্ স্মিথ ও জেফ্ গোল্ডবাম্ অভিনীত ‘ইন্ডেপেন্ডেন্স্ ডে’ চলচ্চিত্রে দেখানো হয় যে, উন্নত প্রযুক্তির অধিকারী বহির্জাগতিক প্রাণীদের স্পেসশীপ্ ইরাককে ভস্মীভূত করেছে। আমরা জানি যে, ১৯৯০-এর দশকে হেরিটেজ্ ফাউন্ডেশনের জমকালো অফিস থেকে ইরাকে আগ্রাসনের যে পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয় উক্ত চলচ্চিত্র নির্মাণের পরবর্তীকালে বুশ্ প্রশাসন নব্য রক্ষণশীলদের সে ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে। একই ধারাবাহিকতায় আমেরিকার সাংস্কৃতিক অঙ্গনের শক্তি-অক্ষটি ইসরাইলের নিরাপত্তা স্থায়ীভাবে নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইরানের ওপর হামলা চালাতে মার্কিন সরকারকে প্ররোচিত করার চেষ্টা করছে। ৩ ‘আর্‌গো’ নির্মাণে বিরাট অঙ্কের অর্থ ব্যয় করা হয়েছে এবং এ কারণে পেন্টাগনের অর্থায়নে নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের ন্যায় ‘আর্‌গো’ও একদিকে যেমন বক্স-অফিসে সাফল্য অর্জন করেছে, তেমনি চলচ্চিত্র সমালোচকদের কাছেও।

(এ প্রসঙ্গে ২০০৮ সালে নির্মিত Hurt Locker এবং পেন্টাগন থেকে উন্নত সামরিক প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে নির্মিত অন্যান্য চলচ্চিত্রের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। ) বেন্ এ্যাফলেক্ পরিচালিত চলচ্চিত্র ‘আর্‌গো’তে ভূমিকাস্বরূপ কার্টুন-চিত্র ও ড্রইং দ্বারা ইরানে সিআইএ-র প্রথম সফল অভিযানের কথা তুলে ধরা হয়- যে অভিযানে তেলশিল্প জাতীয়করণকারী তৎকালীন ইরানের স্বাধীনচেতা ও জাতীয়তাবাদী প্রধানমন্ত্রী মোসাদ্দেককে উৎখাত করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া তাদের হাতের পুতুল শাহ্ মোহাম্মাদ রেযা পাহলাভীকে ফিরিয়ে এনে পুনরায় ক্ষমতায় বসানো হয়েছিল। ৪ কার্যত এভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইরানে হস্তক্ষেপের কথা স্বীকার করা হলেও এ চলচ্চিত্রের গল্পে দেখানো হয়েছে যে, ইরান হচ্ছে চরমপন্থী ধার্মিক লোকদের দ্বারা পরিচালিত একটি কঠোর ও সহিংস ধর্মরাষ্ট্র, ঠিক যেভাবে তারা সাদ্দামশাসিত ইরাকের হাতে বিপুল পরিমাণে গণবিধ্বংসী অস্ত্র থাকার কথা প্রচার করেছিল। এভাবে ‘আর্‌গো’ তার শ্রোতাদের বিশ্বাস করাবার চেষ্টা করছে যে, যেহেতু ইরানীরা হচ্ছে ‘সহিংসতাপন্থী’ ও ‘অসহিষ্ণু’ জনগোষ্ঠী- যারা ইসলামের প্রচার করছে, সেহেতু এ দেশটির বিরুদ্ধে সামরিক হামলা চালালে ও দেশটিকে ধ্বংস করে দিলে কোনোই দোষ হবে না। এ লক্ষ্যেই ‘আর্‌গো’ ইসলামী বিপ্লবোত্তর ইরানের পণবন্দী সঙ্কটের কথা সকলকে পুনরায় (অবশ্যই বিকৃতভাবে) স্মরণ করিয়ে দেয়ার পেন্টাগনী দায়িত্ব পালন করছে।

