বেশি কিছুদিন আগে এক বড় ভাই বেশ সতর্কতার সুরে বলেছিলেন “ওয়েলকাম টু আই টি, বাট বি অ্যাওয়ার অফ ইনডিয়ান বস” বিষয়টি মাথায় রেখেই নিউইয়র্ক থেকে সুদূর অরেগনে হিজরতের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। বারবার একটি প্রশ্নই ঘুরে ফিরে মাথায় আসছিলো “এই দুর্বল ঈমানদ্বারকে আল্লাহ্ আবার কোন নতুন ঈমানের পরীক্ষায় অবতীর্ণ করছেন?”
একজন নাফিস
ফ্লাইট বুকিং, হোটেল রিজার্ভেশন থেকে শুরু করে সবকিছু ঠিকঠাক, ১৭ই অক্টোবর সন্ধ্যায় বাসায় চায়ের কাপ হাতে দাড়িয়ে এনবিসি নিউজ দেখছিলাম। শিরোনাম শুনে আত্নারাম খাঁচা থেকে বের হবার অবস্থা। ২১ বছর বয়সী বাংলাদেশী ছাত্র নাফিস নাকি আমেরিকার গুদাম উড়িয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা করেছেন। অর্থাৎ তিনি ভুলক্রমে অথবা ওয়াকিবহাল হয়েই গোবরে পা দিয়েছেন।
যাহোক আড়াই বছর নিউ ইয়র্কে বসবাস করে নিউ ইয়র্কের সব রাস্তাঘাট ভালোকরে চিনলাম না! সেই স্থলে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও মাত্র কয়েক মাস অবস্থান করা একজন ছাত্র এতোকিছু জানবে সেইটা বিশ্বাস করা একটু দুরহ বটে। তবে মনে মনে যা ভেবেছিলাম সেই আশংকাই সত্যি হলো, তাও আবার চূড়ান্ত মুহূর্তে। চাকুরীর অফার ঝুলন্ত অতএব ফ্লাইট এবং হোটেল রিজার্ভেশন বাতিল করতে হবে। এইচ আর মহিলা সুন্দর কণ্ঠে জানালেন “জনাব হামিদ অনিবার্য কারণবশত আপনার জয়েনিং ডেইট আপাতত ঝুলন্ত”। আমরা কোম্পানির পলিসি অনুযায়ী পরবর্তী আপডেইট জানাবো।
কোরবানির আগে আরও একবার কোরবানি হওয়ার আইডিয়াটা মন্দ না। ইতি মধ্যে তারা ইমেইল করে আমার পিতার নাম ও বাংলাদেশের ঠিকানা নিয়েছে দ্বিতীয়বারের মতো করে ব্যাকগ্রাউনড চেক করার কথা বলে।
তিন সাপ্তাহ পর... “অভিনন্দন জনাব হামিদ, আপনার ইতিহাস চমৎকার, আমরা আপনার সম্পর্কে ইতিবাচক তথ্য পেয়েছি, অতএব আপনাকে দ্রুত আপনার উল্লেখিত কর্মস্থলে রিপোর্ট করার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি”
সব জল্পনা কল্পনা শেষে সেই মহেন্দ্রক্ষন। ইউএস এয়ার ওয়েজের মুড়ির টিনে চড়তে হবে এবার। প্রাথমিক গন্তব্যস্থল ফিনিক্স, অ্যারিজোনা।
তবে মুড়ির টিন আরোহণ অতটা মসৃণ ছিলো না বরং কিছুটা বন্ধুর বটে। আমেরিকার অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটে ভ্রমণকালে ব্যাক্তিগত ফটো আইডি হিসেবে ড্রাইভার’স লাইসেন্সই দেখা হয়। নিউ ইয়র্ক এয়ারপোর্টে চেক ইনের সময় সবার মতো আমিও ড্রাইভার’স লাইসেন্স এগিয়ে দিলাম। মহিলা কিছুক্ষণ নেড়েচেড়ে দেখে জিজ্ঞাসা করলো
ঃ ডু ইউ হ্যাভ অ্যানি অ্যাদার ফটো আইডি?!
এই ধরণের পরিস্থিতির জন্য আগের থেকেই প্রস্তুত ছিলাম। তাই দ্রুত পাসপোর্ট এগিয়ে দিয়ে ঝামেলা মুক্ত হলাম।
তবে প্লেনে উঠার পর কেমন যেন শুন্যতা বিরাজ করছিলো। যতই অভিকর্ষের বিপরীতে ছুটছি ততোই শুন্যতা অনুভূত হতে লাগলো। পার্থিব ভরের ব্যাস্তানুপাতে মনের শুন্যতা কেবল বেড়েই চললো। জানালার দিকে কিছুক্ষন হেলে ফেলে আসা নিকট অতীতের স্মৃতিচারণ করতে লাগলাম। গত ত্রিশ মাসে বেস ভালোই শিকড় গেড়েছি।
পাশের সিটে বসা স্প্যানিশ মেয়ে কানের মধ্যে হেড ফোন গুঁজে দিয়ে সওয়াব কামাচ্ছে আর হাতে উন্নত মলাটের সস্তা ম্যাগাজিন। মাঝে মাঝে প্রসাধনী বের করে রূপ চর্চাও চলছে। এক কথায় মাল্টি টাস্ককিং বলা যায়। যাহোক, এটা নতুন কিছু নয়, নিউ ইয়র্কের সাবওয়েতে (পাতাল রেল) অফিস টাইমে তীব্র জ্যামের মধ্যে দাড়িয়ে যাতায়তকালেও তারা একই কাজ করে। এতো এতো বিল বোর্ড, কমার্শিয়াল, অ্যাটেনশান হাঙ্গরী না হয়ে উপায় আছে!
