ডাক্তার-নার্সদের ছুটি ও ঘন ঘন বদলির কারণে সুনামগঞ্জ সদর হাসপাতালের ভেঙেপড়া স্বাস্থ্যসেবা, অন্যদিকে নোংরা-দুর্গন্ধময় পরিবেশ দেখে ক্ষুব্ধ এমপি পীর মিসবাহ। ডাক্তার ও নার্সদের 'জনস্বার্থে' এখানে বদলি করা হলেও জনস্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে তারা তদবির করে 'ব্যক্তিস্বার্থে' চলে যাচ্ছেন পছন্দের জায়গায়। মাঝে কিছু দিন অফিস করার কথা থাকলেও অর্জিত ও সাধারণ ছুটির নিয়ম দেখিয়ে পুরো সময়ই অনুপস্থিত থাকেন কর্মস্থলে। দীর্ঘদিন ধরে এ অবস্থা চলায় পুরো স্বাস্থ্যসেবা ভেঙে পড়েছে। ফলে সাধারণ রোগীরা সেবাবঞ্চিত আছেন।
রোগীদের কাছ থেকে এসব অভিযোগ পেয়ে রবিবার সকালে হাসপাতাল পরিদর্শন করেন সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ্। এ সময় ডাক্তার, নার্স ও সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে সাধারণ রোগীদের সর্বোচ্চ সেবা দেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন তিনি। পাশাপাশি রোগীদের দুর্ভোগে ফেলে অন্যায়ভাবে যাতে কেউ বদলি না হতে পারেন সেদিকেও নজর রাখতে বলেছেন। আগামী সংসদ অধিবেশনে সুনামগঞ্জের স্বাস্থ্যসেবা, শিক্ষা ও হাওরের ফসল রক্ষাবাঁধের বিষয়েও কথা বলবেন বলে জানিয়েছেন তিনি। এমপি এ দিন হাম-রুবেলা টিকাদানের উদ্বোধন করেন।
একই সঙ্গে হাসপাতালের নোংরা-দুর্গন্ধময় পরিবেশ, রংচটা ময়লা দেয়াল তাকে ব্যথিত করে। তিনি পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার উদ্যোগ নেবেন বলেও জানান।
সুনামগঞ্জ সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২৫০ শয্যার অনুমোদনসপ্রাপ্ত সদর হাসপাতাল ১০০ শয্যার অবকাঠামোয় চলছে। যোগাযোগবিড়ম্বিত ও হাওর অধ্যুষিত স্বাস্থ্যসেবায় পিছিয়ে পড়া এ জেলার সদর হাসপাতালে ৬৩ জন ডাক্তারের বিপরীতে আছেন মাত্র ১৩ জন। নার্স ১৮৪ জনের মধ্যে কর্মরত আছেন মাত্র ৫৬ জন।
জনদাবির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন সময়ে হাসপাতালে ডাক্তার ও নার্স দেওয়া হলেও যোগদান করেই তারা অনুন্নত এলাকার কারণে নানা ছুতায় অনুপস্থিত থাকেন। এ অনুপস্থিত থেকেই তারা হঠাৎ বদলি হয়ে যান। দীর্ঘদিন ধরে চলছে ডাক্তার ও নার্সদের আসা-যাওয়ার এ খেলা।
জানা যায়, সদর হাসপাতালের জুনিয়র সার্জারি ডাক্তার জহির আহমেদ চৌধুরী ১৮ জুন যোগদানের পর থেকেই অনুপস্থিত ছিলেন। নভেম্বরে বদলি হয়ে চলে যান সিলেটের গোলাপগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্।
ে চক্ষু বিশেষজ্ঞ ডা. মনিরুজ্জামান গত বছরের ২৪ এপ্রিল যোগদান করার পর দিন থেকেই অনুপস্থিত ছিলেন। তবে ২১ অক্টোবর স্বাস্থ্য উপদেষ্টা ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী হাসপাতালে এলে তার খবর পেয়ে তিনি এক দিনের জন্য হাসপাতালে এসেছিলেন। এর পর থেকেই আবারও অনুপস্থিত রয়েছেন। ডা. মোজাম্মেল হোসেন (ইএনটি সার্জন) গত বছরের ১৭ জুন যোগদান করার পর ২৩ ডিসেম্বর বদলি হয়ে সিলেটের ডা. শামসুদ্দিন হাসপাতালে চলে যান। ডা. শফিকুল হক চৌধুরী (প্যাথলজি) গত বছরের জুনে যোগদান করার পর থেকেই অনুপস্থিত রয়েছেন।
