সনতায়া মহা খুশী ঢাকায় ঘুরতে বেড়িয়ে, প্রথমবারের মত বাংলাদেশে এসেছে থাইল্যান্ডের মানুষটি, কয়েক ঘণ্টা সময় আছে মাত্র কারণ রাতের ট্রেনেই চাপতে হবে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে, সেখান থেকে আবার কাপ্তাই। তাই অল্প সময়ের জন্যই দেখতে বেরোনো হয়েছে ঢাকা শহর। যদিও সনতায়ার সফরসঙ্গী, তার শিক্ষক এই নিয়ে বাংলাদেশে ছয়বার আসা ফিলিপ রাউন্ড সেযাত্রা বাসাতে বিশ্রাম নিতেই মনস্থির করলেন সংগত কারণেই। আমাদের থাই বন্ধুর খুশীর কারণটি অবশ্য বেশ ব্যতিক্রমী, তা হচ্ছে চিরপরিচিত পাতি কাক! যে মহাউপকারী পাখিটা সংখ্যাধিক্যের কারণে প্রতি কদমেই নজরে আসে, তাদেরই দর্শনে সে মহা প্রীত, থাইল্যান্ডে দাঁড় কাক সবখানে দেখা গেলেও পাতি কাকের দেখা পাওয়া বেশ দুর্লভ, তাই সনতায়ার ঢাকা প্রেম প্রথম থেকেই বেশ জোরদার। যদিও বাংলাদেশে সে এসেছে জলপাই বুলবুলের খোঁজে।
তার পি এইচ ডির গবেষণার বিষয় এশিয়া মহাদেশের কয়েকটি বুলবুলের জাতি ও প্রজাতির মাঝের পার্থক্য নির্ণয়, সেই কাজেই তার ভীষণ দরকার হয়ে পড়েছে জলপাই বুলবুলের ডি এন এ, মানে অন্তত একটি পালক, সেটি না হলেও তার গলার স্বর।
বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হক কাপ্তাইয়ের একটি বুনো ট্রেইলের সন্ধান জানেন বিগত দুই দশক ধরে যেখানে জলপাই বুলবুল যে কেবল নিয়মিত দেখা যায় তা নয়, এমনকি ছড়ার জলে স্নান করতেও নামে, মানে তাদের জাল দিয়ে ধরা সম্ভব। সেই আশা থেকেই তিনি লিখলেন ফিলিপ ও তার ছাত্রকে গত ডিসেম্বরে কাপ্তাই ঘুরে যেতে, সেখানে আছে জলপাই বুলবুলের পালক মেলার সমূহ সম্ভাবনা। ফিলিপ রাউন্ড বাংলাদেশে বার্ড রিংগিং ( পাখির পায়ের আংটা পরানো)এর একেবারে প্রথম থেকে আসছেন বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের আমন্ত্রণে, তাই আবারও তার সাথে একটি বার্ড রিংগিং ক্যাম্পের পরিকল্পনা করে ফেললেন ইনাম আল হক, যেখানে সনতায়া সাথে যোগ দিলেন বন্যপ্রাণী গবেষক সামিউল মোহসানিন ( পাখি রিঙ করার লাইসেন্স পেয়েছেন তিনি বাংলাদেশের প্রথম ব্যক্তি হিসেবে), আর রিঙ পরানোর অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের জন্য আমি নিজে।
২১ নভেম্বর, ২০১৩ রাতে যাত্রা করা ট্রেনে ভোরের চট্টগ্রামে পৌঁছেই মাইক্রোবাস করে যাওয়া হল কাপ্তাইয়ের বনবিভাগের বিশ্রামাগার বনফুলে, সেখানে ব্যাকপ্যাক ফেলেই মূল ট্রেইল রেকি করতে সদলবলে দুপুরের পরপরই বড় ছড়াতে।
