যখন পেয়েছি পথের দেখা তখন আবার দিকভ্রান্ত হয়ে হারিয়েছি পথ.........
গল্পটি কে লিখেছিলো তা আমি জানিনা। আমি এও জানিনা ঘটনাটি কোন সময়কার- কিংবা এটির সন তারিখই বা কি? কিন্তু এটি একটি জনপ্রিয় প্রবাদে পরিনত হয়েছে। ঘটনার নায়ক রাস্তার পাশের এক অবোধ শিশু। প্রধান পাত্র পাত্রী হলেন- একজন তোষামোদ প্রিয় পাগলাটে টাইপের রাজা এবং তার বিশাল তোষামোদে বাহিনী। অতি সরল একটি কাহিনী - রাজার হঠাৎ খেয়াল হলো- দুনিয়ার সবচেয়ে চিকন, মিহি আর মসৃন কাপড়ের পোশাক তিনি পরবেন।
রাজ্যময় ঘোষনা দেয়া হলো। রাজ্যের সব তাঁতীরা দিনরাত পরিশ্রম করে রাজার জন্য বস্ত্র বানাতে লেগে গেলো। রাজার কোন কাপড়ই পছন্দ হয়না। আরো চিকন, আরো মসৃন এবং আরো মিহি কাপড় তার চাই। দিনের পরদিন চলে গেল, তারপর মাস- কিন্তু রাজার স্বপ্ন পুরুন হয়না।
রাজা রাগের চোটে তাতীদেরকে জোলা বলে গালি দিয়ে দুর দুর করে তাড়িয়ে দিলেন। আর উজির নাজিরকে জোলার বাচ্চা জোলা বলে গালি দিতে লাগলেন।
অশ্লীল শব্দ উচ্চারনে রাজার ভারী নাম ডাক ছিলো বহুদিন থেকে। উজীর নাজিররা সব গালাগালি খেতে খেতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিলো। মাঝে মধ্যে তাদের অবস্থা এমন হতো যে, একদিন গালি না খেলে তাদের একদম ভালো লাগতো না।
এজন্য তারা ইচ্ছে করেই রাজার সামনে গিয়ে নির্বোধের মতো কান্ড কারখানা করে বসতো। আর রাজা তাদেরকে পর্যাপ্ত গালি গালাজ করে বিদেয় দিতেন। রাজ আমাত্যরা সেসব গালিকে প্রসাদ বা অমৃত মনে করে মনের আনন্দে বাড়ী ফিরতেন আর তৃপ্তির ঢেকুর তুলতেন। এভাবেই চলছিল বহুদিন। কিন্তু রাজা যখন জোলার বাচ্চা জোলা বলে গালাগালি আরম্ভ করলেন তখন পাত্র মিত্ররা সব পাগল হবার উপক্রম হলো।
কারন গালিটি ছিলো নতুন এবং অদ্ভুত। রাজা মুখ ভেংচিয়ে যখন চিৎকার করে হুন্কার দিয়ে বলতো- কইরে জোলার বাচ্চা জোলারা! আমার পছন্দের কাপড় কই! কেনো তোরা এখনো পারলি না- তোদের মতো জোলাদেরকে উজির নাজির না বানিয়ে গরু ছাগলকে বানালেও এতোদিনে ভালো ফল পেতাম।
পাত্র মিত্ররা সব গোপন বৈঠকে বসলো। তারপর সিদ্ধান্ত নিলো এমন কাপড় তারা রাজার জন্য বানাবে যা চোখে দেখা যাবে না, হাত দিয়ে স্পর্শও করা যাবে না এবং সেই কাপড় পরলে রাজা টেরই পাবে না। সকলে মিলে কাপড় তৈরীর পরিকল্পনা করলো।
তারপর কিভাবে রাজাকে সেই কাপড় পরাবে তার জন্য পর্যাপ্ত অনুশীলন করলো এবং সেই কাপড় পরিয়ে কিভাবে রাজাকে জনগনের মধ্যে ঘুরিয়ে আনবে তারও দফা রফা করলো। সব শেষে তারা রাজার কাছে সদল বলে উপস্থিত হয়ে জানালো যে- খুব তাড়াতাড়ি তারা রাজার জন্য এমন কাপড় নিয়ে আসবেন যা ইতিপূর্বে দুনিয়ার কোন রাজা বাদশাহ পরিধান করেননি। রাজা মনের আনন্দে বড় বড় নিঃশ্বাস নিলেন এবং খুশিতে টগবগ করতে করতে উজির নাজিরদেরকে কাছে ডেকে নিলেন। তারপর সোহাগ করে একটু বকে দিলেন- ওরে আমার জোলার বাচ্চারে- তোরা আছিস বলেই তো আমার জনম স্বার্থক।