এইসব গতানুগতিক তামশা দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি তা টেরই করতে পারিনি।
হঠাৎ ক্রু’র ভেসে আসা ঘোষণা “আমরা বর্তমানে গ্র্যান্ড ক্যানিয়নের উপর দিয়ে যাচ্ছি” জানালা দিয়ে জীবনে প্রথমবারের মতো পৃথিবীর বৃহত্তম গিরিখাদ দেখলাম।
কিছুক্ষন পর রৌদ্রোজ্জল ফিনিক্স শহর নিকটবর্তী হতে লাগলো। আমার প্রাথমিক গন্তব্য স্থল। চারদিকে পর্বতে ঘেরা সমতল ভূমির উপর বেশ বড় শহর ফিনিক্স। অ্যারিজোনা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী।
বিমান অবতরণের পর আমার পরবর্তী গন্তব্য পোর্টল্যান্ড, অরেগনের ফ্লাইট খোঁজ করতে লাগলাম। ফিনিক্স এয়ারপোর্টে দীর্ঘ এক কিলোমিটার হাঁটার পর রীতিমতো ঘাম ঝরতে লাগলো। আর আশেপাশের মানুষজন কে দেখলাম হালকা জামাকাপড় গায়ে দিয়ে ছুটে বেড়াচ্ছে। নিউ ইয়র্কের তুলনায় এই স্থান বেশ উষ্ণ। অনেকটা বাংলাদেশের মতো।
মেক্সিকান সীমান্ত ঘেঁষা বিধায় হিস্পানিক জনসংখ্যার অধিক্য চোখে পড়ার মতো।
বেলা ১১ টা, পোর্টল্যান্ডের ফ্লাইট ছাড়তে আরও আধা ঘণ্টা বাকি। পাকস্থলীর অবস্থা খুব একটা সুবিধার না। কিন্তু আশেপাশে হালাল খাবার খুঁজে বের করা বেশ দুষ্কর। যাহোক অবশেষে সহায় হলো ফ্রেঞ্চ টোষ্ট।
কোনমতে স্বাদ আস্বাদন না করে পানি দিয়ে পাঁচ পাঁচটি ফ্রেঞ্চ টোষ্ট গিললাম। এবার বিমানে উঠার পালা। ভারী জামাকাপড় কিছুক্ষনের জন্য খুলে রেখেছিলাম তবে পরবর্তী গন্তব্যের কথা চিন্তা করে বিমানে উঠার আগে পরে নিলাম। এবার সহযাত্রী কোনো তরুণী নয়। বয়স্ক যুগল, কাকতালীয় ভাবে এবারও জানালার পাশে আসন পাতলাম।
বিমান উড্ডয়নের কিছুক্ষন পর লক্ষ্য করলাম ভদ্রমহিলার হাতে হ্যামিংওয়ের “দ্যা ওল্ড ম্যান অ্যান্ড দ্যা সী”, আলাপচারিতার প্রারম্ভে জানলাম উনারা ফিলি (ফিলাডেলফিয়া) থেকে একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে যোগদিতে পোর্টল্যান্ড যাচ্ছেন। সদ্য প্রেসিডেন্ট নির্বাচন নিয়েও অনেক আলোচনা হয়েছে। শ্বেতাঙ্গ হওয়ায় কৌশলে তাদের রাজনৈতিক মনোভাব জেনে নিলাম। কথাবার্তা শুনে ড্যামোক্রেট মনে হলো!
মাউন্ট হুড
বেলা প্রায় ১ টা, বিমান পোর্টল্যান্ড (পিডিএক্স) এয়ারপোর্টের কাছাকাছি আশার পর লক্ষ্য করলাম চারদিক সাদামেঘে ঢাকা। সুদূরে অরেগনের বিখ্যাত মাউন্ট হুডের প্রচ্ছন্ন অবয়ব।
আস্তে আস্তে পাহাড়ে ও হ্রদে ঘেরা পোর্টল্যান্ডের ল্যান্ডস্কেপ দৃশ্যমান হতে লাগলো। তবে আমি মোটেও উৎসাহিত হলাম না! নিদিষ্ট সময়ে বিমান অবতরণের পর ল্যাগেজের খোঁজে ছুটলাম ......
চলবে
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।