প্রায়ই হাটুপানি ঠেলে নুড়ি-পাথরময় ট্রেইল ধরে আমরা এগোলাম রাম পাহাড়ের দিকে। যদিও বেশ ভিতরেও জনসমাগম, লোকজনের গাছ কাটা, প্রাকৃতিক বন ধ্বংস করে বাগান বানানোর ইন্তেজাম ইত্যাদি নজরে আসল। বন বিভাগের নাকের ডগায় এমন পরিকল্পিত উপায়ে বনাঞ্চল ধ্বংস অবশ্য দেখা যায় দেশের প্রায় প্রতিটি ন্যাশনাল পার্কেই। কয়েকটা জায়গা পরের দিন জাল পাতার জন্য ঠিক করে সেখানে আবার বাঁশ আনার বন্দোবস্ত করতে করতেই সন্ধ্যা হয়ে গেল, সেখানেও তখনো জাতায়াত চলছে মানুষ ও গবাদিপশুর।
পরদিন ধলপহরেই ছড়ার প্রান্তে আমরা, রাস্তার উল্টো পাশে রূপোলী কর্ণফুলী তখনো ঘুমিয়ে নীল অন্ধকারকে সাথী করে, নক্ষত্রেরা তখনো পথ দেখাচ্ছে মিটমিট করে, যদিও ঠাণ্ডা জলের মৃদুমন্দ স্রোতস্বিনীর মাঝে যত্রতত্র পড়ে থাকা অতিকায় সব পাথরের সাথে দুর্ঘটনা এড়াতে সাথে নিয়ে আসা আলো জ্বালাতে হল।
বনভূমি তখনও সুমসাম, নির্জনতার সঙ্গীত বয়ে চলেছে সর্বত্র। সূর্যদেবের উঁকি দেবার আগেই আমাদের ক্যাম্প ফেলা হয়ে যায়, আমি ছাড়া দলের সবাইই অভিজ্ঞ কর্মী, দেখতে দেখতে বাঁশ পুঁতে সেখানে জাল বাধা হয়ে যায়, তারপর শুধু প্রতীক্ষা।
কেন পাখির পায়ে আংটা পরানো হয়?
গবেষণার জন্য, বিশেষ করে পাখির গতিপথ, জীবনচক্র ইত্যাদি ব্যাপার তথ্যসংগ্রহের জন্য শত বছরেরও বেশী কাল ধরে রিংগিংকে এক অপরিহার্য উপায় হিসেবে দেখা হচ্ছে। বাংলাদেশে ২০১০ সালের নভেম্বরে বার্ড রিংগিং শুরু হয়। রিঙ করার জন্য পাখি ধরার অন্যতম ব্যবহৃত উপায় হচ্ছে পাখির চলাচলের পথে জাল রাখা, এবং সেই জাল নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করা।
কারণ, পাখি রিঙ করার প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে পাখির নিরাপত্তা। জালে পাখি পরলেই হল না, তাকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নিরাপদে সরিয়ে নিয়ে হবে, যদি পাখি অসহায় ভাবে জালে ঝুলতে থাকে অন্য পাখি বা প্রাণী এসে তাদের মেরে ফেলতে পারে, উল্টাপাল্টা ভাবে আটকে দেহের তাপমাত্রা বেরিয়ে যেতে পারে, ঠাণ্ডায় জমে পাখি পরপারে পাড়ি জমাতে পারে। তাই প্রথমেই শেখানো হয় পাখি কী করে জাল থেকে ছাড়িয়ে সাথে ব্যাগে রাখতে হয়, ব্যাগে রাখার পর কয়েক ঘণ্টার জন্য সে পুরোপুরি নিরাপদ। তারপর চলে পাখির নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ যেমন ওজন, ডানার দৈর্ঘ্য, লেজের দৈর্ঘ্য, ঠোঁট, খুলি, চর্বির পরিমাণ, পায়ের দৈর্ঘ্য, সম্ভব হলে পালক সংগ্রহ ইত্যাদি ইত্যাদি।
তবে রিং পরানোর মাধ্যমে যে জিনিসটা বেশ নিখুঁত ভাবে জানা যায় তা হচ্ছে একটি বিশেষ পাখি নিয়ে নানা তথ্য।