আর এটিকে একটি প্রকৃত ইতিহাসভিত্তিক কাহিনী হিসেবে দর্শকদেরকে গেলানোর জন্য পেন্টাগন এককালীন বামপন্থী হিসেবে পরিচিত বেন্ এ্যাফলেক্-এর দ্বারা এটি নির্মাণ করিয়েছে। বিশেষ করে, এ লক্ষ্যে, মার্কিন প্রচারমাধ্যমে ইরানের ইসলামী বিপ্লবকে কলঙ্কিত করার লক্ষ্যে ও ইরানকে একটি ‘বর্বর’ ধর্মতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে যে ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়েছে, ‘আর্‌গো’ চলচ্চিত্র দর্শকদেরকে পুনরায় সে ধারণাই দেয়ার চেষ্টা করেছে। আর চলচ্চিত্রটির সমাপ্তি পর্বে কতগুলো সাদা-কালো ছবি যোগ করে দর্শকদেরকে আবারো বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, মূলত এটি একটি ঐতিহাসিক ঘটনাভিত্তিক চলচ্চিত্র এবং এতে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ‘ঐ সব খারাপ মুসলমানদের’ হাত থেকে ‘আমাদের লোকদের’কে উদ্ধারের ঘটনা দেখানো হয়েছে মাত্র; এতে কোনোই অপপ্রচার নিহিত নেই। এ চলচ্চিত্রে চলন্ত জীপে বসা স্বয়ংক্রিয় সামরিক অস্ত্রধারী চাদর-পরিহিতা (হিজাবধারিণী) ইরানী মহিলাদের দৃশ্য দেখানো হয়েছে- যাতে দর্শকরা কতগুলো বিন্দুকে পূরণ করে নেয় তথা যেসব ফিলিস্তিনি সুইসাড্ বোম্বার এক সময় ইসরাইলের জন্য হুমকি সৃষ্টি করেছিল তাদের কথা স্মরণ করে। তেমনি স্যুট পরিহিত লোককে ক্রেনে ঝুলিয়ে ফাঁসি দেয়ার বা বাড়িঘর থেকে টেনে বের করে এনে রাস্তায় গুলি করে হত্যার দৃশ্য দেখানো হয়েছে, কিন্তু এর প্রেক্ষাপট কী তথা কী অপরাধে তাদেরকে এরূপ শাস্তি দেয়া হয়েছে তা দেখানো হয় নি।

অথচ শাস্তিপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা বিপ্লবোত্তর কালে দাঙ্গা সৃষ্টি করেছিল, নিরীহ লোকদেরকে হত্যার মতো অপরাধে লিপ্ত হয়েছিল বা আমেরিকার পক্ষে গুপ্তচরবৃত্তি করেছিল। কিন্তু চলচ্চিত্রটিতে তার পরিবর্তে যা করা হয়েছে তা হলো স্রেফ মার্কিন অপপ্রচারেরই পুনরাবৃত্তি। অবশ্য ছয় জন দূতাবাস-কর্মীকে (যাদের মধ্যে রয়েছে দু’টি দম্পতি) ‘মুসলিম সন্ত্রাসী জনতা’র মধ্যে কয়েক জন নিরীহ আতঙ্কিত ব্যক্তি হিসেবে দেখানো হয়েছে- যাতে তাদের অসহায়ত্বকেই তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। অথচ প্রকৃত ব্যাপার হলো এই যে, তৎকালে তেহরানস্থ মার্কিন দূতাবাসে কর্মরত আমেরিকানদের মধ্যে কয়েক জন কেরানী পর্যায়ের লোক থাকলেও এ দূতাবাসটি কখনোই ‘নিরপেক্ষ এলাকা’ ছিল না; বরং এটি ছিল স্বাগতিক দেশের বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তিতে ও পাল্টা গোয়েন্দাগিরিতে লিপ্ত লোকদের আড্ডা। এটা এমন একটা সত্য যা অস্বীকার করা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়; বরং এ ক্ষেত্রে জ্যাসন্ বোর্নির-র সিরিজ প্রকৃত অবস্থার অধিকতর কাছাকাছি।

