তারা ছিল মধ্য আমেরিকার এক রেইনফরেস্ট-এর পাশের গ্রামের কৃষক। বিভিন্ন ধরনের ক্রান্তীয় গাছপালা, হিংস্র জানোয়ার আর রহস্যময় সরীসৃপে পরিপূর্ণ ছিল জঙ্গলটি। আর এই জঙ্গলেই ছিল কোকো গাছগুলো, যার বীজ থেকে তৈরি হয় চকলেট।
জঙ্গলের বানরগুলি এই অদ্ভুত ফল সম্পর্কে বেশ ভালোই জানত। তারা এই ফলের খোসা ছাড়িয়ে ভিতরের মিষ্টি সাদা অংশ খেত।
আর ভেতরের তেতো বিচিগুলো ফেলে দিত। সেই ফেলে-দেওয়া-বিচি থেকে জন্মাত নতুন আরও কোকো গাছ।
একদিন এক কৃষক বানরগুলোর দেখাদেখি কোকো গাছের ফল খেয়ে দেখল। ভেতরকার সাদা শাঁসটুকু খেয়ে মজাও পেল বেশ। কিন্তু বিচি মুখে দিয়েই “ওয়াক” বলে ফেলে দিল।
তারপর কৃষকটি যখন অন্যদের জানালো এই ফলের ব্যাপারে, তখন অন্যরাও কোকো ফল খেতে শুরু করল। সবাই-ই অবশ্য ওই কৃষকের মতো বিচি ফেলে দিয়ে শুধুই শাঁস খেত।
হঠাৎ একদিন কয়েকজন গ্রামবাসী লক্ষ্য করল, কোকো ফলের বিচিগুলো যেখানে ওরা জড়ো করে রেখেছিল, সেখান থেকে অদ্ভুত সুন্দর একটা ঘ্রাণ বের হচ্ছে। কয়েক মাসের মধ্যেই তারা এই সুগন্ধটিকেও স্থায়ী করার পদ্ধতি আবিষ্কার করে ফেলল। সে জন্য তারা এই বিচিগুলোকে একধরণের পানীয়তে রূপান্তরিত করত।
ওরা করত কী, কলাপাতার নিচে রেখে প্রথমে বিচিগুলোকে কয়েকদিন পঁচাত। এরপর কড়া রোদে পঁচা বিচিগুলোকে ভালো করে শুকিয়ে নিত। তারপর সেই বিচিগুলোকে আগুনের তাপে ভেজে, সেগুলোকে পিষে পেস্টের মতো বানাত। সবশেষে সেই পেস্ট বা মিশ্রণটিকে আরো মসলার সাথে পানিতে মিশিয়ে পানীয়টি প্রস্তুত করত। তারা নতুন এই পানীয়র নাম দিল ‘চকল বা’ (Chocol baa)।
যদিও এই চকল বা-এর স্বাদ ছিল খুবই তেতো, তারপরও তারা এটা পছন্দ করত।
জঙ্গল থেকে কষ্ট করে যেন কোকো ফল সংগ্রহ করতে যেতে না হয়, সে জন্য কৃষকরা তাদের নিজেদের মাঠেই কোকো গাছের চাষ শুরু করল। সেই কৃষকরা ‘মায়ান’ নামের এক বিশাল গোত্রের সদস্য ছিল। আর এই ‘চকল বা’ অথবা চকলেট ছিল মায়ানদের জীবনের এক অপরিহার্য অংশ। মায়ান রাজা ও পুরোহিতগণ তাদের বানানো চকলেট খেতেন রোজ।
তারা এই পানীয়র চেয়ে এর ফেনাই বেশি পছন্দ করতেন। এমনকি মায়ানদের বিয়েতেও কোকো ফলের ব্যবহার ছিল। বিয়েতে প্রথাই হয়ে গিয়েছিল, বর-কনে পাঁচটি কোকো বিনিময় করবে।
আসলে মানুষ তখন কোকো গাছ এতই পছন্দ করত যে, তারা তাদের তৈজসপত্রে, মগে, দেয়ালে, বলতে গেলে সমস্ত কিছুতেই কোকো গাছের ছবি এঁকে রাখত। কিন্তু কোকো-বিচিগুলোর প্রস্তুতপ্রণালী খুবই কষ্টের।