যেমন ধরুন সদরঘাট এলাকায় হাজার হাজার কাকের মাঝে কোন কোনটা কি টঙ্গি ভ্রমণ করে উড়তে উড়তে? এই জন্য সবচেয়ে সহজ কাজ হবে সদরঘাট এলাকার কিছু কাকের বাচ্চার পায়ে রিং পরিয়ে দেওয়া, পরে টঙ্গিতে যদি সেই রিংওয়ালা কাক পাওয়া যায় পরবর্তী কয়েক বছরে তাহলে আমরা নির্ভরযোগ্য তথ্য পাব তাদের গমনপথের ব্যাপারে। আর হ্যাঁ, বিশ্বের সব রিং কিন্তু অদ্বিতীয়, কারণ তাদের উপরে যে ক্রমিক নং খোদাই করা থাকে তা প্রতিটির জন্য আলাদা আলাদা। যদিও সাধারণত দেশ অনুযায়ী একটি বিশেষ ঠিকানা লেখা থাকে, যেমন বাংলাদেশের জন্য নির্মিত প্রতিটি রিঙে লেখা থাকে GPO BOX 2624 DHAKA, ফলে বিশ্বের যে কোন অঞ্চলের মানুষ পাখির পায়ে এই রিং পেলে অন্তত জানবে কোথায় তা পাঠাতে হবে। আজ পর্যন্ত সাঁরা বিশ্বে অন্তত দুই কোটি পাখির পায়ে রিং পরানো হয়েছে।
দিনের প্রথম জাল পাতার পর আপাতত কিছুক্ষণ পরপর তদারক করা ছাড়া কিছু করার নেই নিসর্গ উপভোগ করা ছাড়া, আধাবেলা গড়িয়ে যাবার পরও সেদিন জালে কোন পাখি পড়ল না।
সনতায়া তার রেকর্ডপ্লেয়ার থেকে বাজিয়ে যাচ্ছে জলপাই বুলবুলের গান, যদি কোন একাকী বুলবুল সাড়া দেয় তার যান্ত্রিক সঙ্গীর আহবানে সেই কারণে। অলস পায়ে আলো ছায়া গায়ে মেখে হেঁটে বেড়াচ্ছি আমরা জালসীমানার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত। পাখির কিচির-মিচির শোনা যাচ্ছে বটে কিন্তু সদ্য টাঙ্গানো ৫টি জালের দিকে তারা ধেয়ে যাচ্ছে না কোন অজানা কারণে। অবশেষে নির্জন দুপুরে প্রথমবারের মত মাছরাঙ্গার ডানা প্রথমবারের মত আটকে গেল আমাদের পাতা জালে! আতঙ্কে পা-ডানা ছোড়াছুড়ি করতে যেয়ে আরও বেশি করে জড়িয়ে গেল আদুর নীল পালকের গোল বলটা!
জাল থেকে পাখি ছাড়ানোর বিশেষ প্রশিক্ষণ পাওয়া সামিউল ভাই আলতো করে ছাড়িয়ে সেটাকে বিশেষ থলিতে রাখলেন। ক্যাম্পে ফিরে প্রথমবারের মত চাক্ষুষ করলাম রিঙ পরানোর সময় একটি পাখির যাবতীয় মাপজোক নেওয়া, যত্ন সহকারে ফিলিপ রাউন্ডের রিঙ পরানো, পারলে প্রতিটা পালক ছুঁয়ে পাখিটার সম্পর্কে আরও বেশি জানার চেষ্টা করা।
ইনাম ভাই প্রশ্ন করলেন পাতি মাছরাঙ্গাটি পুরুষ না স্ত্রী? পুরুষ পাতি মাছরাঙ্গার দুইটি ঠোঁটই কালো হয়, আর স্ত্রী পাতি মাছরাঙ্গার উপরের ঠোঁটটি কালো হলেও নিচেরটি হয় লালচে বর্ণের।
সমস্ত কাজ শেষে ফিলিপ আমার হাতে মাছরাঙ্গাটি দিয়ে বললেন, ‘এখন এটাকে উল্টো করে হাতের তালুতে নিয়ে রাখ, একটা দারুন ঘটনার জন্ম হবে!’ হাতের তালুতে উল্টো করে শুইয়ে তাকে ধরে রাখার আঙ্গুলগুলো সরিয়ে নিলাম, মানে সে এখন মুক্ত, চাইলেন একটা গড়ান দিয়ে উড়ে মিলিয়ে যেতে পারে আপন ভুবনে। কিন্তু সে আরামে শুয়ে রইল হাতের তালুতেই, একেবারে নিশ্চিন্ত মনে!