রাজার কথিত জোলার বাচ্চারা নির্দিষ্ট দিনে রাজাকে সেই অদ্ভুত কাপড় পরালো।
নতুন কাপড়ে রাজার সৌন্দয্যের এমন বাহারী ঝলক সৃষ্টি হলো যে রাজ দরবারের উজির নাজির, সেনাপতি, কোতোয়াল আর অস্ত্রধারী সিপাহীরা মারহাবা ইয়া মারহাবা! বলে সমস্বরে কোরাস করে গান গাইতে লাগলো। রাজা বুঝলেন- তিনি সত্যিই অদ্ভুত সুন্দর অস্পর্ষীয় বস্ত্র পরিধান করেছে। রাজাকে নিয়ে আসা হলো রাজ দরবারের বাইরে; জনগনের মধ্যে। উজির নাজিরদের ভাড়াকরা হাজারো জনতা রাজাকে মারহাবা! ইয়া মারহাবা বলে করতালী দিয়ে স্বগত জানালো। এভাবে সবকিছু ভালই চলছিলো।
কিন্তু গোল বাঁধালো এক অবোধ বালক। সে এগিয়ে এসে বললো- রাজা বাবু, ও রাজা বাবু তুমি তো ন্যাংটা!
গল্পকার তার গল্পটি ওখানেই শেষ করেছেন। ফলে আমরা জানতে পারিনি- বালকের কথা শুনে রাজার বোধোদয় হয়েছিলো কিনা! কিংবা সত্য কথা বলার জন্য নির্বোধ বালকটির কি পরিনতি হয়েছিলো। অথবা পাত্র মিত্রদেরই বা কি পরিনতি হয়েছিলো। যাহোক- গল্পের মর্মকথা হলো দু’টি- প্রথমতঃ মানুষ যখন সাধ্যের বাইরে কোন কিছু দাবী করে বসে তখন তাকে অবশ্যই প্রতারিত হতে হয়।
দ্বিতীয়ত- চাটুকারেরা পারে না এমন কোন কর্ম নেই।
চাটুকার এবং চাটুকারীতা নিয়ে বহু কাহিনী কিংবা কল্প কাহিনী রচিত হয়েছে যুগে যুগে। এর উপকারীতা এবং ক্ষতিকর দিক নিয়ে পরস্পর বিরোধী গবেষনা কর্ম চলে আসছে অনাদী কাল থেকে আজ অবধি পর্যন্ত। কিন্তু পৃথিবীর কোন পন্ডিত যেমন চাটুকারীতা এবং চাটুকার সম্পর্কে অনুসিদ্ধান্তে পৌছতে পারেননি তেমনি পৃথিবীর কোন মহান রাজা বাদশাহ থেকে শুরু করে নরাধম শাসকেরা পর্যন্ত এদের খপ্পর থেকে বাঁচতে পারেননি। যেভাবে বাঁচতে পারেননি ভারতের অন্যতম সেরা এবং মহান শাসক রাজা হর্ষবর্ধনও।
তিনি চাটুকারদের সম্পর্কে চমৎকার একটি বাক্য বলে গেছেন। সেই বাক্যটি বলার আগে রাজা হর্ষবর্ধনের দুঃখের কাহিনীটি বলে নেই।
রাজা হর্ষবর্ধন ছিলেন প্রাচীন ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত এবং যুদ্ধজয়ী সম্রাট। সমগ্র উত্তর ভারত জুড়ে ছিলো তার রাজত্ব। তার রাজত্বকাল ছিলো ৬০৬ খ্রীষ্টাব্দ থেকে ৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দ অবধি।
১৬ বছর বয়সে সিংহাসনে আরোহন করে তিনি দীর্ঘ ৪১ বছর রাজত্ব করে যখন ৬৪৭ খ্রীষ্টাব্দে মারা যান তখন তার বয়স মাত্র ৫৭ বছর পূর্ন হয়েছিলো। সারা পৃথিবী তখন ধারন করেছিলো সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানুষগুলো। অর্থাৎ এই সময়েই আল্লার রাসুল মদিনা রাষ্ট্রের সূচনা করেছিলেন। রোমেও ছিলো সুশাসন। আর চীন দেশ ও পারস্যেও ভালো ভালো রাজারা রাজত্ব করতেন।