কাহিনীর সমাপ্তিতে দেখানো হয় যে, উক্ত ছয় জন দূতাবাস কর্মী পুনরায় মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করে। এ থেকে স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগে যে, তারা কি মামুলী ধরনের মার্কিন নাগরিক ছিল যারা ঘটনাক্রমে একটি ভুল সময়ে ইরানে গিয়ে দূতাবাসের কাজে যোগদান করেছিল, নাকি তারা মার্কিন পররাষ্ট্র নীতির প্রতি নিবেদিতপ্রাণ ছিল? ‘আর্‌গো’তে সংশ্লিষ্ট নারীদের নিয়ে এমন দৃশ্যও সংযোজন করা হয়েছে যার উদ্দেশ্য মানবিক সহানুভূতি উদ্রেক করা ছাড়া আর কিছু নয়। দেখানো হয়েছে যে, স্ত্রীরা স্বামীদেরকে সান্ত্বনা দিচ্ছে- যার দ্বারা এটাই বুঝানোর চেষ্টা করা হয়েছে যে, এটি কোনো পেন্টাগনপন্থী চলচ্চিত্র নয়; বরং এটা পারিবারিক রোমান্টিক কাহিনীর কাছাকাছি ধরনের একটি সামাজিক চলচ্চিত্র। ‘আর্‌গো’তে যে নারীচিত্র তুলে ধরা হয়েছে তা এ কালের প্রকৃত আমেরিকান নারী থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র। ‘আর্‌গো’র নারী হচ্ছে রক্ষণশীল, আকর্ষণীয়া স্ত্রী, মমতাময়ী মা এবং স্বামীকে সাহায্যকারিণী।

একটি দৃশ্যে দেখা যায় যে, দূতাবাস কর্মীদেরকে ভ্যানযোগে তেহরান বিমান বন্দরে নেয়ার সময় আবেগে এ নারীদের ঠোঁট কাঁপছে, এতে তারা বিপর্যস্ত এবং নারীসুলভ উদ্বিগ্ন; এসব দৃশ্য দর্শকদের কাছে সহানুভূতি প্রদর্শনের মহানুভবতা দাবী করে। ৫ শুধু তা-ই নয়, গল্পের নায়কও তার গৃহকর্ত্রী স্ত্রীর কাছে ফিরে যায়- যে তাকে সাশ্রুনয়নে বরণ করে এবং পুত্রের সাথে পিতার ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্যের মধ্য দিয়ে ছবিটি শেষ হয়- যা থেকে মনে হয়, এ চলচ্চিত্রটি যেন ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন শান্তিময় এ্যঙ্গলো-স্যাক্সন পারিবারিক ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসার জন্য নিবেদিত। ইরানের ভাবমূর্তি বিনাশের পাশাপাশি ‘আরগো’র পিছনে নিহিত পেন্টাগনের আরেকটি উদ্দেশ্য হচ্ছে আমেরিকার ইতিহাস থেকে আবূ গ¦ারীব্ কারাগারে ও গুয়ান্তানামো বে-র বন্দীশালায় বন্দী নির্যাতনের অধ্যায়গুলো ও উইকিলিকস্-এর ফাঁস করে দেয়া কলঙ্কগুলো মুছে ফেলা এবং এর পরিবর্তে এ ধারণা প্রতিষ্ঠা করা যে, আমেরিকানরা বহির্বিশ্বে ভালো কাজ সম্পাদনকারী দেশপ্রেমিক ছাড়া আর কিছুই নয়। অবশ্য ‘আর্‌গো’ আমাদেরকে একটি মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করেছে; এ চলচ্চিত্রটি হলিউড্ ও পেন্টাগনের মধ্যকার অঙ্গাঙ্গীভাবে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক দিবালোকের মতো সুস্পষ্ট করে তুলে ধরেছে। যদিও এ দু’টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যকার এ সম্পর্ক নতুন নয়, তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোতে এ সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হয়েছে।