ফিলিপ হেসে বললেন ‘ মাছরাঙার এই এক অদ্ভুত স্বভাব, উল্টো করে দিলে তারা যেন শিশুর মত ঘুমিয়ে পড়ে, নিজের থেকে আর সোজা হতে পারে না কখনোই’, এমনকি আলতো ফুঁ দিয়েও লাভ হল না, সে যেন আরও জাঁকিয়ে ঘুমানোর আয়োজন করতে লাগল! অবশেষে হাতের তালুটা সামান্য কাৎ করে দিতেই নীল পালকের তীরটা মিলিয়ে গেল বনের মাঝে।
তার পরপরই জালের কবলে পড়ে আমাদের অতিথি হল এক কালাপিঠ চেরালেজ। তাকেও যথেষ্ট যত্ন সহকারে সন্মানপূর্বক সমাদর করে বিদায় দেওয়া হল স্মৃতিস্বরূপ একটি রিঙ পরিয়ে।
এই পাখিটির পা অতীব পেলব, তুলতুলে, স্নিগ্ধ বর্ণের। মোটেও অন্যান্য পাখিগুলোর মত সরীসৃপের মত হতশ্রী পা নয়।
তার পরের অতিথি হলেন চমৎকার গানের পাখি গলাফোলা ছাতারে (Puff-throated Babbler)( ইদানিংকালের জলের গানের মনকাড়া গান ‘এমন যদি হতো, আমি পাখির মতো’ গানের শুরুতেই যে পাখির সংগীত আছে তা কিন্তু এই পাখিরই গান !), এবং ফিলিপ অবাক করে দিয়ে আমাকে দায়িত্ব দিলেন পাখিটি রিং করার!
হাতের মুঠোয় ক্ষুদে একটি প্রাণ! তুলতুলে বলের মত শরীরটার ভিতরে বয়ে চলেছে শাণিত রক্ত, ছোট্ট খুলির মাঝে তার চেয়েও ছোট মস্তিষ্ক, যে কিনা ঘোষণা করে চলেছে প্রাণের অস্তিত্ব! কী সুন্দর একটা পাখি! ইংল্যান্ডে হাজার দুই পাখি মাপ-জোকের আগে রিং করার কোন অনুমতিই মেলে না, সেখানে ফিলিপ বিশেষ অনুমতি দিলেন উৎসাহী কর্মী বাড়ানোর জন্যই মনে হয়। অন্য সবকিছুর মধ্যে পাখির ডানার মাপ নেওয়াটাই সবচেয়ে জটিল বলে মনে হল, কারণ সামান্য ভুলচুকেই ডানার মাপ অনেক কম-বেশী আসে। সবশেষে পাখিটিকে উড়ে যেতে দেখে কেমন যেন তিরতির করে উঠল বুকের ভেতর, এর অপর নামই বোধ হয় সুখ।
সেদিন সন্ধ্যায় আরও একাধিক পাখি আটকা পড়ল জালে কিন্তু বহুল কাঙ্ক্ষিত জলপাই বুলবুলের কোন হদিশ নেই! ইনাম ভাই অবশ্য বনের গভীরে একটাকে যাও বা দেখেছেন, কিন্তু গাইতে শোনেন নি। সেই পাখির পালকের জন্য দুই মানুষ উড়ে এসেছেন দূরের শ্যামদেশ থেকে, কী সাড়ে সর্বনাশ যদি তাদের ডাক অন্তত না শোনা যায় ! মাঝখান দিয়ে ঝামেলা বাড়াতে সাঁঝবেলা চার চারখান বাদুড় এসে জালে আটকা পড়ল! বাদুড় আটকানো মানেই এক বিশাল হুজ্জত, এমনকি জাল ছেড়ার সম্ভাবনাও থাকে, তাদের গাল ভরা নাম আবার False Vampire Bat, অনেক ঝামেলার পর তাদের ছাড়িয়ে ফিলিপ হাসতে হাসতে বলল ‘ এই যদি নকল ভ্যাম্পায়ার হয়, আমি আর আসলদের দেখতে চাই না’।
আগামীদিনের প্রত্যাশায় সেদিনের মত জাল গুটিয়ে রাখা হল, যদিও পরের সারা দিনও জলপাই বুলবুল তো বটেই অন্য পাখিদেরও তেমন সাড়া শব্দ মিলল না, মাঝে অবশ্য অশরীরী বন্ধুর মত এসে ঘুরে গেল একদল চশমাচোখা হনুমান,