শুধু কষ্টেরই না, তা সময়সাপেক্ষও ছিল। ফলে বেশিরভাগ মানুষই চকলেটের পানীয় বিশেষ কোনো উৎসব ছাড়া খেত না।
কোকো ফলের বিচিগুলো পরবর্তীতে মায়ানদের কাছে এতই মূল্যবান বলে বিবেচিত হল যে, তারা এটাকে টাকার মতো করে ব্যবহার করতে শুরু করল। তখন ১০টি কোকোর বিচির বদলে একটি খরগোশ এবং ১০০ বিচির বদলে একজন ক্রীতদাস কেনা যেত।
রহস্য জানল অন্যরাও
এর প্রায় ১০০ বছর পরের কথা।
একদল ব্যবসায়ী মায়ানদের গ্রামে আসে। তারা তাদের সম্রাটের জন্য সম্পূর্ণ নতুন ধরনের কিছু বিদেশ থেকে নিয়ে যেতে চাইছিল। আর সে জন্যই ঘুরছিল বেশ কিছুদিন ধরে। ঘুরতে ঘুরতেই তারা মায়ানদের গ্রামে এসে পৌঁছায়। ঐ ব্যবসায়ীরা ছিল ‘অ্যাজটেক’ নামের এক ভয়ংকর গোত্রের সদস্য।
কাজেই, ঝামেলা এড়ানোর জন্য মায়ানরা অ্যাজটেকদের কিছু মূল্যবান কোকো বীজ দিতে চায়।
অ্যাজটেকরা যখন চকলেটের রহস্য জেনে গেল, তখন তারা এক মগ তরল চকলেট তাদের সম্রাটকে পরিবেশন করল। স¤্রাট তরল চকলেট খেয়েই “অসাধারণ” বলে চেঁচিয়ে উঠলেন। তিনি দেখলেন, এটি ঠাণ্ডা পানীয়, কিন্তু উত্তেজক। আবার মাতালও করে না।
তাই তিনি তার সৈনিকদের যুদ্ধে যাবার আগে তরল চকলেট খাওয়ার নির্দেশ দিলেন।
অ্যাজটেকরা যেখানে থাকত, সেই জায়গা কোকো গাছ চাষের জন্য ভালো ছিল না। জায়গাটা ছিল একটু বেশিই শীতল। ফলে অ্যাজটেকরা কোকো চাষ করতে পারত না। তারা মায়ানদের কাছ থেকে কোকো কিনে তাদের দেশ পর্যন্ত বয়ে নিয়ে যেত।
আর অ্যাজটেক সম্রাট মন্টেজুমা তো চকলেটের জন্য রীতিমতো পাগল ছিলেন। তিনি রাজগুদাম কোকো বীজ দিয়েই পূর্ণ করে রেখেছিলেন। এমনকি মাঝেমধ্যে তিনি ৫০ কাপ তরল চকলেটও খেয়ে ফেলতেন। তার বিশ্বাস ছিল, এই পানীয় তাকে আরও ধনী ও জ্ঞানী করে তুলবে। কিন্ত গরীব মানুষের কাছে চকলেট তখনও শুধু স্বপ্নই।
সেই সময়েই চকলেটের উৎপত্তি সম্পর্কে একটা কিংবদন্তি কাহিনি গড়ে ওঠে। কাহিনিটি গড়ে ওঠে যেখানে চকলেট প্রথম চালু হয়েছিল, সেই জায়গাকে নিয়ে। কাহিনিটি এ রকম--
একদা এই পৃথিবীতে কোনো চকলেট ছিল না। পরে একদিন চাষাবাদের দেবতা কোজালকোল (Quetzalcoatl) স্বর্গ থেকে নিয়ে এলেন একটা কোকো গাছ। আর সেই কোকো গাছ থেকেই চকলেট পানীয়ের উদ্ভব হল।
এই কোজালকোল ছিল অ্যাজটেকদের নায়ক। অ্যাজটেকরা তার জন্য বিরাট মন্দির বানিয়ে সেখানে চকলেট পানীয়ের ভোগ চড়াত। অন্যান্য দেশগুলোরও নজর ছিল অ্যাজটেকদের সম্পদের উপর। চকলেট সে জন্য শুধু মধ্য আমেরিকার রহস্য হয়ে আর বেশিদিন থাকতে পারেনি।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।