এর আগে হলিউড্ যেখানে নিজেকে একটি স্বাধীন সাংস্কৃতিক শক্তি হিসেবে তুলে ধরতো, তার পরিবর্তে এখন এটাই স্বীকার করে নিল যে, এটি হচ্ছে আমেরিকার সামরিক শিল্প কমপ্লেক্সের অংশবিশেষ- একটি সাংস্কৃতিক শিল্প ইউনিট। তাই ‘আরগো’র কাহিনীতে দেখা যায় যে, এ্যাফলেক্ (‘আর্‌গো’র পরিচালক-অভিনেতা) এ চলচ্চিত্রটি নির্মাণের ব্যাপারে সিআইএ-র কাছ থেকে (পরীক্ষামূলক) সবুজ সংকেত লাভ করার পর মেক্-আপ্ শিল্পী জন্ চেমবারস্ ও ‘হলিউড্ মোগল’ হিসেবে পরিচিত লেস্টার সিগেল্-এর সাথে সাক্ষাৎ করার লক্ষ্যে ক্যালিফোর্নিয়ায় ছুটে যান। লেস্টার সিগেল্-এর সাথে সাক্ষাৎ করার উদ্দেশ্য, ইরানী কর্তৃপক্ষের কাছে এ ধরনের একটি চলচ্চিত্র নির্মাণের বিষয়টিকে বিশ্বাসযোগ্য করার লক্ষ্যে কাল্পনিক চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে প্রচার চালানো। লেস্টার সিগেল্ (যার ইয়াহূদী হবার বিষয়টি নিদর্শন থেকে বুঝা যায়, কিন্তু কখনো সরাসরি স্বীকার করেন নি) প্রথম দিকে এটিকে একটি ঝামেলাময় প্রকল্প মনে করে তাতে যোগদানের ব্যাপারে দ্বিধা করেন, কিন্তু টেলভিশনে দূতাবাস-কর্মীদের চেহারা দেখার পর তিনি অগ্রসর হন। বস্তুত, ‘অসহিষ্ণু’ ও ‘দুষ্ট’ মুসলমানদের বিরুদ্ধে ‘মহান’ ইয়াহূদী-খ্রিস্টান সভ্যতার মোকাবিলার যে বিশ্বচিত্র স্যামুয়েল হান্টিংটন অঙ্কন করেছেন এ চলচ্চিত্রে এভাবে তাকে বাস্তব রূপ দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

‘আর্‌গো’ চলচ্চিত্রে দৃশ্যত ইরানীদেরকে যেভাবে ‘তালেবানীকরণ’ করা হয়েছে তা মোটেই উপেক্ষা করার বিষয় নয়। কারণ, এ চলচ্চিত্রে ইরান সরকারের ও তার বিপ্লবী রক্ষীবাহিনী (পাসদার)-এর সদস্যদেরকে ঠিক সেভাবেই দাড়িওয়ালা, ‘অমার্জিত’ (unkempt) ও ‘সহিংস’ (violent) দেখানো হয়েছে, মার্কিন প্রচারমাধ্যম ঠিক যেরূপ নমনীয়তাবর্জিত বন্য চিত্র আফগানিস্তানের তালেবানের জন্য প্রচার করে আসছে। চলচ্চিত্রটিতে ইরানী সংস্কৃতি ও সভ্যতা সম্পর্কে-যার বয়স মার্কিন সংস্কৃতি ও সভ্যতার চেয়ে ছয় হাজার বছর বেশি-ছবিটির লেখক ও নির্মাতার বিন্দুমাত্রও জ্ঞান না থাকার বিষয়টি প্রতিফলিত হয়েছে। একইভাবে এককালের সমৃদ্ধ আফগান সভ্যতা সম্পর্কেও তাদের অজ্ঞতা প্রমাণিত হয়- যে সভ্যতার নিদর্শনাদি ঠাণ্ডা লড়াইয়ের দ্বারা এবং পেন্টাগনের সৃষ্ট মিলিশিয়াদের দ্বারা ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। এছাড়া ‘আর্‌গো’তে ইরানীদেরকে নির্বোধ হিসেবে তুলে ধরারও চেষ্টা করা হয়েছে।

চলচ্চিত্রের শেষের দিকে দেখানো হয় যে, সুইস্ এয়ারের বিমানে আরোহণের জন্য লাইনে দাঁড়ানো আমেরিকানদেরকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য লাইন থেকে বের করে আনা হলে তারা চলচ্চিত্র (ভুয়া) নির্মাণের বিষয়টি ব্যাখ্যা করে এবং প্রমাণ হিসেবে এতদসংক্রান্ত ড্রইং দেখায়, আর তাদের এ ধাপ্পা বুঝতে না পেরে দাড়িওয়ালা ও যাযাবর ধরনের (!) ইরানী রক্ষীদেরকে বালসুলভ ধরনের আনন্দ প্রকাশ করতে দেখা যায়। এ দৃশ্যটির মাধ্যমে দর্শকদেরকে এ ধারণাই দেয়া হয়েছে যে, প্রতারণাময় চোখধাঁধানো মার্কিন সংস্কৃতি এমনকি তাদের কঠোরতম বিরোধীদেরকেও ধাপ্পা দিতে সক্ষম। অবশ্য এ্যাফলেক্ কিছু ইরানীকে ব্যতিক্রম হিসেবে তুলে ধরেছেন, কিন্তু তার পিছনেও আমেরিকার অবদান দেখেছেন; এরা হলেন ইরানের দৃঢ় মানসিক শক্তির অধিকারী অত্যন্ত বুদ্ধিমান (intelligent) ও ‘ভয়ঙ্কর’ বিপ্লবী রক্ষী, কারণ, তাঁরা আমেরিকায় পড়াশুনা করেছিলেন। অর্থাৎ শুদ্ধ ইংরেজিতে কথাবার্তা বলতে সক্ষম শহুরে বিপ্লবী রক্ষীরা হচ্ছেন ‘অজ্ঞ’ ও ‘সহিংসতাপ্রবণ’ মুসলমানদের থেকে ‘ব্যতিক্রম’, কারণ, তাঁরা আমেরিকায় শিক্ষাপ্রাপ্ত। বাইরের যে কোনো পছন্দনীয় বিষয়ের পিছনে ইঙ্গ-মার্কিন সভ্যতার অবদান আবিষ্কারের কতোই না চমৎকার পন্থা! অবশ্য শহীদ মোস্তফা চামরান আমেরিকা থেকে পিএইচডি ডিগ্রী নিয়েছিলেন, কিন্তু ভালো ইংরেজি জানা সকল বিপ্লবী রক্ষীই আমেরিকায় পড়াশুনা করেছিলেন এমন দাবীর পিছনে কোনো তথ্যগত সত্যতা নিহিত নেই।