কিন্তু জলপাই বুলবুলের সাড়া নেই একেবারেই। জালে এসে রিং পরে গেল কালাঘাড় রাজন, আরেকটা কালাপিঠ চেরালেজ, ছোট মাকড়মার সহ কয়েক প্রজাতির পালকাবৃত বন্ধুরা। সন্ধ্যার আগে আগে ধরা পড়ল একটি তাইগা চুটকি ( Taiga Flycatcher), পাখিটি হাতে নিয়ে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন ফিলিপ, সেটির বর্ণ নাকি একটু বেশী কমলারঙের, শুধু তাই না ওজনও বেশী খানিকটা বেশী।
ঘনিয়ে আসা বুনো আঁধারের প্রকোপেই হবে পাখিটি ছেড়ে দেওয়া হয়েছে ইতিমধ্যে, বিশ্রামাগারে ফিরে বইপত্র দেখে পাখিবিশারদ জানালেন পাখিটি একটি কাশ্মির চুটকিও(Kashmir Flycatcher) হতে পারে যা কিনা হবে বাংলাদেশের জন্য একটি নতুন পাখি!
কাশ্মীর থেকে প্রতি বছর শ্রীলঙ্কা যায় ক্ষুদে পাখিটি, বলা যায় না দলছুট কেউ বাংলাদেশ হয়ে যেতেও পারে! মুস্কিল হচ্ছে আমাদের কারো কাছেই পাখিটির পালকের বিন্যাসসহ অন্যান্য অঙ্গের খুব একটা ভাল ছবি নেই, ফলে নিশ্চিত করে বলাও যাচ্ছে না ! সবার মনের মাঝে একটা চাপা রোমাঞ্চ বাংলাদেশের জন্য নতুন পাখি আবিস্কারের। উল্লেখ্য যে আজ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত সবগুলো বার্ড রিং ক্যাম্পে ফিলিপ রাউন্ড এবং ইনাম আল হক ছিলেন, জালে আটকা পড়া পাখিদের মাঝে তারা বাংলাদেশের জন্যে নতুন এমন প্রজাতি পেয়েছেন সাতটি - বৈকাল ঝাড়ফুটকি ( Baikal Bush Warbler, Bradypterus davidi), পাশুয়া বনফুটকি (Aberrant Bush Warbler, Cettia flavolivacea), খয়রাচাঁদি বনফুটকি (Chestnut-crowned Bush Warbler, Cettia major), সাইক্সের ফুটকি (Sykes’s Warbler, Iduna rama) , কালাবগল বনফুটকি (Grey-sided Bush Warbler, Cettia brunnifrons), উদয়ী নলফুটকি (Oriental Reed Warbler, Acrocephalus orientalis), বড়ঠুটি নলফুটকি (Large-billed Reed Warbler, Acrocephalus orinuss)। সেই তালিকায় অষ্টম জন যুক্ত হলে বেশ দারুন এক কাজ হয় বইকি।
পর দিন প্রাতরাশের সময় ফিলিপ জানালেন রাতে স্বপ্নে তিনি পাখিটাকে দেখেছেন হাতের তালুতে বসে থাকতে, এবং তার ধারনা হচ্ছে সেটি আসলেই একটি কাশ্মীর চুটকি! এর মধ্যে সিদ্ধান্ত হয়েছে পাখির বিশেষ করে জলপাই বুলবুল বর্তমান ঋতুতে সেখানে সম্ভবত বেশী আসে না তাই অন্য কোন ট্রেইলে তাদের সন্ধান করার সময় হয়ে এসেছে, কাজে কাজেই ছড়াতে আজকে জাল পাতা হচ্ছে না, বরং খুঁজে দেখা হবে কোথাই জাল পাতলে জলপাই বুলবুল পাওয়া যেতেও পারে।
সারা দিন হাটা হল বনাঞ্চল কেটে তৈরি করা রাস্তা ও বাগানে, এমনকি ঘন বনের মাঝেও অন্য গাছ কেটে শুধু সেগুন লাগানো হয়েছে অত্যন্ত পরিকল্পিত ভাবে।
সেগুনে পাখি-পোকা না আসুক, টাকা তো আসে এমন একটা মনোভাব এই কাজের সাথে জড়িত সংশ্লিষ্টদের। পথে দেখ মিলল সবুজ ধুমকল ও পম্পাডুর হরিয়ালের, বিশেষ করে চিৎমরমের বুদ্ধ মন্দিরে যাবার পথে দেখা সবুজ ধুমকল দম্পতি এমনভাবে খোলা জায়গায় লোকালয়ে বসে ছিল যেন পোষা কবুতর!