এই কথা বলার অর্থ- ভালো মানুষেরা যেমন একসঙ্গে আর্বিভূত হন তেমনি শয়তান ও বজ্জাতেরাও পয়দা হয় একই সময়ে।
যা বলছিলাম রাজা হর্ষবর্ধনের কথা। এতো বড় মহান শাসক যার শিক্ষা দীক্ষা, জ্ঞান গরিমা, ধর্মবোধ, নীতি-নৈতিকতা- কোন কিছুরই অভাব ছিলোনা- তিনিও কিন্তু চাটুকারের খপ্পর থেকে বাঁচতে পারেননি। তার সভা কবির নাম ছিলো বানভট্র-মস্তবড় কবি। ভারত বর্ষে তার সঙ্গে তুলনা করা যায় কেবল মহাকবি কালিদাসকে।
সেই বানভট্রের প্রধান দোষ ছিলো চাটুকারীতা। অত্যন্ত সুকৌশলে, চমৎকার ভাষার সংমিশ্রনে, স্থান কাল পাত্র ভেদে তিনি তার চাটুকারীতা এমন ভাবে উপস্থাপন করতেন যে- রাজা হর্ষবর্ধনের সাধ্য ছিলোনা বানভট্রকে এড়িয়ে চলে তার প্রভাবমুক্ত হয়ে কোন কিছু করা। তাই রাজা একবার আফসুস করে বলেছিলেন- ”শাসকের সব চেয়ে বড় বিপদ হলো তার চাটুকার বাহিনী। আর শাসকের সবচেয়ে বড় দূর্ভাগ্য হলো কোন শাসকই সবকিছু জানা সত্বেও চাটুকার ছাড়া চলতে পারে না। ”
হাজার হাজার বছর ধরে চাটুকার ও চাটুকারীতা নিয়ে এতো যে পদ্য কিংবা গদ্য লিখা হলো তাতে করে সমাজে এদের উপদ্রুপ কিন্তু কমেনি।
বরং বেড়েছে অনেকটা জ্যামিতিকহারে। হর প্রসাদ শাস্ত্রী নামের এক বিখ্যাত পন্ডিত ব্যাক্তির তৈল নামক প্রবন্ধটি আমরা অনেকেই পড়েছি। তিনি হয়তো গত শতাব্দীর চল্লিশের দশকের প্রেক্ষাপটে চাটুকারদের ক্রীড়াকর্ম বোঝাতে তৈল শব্দটি ব্যবহার করেছেন। কিন্তু এযুগে আমরা কি শব্দ ব্যবহার করবো! এখন যে সবকিছু ডিজিটাল পদ্ধতিতে হয়। ডিজিটাল মেশিনে তেল লাগেনা; লাগে বিদ্যুৎ, সোলার শক্তি কিংবা ব্যান্ডউইত।
আচ্ছা আমরা যে চাটুকারদের বিরুদ্ধে কোমরে গামছা বেঁধে নেমে পড়লাম কিন্তু একবারও কি ভেবে দেখেছি কেন আমরা তাদের বিরোধিতা করছি! তারা দুনিয়া বা আখেরাতে মানুষ্য সমাজের কি এমন ক্ষতি করে যে তাদের বিরুদ্ধে উঠে পড়ে লাগতে হবে? হাঁ ক্ষতি করে অবশ্যই করে। সমগ্র মানব সভ্যতাকে তারা গলাটিপে হত্যা করে। তারা সর্ব প্রথমে নিজেরা মানুষ থেকে অমানুষ হয়ে যায় এমন অমানুষ যা কোন নিকৃষ্ট জানোয়ারের সঙ্গেও তুলনীয় নয়। এরপর তারা তাদের মনিবকে নিজেদের চেয়েও বড় অমানুষ বানানোর খেলায় মেতে উঠে ঠিক বিড়ালের মতো। এখানে বিড়াল প্রসঙ্গটি আনলাম অন্য একটি কারনে।
সাম্প্রতিক কালে বিজ্ঞানীরা বিড়ালের মন মানষিকতা এবং চিন্তা চেতনা নিয়ে বিস্তর গবেষনা করে চমৎকার একটি তত্ত্ব আবিস্কার করেছে। তত্ত্বটি বলার আগে বিড়াল নিয়ে আমার ভাবনার কিছু অংশ তুলে ধরছি।
প্রবাদ রয়েছে মানুষ পছন্দ করে বাঘ কিন্তু ঘরে পোষে বিড়াল। বিড়ালের মধ্যে হাজারো রোগ বালাই আর নোংরামী থাকা সত্ত্বেও কিছু মানুষ বিড়াল পোষে পরম যতœ আত্মি করে। কারন তেমন কিছু না- বিড়ালের র্নিলজ্জ বেহায়াপনা তাদের খুবই ভালো লাগে।