‘আর্‌গো’তে আরো একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়, তা হচ্ছে, ধর্মসম্পর্কহীন (secular) ও ‘প্রগতিশীল’ আমেরিকানদের প্রবৃত্তিপূজারি স্বভাব ও মাদক পানীয়প্রীতি যা পূতপবিত্রতাপন্থী ধর্মতাত্ত্বিক ইরানীদের ও তাদের মধ্যকার একটি গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য নির্দেশ করে। বিশেষ করে দেখা যায় যে, আমেরিকানদেরকে বহনকারী সুইস এয়ারের বিমানটি ইরানী আকাশ সীমা অতিক্রম করার পর বিমানের স্টুয়ার্ড ঘোষণা করছে : ‘প্রিয় ভদ্র মহিলাগণ ও ভদ্র মহোদয়গণ! আপনাদের প্রতি অভিনন্দন। আমরা ইরানী আকাশ সীমা অতিক্রম করে এসেছি এবং এখন আপনারা এ্যালকোহল পানের ক্ষেত্রে মুক্ত। ’ বস্তুত মদ তাদের কাছে স্রেফ মদ নয়; বরং এটি তাদের একটি সাংস্কৃতিক হাতিয়ারও বটে। সিআইএ ও পেন্টাগন ইরান ও ইসলামের বিরুদ্ধে ক্রুসেডের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক যুদ্ধ চালিয়ে আসছে এবং সে যুদ্ধে তারা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি সরব।

কিন্তু যুদ্ধ ও বাগাড়ম্বরে তারা যে ধূর্ততার আশ্রয় নিচ্ছে- যা দ্বিতীয় শ্রেণির অভ্যন্তরীণ বিনোদন চলচ্চিত্র ‘আর্‌গো’তে বেশ ভালোভাবেই প্রতিফলিত হয়েছে- তার কার্যকরিতার যুগ ইতিমধ্যেই অতীত হয়ে গিয়েছে। অনুবাদ : নূর হোসেন মজিদী ১. অর্থাৎ ২০১২ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মওসূম। উল্লেখ্য, এ নির্বাচনের প্রচারাভিযান চলাকালে আলোচ্য চলচ্চিত্রটি নির্মাণের কাজে হাত দেয়া হয় এবং আনুষ্ঠানিকভাবে প্রেক্ষাগারে প্রদর্শন শুরুর (১২ অক্টোবর ২০১২) আগেই এর বিষয়বস্তু ও বিভিন্ন দৃশ্য ব্যাপকভাবে প্রচার করা হয়। - অনুবাদক ২. প্রেসিডেন্টের ইমেজে। - অনুবাদক ৩. অর্থাৎ এ উদ্দেশ্যেই হলিউড্ থেকে ‘আর্‌গো’ চলচ্চিত্র নির্মাণ করা হয়েছে।

– অনুবাদক ৪. এটা ১৯৫৩ সালের ঘটনা। - অনুবাদক ৫. যে সহানুভূতি সৃষ্টির অপর পিঠ হচ্ছে ইসলামী ইরানের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ সৃষ্টি। - অনুবাদক ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.