আগের পরিকল্পনা ছিল কাপ্তাইয়ে রিং শেষে সদলবলে বান্দরবানে যাওয়া হবে, কিন্তু হরতালজনিত সমস্যার কারণে সিদ্ধান্ত হল কাপ্তাইয়ের নানা বনে আরও কয়েক দিন থেকে জলপাই বুলবুলে সন্ধান অব্যাহত রাখব আমরা। কাকতালীয় ভাবে পরের দিনই এক পাহাড়ি বনে কয়েকটা জলপাই বুলবুলের দর্শন মিলল, সনতায়ার মুখে যেমন আনন্দের ছাপ, তেমনি ইনাম ভাইয়ের মুখেও স্বস্তির ছাপ আমন্ত্রিত অতিথিদের আগমন সফল করতে পেরে। সেই বনেই জাল পাতার পরিকল্পনা করা হল পরের দিনগুলোতে।
পরের আড়াই দিন পাহাড়ি বনটাতে আমাদের জালে জলপাই বুলবুল আটক না হলেও তার ডাক ঠিকই রেকর্ড করতে সক্ষম হল সনতায়া, আশা করা যায় এতেই আপাতত ডিগ্রীর থিসিসের কাজ হয়ে যাবে তার, আর ভবিষ্যতে পাখির পালক পেলে আমরা তো পাঠাবই।
চমৎকার এলাকাটিতে অন্য অনেক পাখির সাথে এক অপার্থিব ভোরে দেখা মিলল বিশ্বের সবচেয়ে বড় কাঠঠোকরা বড় মেটেকুড়ালির (Great Slaty Woodpecker) চারজনের দলের, যারা একসাথে ঠক ঠক করে পোকা খোঁজার ফাঁকে ফাঁকে উড়ে বেড়াচ্ছিল বনের ক্যানোপির উপর দিয়ে। সেই দিনই, ২৮ নভেম্বর ঢাকার উদ্দেশ্যে বিমানে রওনা দিই আমরা।
কাপ্তাইয়ে সপ্তাহব্যাপী অবস্থানকালে আমরা দেখেছি এবং শুনেছি ১২১টি পাখির অস্তিত্ব, যার মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল আমার জন্য নতুন, এবং আমরা আশায় আছি ফিলিপের গবেষণা শেষে হয়ত জানতে পারব যে একটি পাখি ছিল বাংলাদেশের জন্যও নতুন। উল্লেখ্য যে সমগ্র দক্ষিণ এশিয়াতে একমাত্র বাংলাদেশেই নিয়মিত বার্ড রিংগিং এর ক্যাম্প আয়োজিত হচ্ছে, বছরে অন্তত দুইটা করে। এর ফলে হয়ত পাখিদের নিয়ে নতুন নতুন তথ্য জানা সম্ভব হবে, এবং বিশেষ করে জানা যাবে তাদের গতিপথ নিয়ে, যে জায়গাগুলো চিহ্নিত করার পর রক্ষার দায়িত্ব নিলে হয়ত এই নীল গ্রহে আরও কয়েক বছর বেশী টিকে থাকবে পাখির কূজন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।