ইচ্ছে মতো লাথি গুতো দেবার পরও বিড়াল ঘুরে ফিরে তার মনিবের কাছেই আসবে। তার গা ঘেঁষে বসবে। পায়ের ওপর মাথা ঘষবে। মনিব ইচ্ছে হলে বিড়ালটিকে কোলে তুলে নিবে আবার যখন তখন কিল, গুতো, লাথি কিংবা জুতাপেটা করবে। এতে কিন্তু বিড়াল একদম মাইন্ড করে না।
মনিবের আদর ও জুতা পেটা-দুটোই সে সমান গুরুত্ব ও তাজিম সহকারে ভোগ করে। এই বিড়ালদের সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞান বলেছে- ” প্রতিটি বিড়াল তার মনিবকে তারই মাতা বিড়াল বলে মনে করে- তবে ছোট নয়- তার চেয়ে কিঞ্চিত বড় আকৃতির বিড়াল। ”
বিড়াল থেকে আবার চাটুকার প্রসঙ্গে ফিরে আসি। চাটুকারেরা তাদের ক্রমাগত চাটুকারীতা দ্ধারা আমাদের স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি, স্থিতিশীলতা ও সৃজনশীলতাকে নষ্ট করে ফেলে। তারা তাদের মুনিবের বিচার করার ক্ষমতাকে ধ্বংশ করে দেয়।
বিবেক ও বোধ শক্তিকে মেরে ফেলে। তাকে অতি মানব বানানোর অপকৌশল করতে থাকে দিবারাত্র। ফলে মনিবের মধ্যে দেখা দেয় অহংকার। অহংকারী মানুষ নিজেকে নিজের অজ্ঞাতেই মহান আল্লাহ পাকের প্রতিদ্বন্দি বা প্রতিভূ হিসেবে ভাবতে শুরু করে। আর তখন থেকেই শুরু হয় বিপত্তি যেমনটি হয়েছিল বিখ্যাত এবং তৎপরবর্তী সময়ে কুক্ষাত ফেরাউন রামেসীস দি সেকেন্ডের ক্ষেত্রে।
ইদানিং কালের রাষ্ট্রও সমাজ ব্যবস্থায় দেশে দেশে যে অশান্তি চলছে তার মূলে কিন্তু ব্যক্তি বিশেষের অহংকার, একগুয়েমী এবং নির্বুদ্ধিতা দায়ী। নেতার বড় গুন তার অনুপম নেতৃত্ব দেবার সহজাত সৌন্দর্যের মধ্যে যা কিনা তিনি পেয়ে থাকেন জন্মগত ভাবে। নেতার ছেলে যেমন নেতা হয়না- তেমনি রাজার ছেলেও রাজা হয়না- হওয়াও উচিত নয়। কিন্তু অসুবিধা নেই চাটুকাররা আছে না। তারা গিয়ে অযোগ্য উত্তরাধিকারীদের সামনে পূজার প্রনতি ঢালবে- তারপর বলবে হে জনগনের নায়ক-নায়িকা এতোকাল কোথায় ছিলেন।
আপনাদের বিহনে জাতি যে আজ দিশেহারা। আসুন জাতিকে উদ্ধার করুন।
আমরা আজকের বিষয়ের একদম শেষ পর্যায়ে চলে এসেছি। আমার মনে হচ্ছে এখন চাটুকার ও তাদের মনিবের চিরায়ত পরিনতি সম্পর্কে কিছু বলা দরকার। এক কথায় শেষ পরিনতি কোনদিন ভালো হয়নি এবং হবেও না।
অতীতে যা ঘটেছে তা হলো- চাটুকারেরা তাদের মনিবকে হয় প্রানে মেরে ফেলেছে নয়তো মনিবের সবর্স্ব কেড়ে নিয়ে তাকে ভিখেরী বানিয়ে ছেড়েছে। উল্টোটাও হয়েছে- মনিবের হাতেই চাটুকারদের মৃত্যু হয়েছে অথবা মনিব নিজেই তার পছন্দের জোলার বাচ্চাদেরকে সিংহাসন থেকে বহু দূরে নির্বাসন দিয়ে সারা জীবনের জন্য ভিক্ষুক বা পঙ্গু বানিয়ে ছেড়েছে। সমস্যা শুধু মাঝখানের সময়টুকু!
সুত্র- রনি ফেবু!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।