মাঝে মাঝে বৃষ্টি দেখে হাত বাড়ানোর ইচ্ছে জাগে... ভেতর ভেতর যাই পুড়ে যাই, কেউ জানেনা আমার আগে...
তখনও মোবাইল ফোন আসে নি গ্রামে। কিন্তু প্রেম এসে গেছে!
আমি তখন কিসে পড়ি? ক্লাস ইলেভেন, না কি টুয়েলভ? মেয়েটাকে দেখেই বুকের ভেতর দম আটকে গেল। রাতভর কেমন কান্না কান্না লাগে। ঘুম হয় না। চোখ বুঝলেই সেই চোখ, সেই হাসি, সেই মুখ! কিন্তু উপায়? উপায় আবার কি? চিঠি! দুরুদুরু বুকে চিঠি লিখলাম।
সেই চিঠি বন্ধুরা নিয়ে গেলো। ফিরে আসলো করুণ মুখ করে। মিষ্টি মুখের নরম মেয়েটা কঠিন গলায় বলে দিয়েছে, ‘এই চিঠি সে নেবে না। সে আমাকে চেনে না’।
আমার ধারণা ছিল আমি ভীতু।
আসলেও তাই। মেয়েদের চোখের দিকে তাকিয়ে কথা বলতে পারি না। গলা শুকিয়ে যায়। হাত পা কাঁপতে থাকে। কি বলবো ভেবে পাই না।
দরদর করে ঘামতে থাকি। সেই আমার সেদিন হঠাৎ কি হোল! মুহূর্তেই দুরন্ত সাহসী হয়ে গেলাম। চিঠিটা বুক পকেটে নিয়ে পরদিন ভোরে দাড়িয়ে রইলাম রাস্তার পাশে। সে আসলো। আমি খুব ধীর পায়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
তারপর বুক পকেট থেকে চিঠিটা বের করে কুচিকুচি করে ছিঁড়ে হাওয়া উড়িয়ে দিলাম। সে অদ্ভুত দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল। আমি সহজ গলায় বললাম, ‘প্রেম করতে হলে চিঠির দরকার নেই, তাই না?’
সে জবাব দিল না। অদ্ভুত চোখে তাকিয়েই রইলো। আমি আবার বললাম, ‘প্রেম করতে যা দরকার, তা আমার আছে।
চিঠিটা যেখানে ছিল, ঠিক সেখানেই। ঠিক এই বুক পকেটের নিচেই’।
সে অবাক গলায় বলল, ‘কি?’
আমি বললাম, ‘মন’।
সে বলল, ‘ওটাতো সবারই থাকে’।
আমি বললাম, ‘থাকে, তবে সবারটা আমার মতো না’।
‘আপনার মতো না কেন?’
‘কারণ, আমারটা দেখতে পায়'।
সে কোন জবাব দিল না। আমাকে পাশ কাটিয়ে হেঁটে চলে যাচ্ছিল। আমি শান্ত পায়ে পিছু নিলাম, ‘তুমি আমাকে চেনো না?’
সে এবারও জবাব দিল না। চুপচাপ হেঁটে যাচ্ছে।
আমি সামনে গিয়ে পথ আটকে দাঁড়ালাম।
‘আমাকে চেনো না?’
‘নাহ। ’
‘চিনতে চাও’
‘নাহ’
‘তাহলে কি করে হবে? চিনতে চাইতেতো হবে। চাও?’
সে মাথা নাড়ল, ‘নাহ’।
‘কেন?’
‘ইচ্ছা নেই’।
‘ইচ্ছে নেই কেন?’
‘সেটা ইচ্ছে জানে, আমি কি করে জানবো?’
আমি আরেকটু কাছে এগুলাম। সে ভয় পেয়ে গেলো। আমি কাছে এগিয়ে নীচু গলায় বললাম, ‘তাহলে আমি বলি?’
সে এবারও জবাব দিল না।
আমি বললাম, ‘চিঠি পড়ে আমাকে চিনতে হবে না। তুমি বলো কি জানতে চাও?’
সে বলল, ‘কিছুই জানতে চাই না’।
আমি বললাম, ‘এদিকে তাকাও’।
সে তাকাল। তার চোখে ভয়। আমি সেই চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, ‘আমি সুমন। এইচএসসি পড়ি।
লম্বায় ৫ ফিট ৮, ওজন ৫১ কেজী। উচ্চতা অনুযায়ী এই ওজন মারাত্মক আন্ডারওয়েট। প্রায় ১৫ কেজী কম। এই জন্য আমার শরীরের এই বেহাল দশা। নানু বলেন, আমি নাকি তাল পাতার সিপাই।
বাতাসে ফুঁ দিলেই উড়ে যাবো। তবে নানু আরেকটা কথাও বলেন, আমাকে বিয়ে দিলে নাকি আমি মোটা হয়ে যাবো। সেক্ষেত্রে অবশ্য বউয়ের ভালো রান্না জানতে হবে। সুতরাং বুঝতেই পারছ, এই সমস্যার সমাধান তোমার হাতে। তুমি বাচ্চা মেয়ে, আমিও বাচ্চা ছেলে।
সুতরাং এখুনি বিয়ে সম্ভব না। হাতে সময় আছে। এই সময়ের মধ্যে রান্না বান্না শিখে নাও। কিন্তু দয়া করে হাতে মশলার দাগ লাগাবে না। খবরদার!’
সে গোলগোল চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
সেই চোখ আরেকটু হলেই কোটর ছেড়ে বেড়িয়ে যাবে। আমি বললাম, ‘আমি ছাত্র মোটামুটি ভালো। তবে পড়াশোনা করতে ইচ্ছা করে না। ম্যাট্রিকে অংকে পেয়েছি ৩৩, কানের লতি ছুঁয়ে গুলি গেছে। সামনে এইচএসসি পরীক্ষা।
অংকের ভয়ে এইবার কমার্স নিয়েছি। কিন্তু এইবার সমস্যা হোল ইংরেজী। আমার ধারনা, এইবার ইংরেজীতে গুলি আর কানের লতি ছুঁয়ে যাবে না, কান ফুটো করে মাথায় ঢুকে যাবে। ঘটনা ক্লিয়ার?’
ঘটনা তার কাছে ক্লিয়ার কি না বোঝা গেলো না। তবে তার হতভম্ব ভাব গভীর হয়েছে, এটা পরিষ্কারভাবে ক্লিয়ার।
আমি হঠাৎ চোখের চশমা খুলে শার্টের কোনায় মুছতে মুছতে বললাম, ‘ওহ, আরেকটা কথা। আমি চোখে কম দেখি। মারত্মক রকম কম। আমার চোখের পাওয়ার প্রতিদিন একটু একটু করে কমছে। ডাক্তার বলেছে, কোন একদিন আমি পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যাবো।
অন্ধ। তখন আর কিছু দেখতে পাবো না। কিচ্ছু না’।
বলে হাসলাম। সে আমার চোখে চোখ তুলে তাকাল।
ধীর। স্থীর। তার চোখে কি? জল?
আমি ফিসফিস করে বললাম, ‘ভয় পাওয়ারতো কিছু নেই, তোমাকে দেখতে আমার চোখেরতো দরকার নেই’।
‘মানে?’
‘ঐযে বললাম, বুক পকেটের নিচে একটা জিনিস আছে’।
‘তো?’
‘ওতেই দেখে নেব’।
‘কি আছে?’
এবার আমি জবাব দিলাম না। এক পা সরে গিয়ে ঘুরে দাঁড়ালাম। হাঁটছি।
আচ্ছা, সে কি দাঁড়িয়েই আছে? না ছুটে আসছে?
----------------------------------------------------
সকল চরিত্র কাল্পনিক/সাদাত হোসাইন
১৩.০১.২০১৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।