তবে কৌশলে তিনি ২৫ নভেম্বর থেকে অর্জিত ছুটিতে আছেন। এখন অর্জিত ছুটিতে থাকলেও তিনি এর আগে থেকেই কর্মস্থলে অনুপস্থিত আছেন। সিনিয়র কনসালট্যান্ট সার্জারি ডা. মোস্তাফিজুর রহমান ১২ মে হাসপাতালে যোগদান করে বদলি হন ১১ নভেম্বর। স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. শহীদুল্লাহ ২০১২ সালের ১৯ জুন যোগদান করে গত বছরের ১২ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালী বদলি হয়ে যান। জুনিয়র কনসালট্যান্ট (ইএনটি) ডা. শের-ই-আলী মর্তুজা ২০১২ সালের ১০ অক্টোবর হাসপাতালে যোগদান করলেও কাজ না করেই চলে যান।
গত বছরের জুলাইয়ে প্রেরিত টিআইবির স্বাস্থ্য জরিপে এ দুজনের অনুপস্থিতির বিষয়টি উঠে এসেছিল। এদিকে তিন মাস আগে জগন্নাথপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ্রে আবাসিক চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দীনকে সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক হিসেবে বদলি করলেও তিনি এখনো যোগদান করেননি। সদর হাসপাতালে ডা. নূরুল হুদা (জুনিয়র কনসালট্যান্ট ইএনটি) ১১ ডিসেম্বর থেকে যোগদানের পর এক সপ্তাহের সাধারণ ছুটি নিয়ে এখনো অনুপস্থিত আছেন।
এদিকে গত সেপ্টেম্বরে সদর হাসপাতালে ৭২ জন নার্সকে নিয়োগ দেওয়া হলে তাদের মধ্য থেকে ছয়জন একই মাসে বদলি হয়ে চলে যান। এ পর্যন্ত ৩৩ জন বদলি ও চারজন প্রেষণে আছেন।
আরও ৩২ জনের বদলি প্রক্রিয়াধীন। তারাও তদবির করে যে কোনো দিন চলে যাবেন বলে হাসপাতাল সূত্রে জানা গেছে।
জানা গেছে, ডাক্তাররা দিনের পর দিন অনুপস্থিত থাকলেও নিয়মিত বেতন-ভাতা উত্তোলন করছেন। গত বছরের জুলাইয়ে টিআইবির গবেষণা রিপোর্টে সদর হাসপাতালের কিছুসংখ্যক ডাক্তার-নার্সের অনিয়মের বিষয়টি উঠে আসে। রোগী, সুশীল সমাজের কাছ থেকে এসব অভিযোগ পেয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর মিসবাহ হাসপাতাল পরিদর্শনে যান।
এ দিন তিনি হাম-রুবেলা টিকাদানের উদ্বোধন করেন।
সদর হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. এহছান উজ জামান খান বলেন, স্বাস্থ্যসেবা পিছিয়ে থাকা এ জেলায় যারা যোগদান করেন তারা এসেই বদলির তদবিরে ব্যস্ত থাকেন। তারা হাসপাতালে থাকলে এ জেলা সদর হাসপাতালের স্বাস্থ্যসেবার চিত্র বদলে দেওয়া সম্ভব। এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য আমি নিয়মিত ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছি।
সুনামগগঞ্জের সিভিল সার্জন ডা. রকিব চৌধুরী বলেন, ডাক্তার ও নার্সরা এসে উচ্চ মহল থেকে তদবির করে পছন্দের জায়গায় চলে যেতে চান।
তখন আমাদের আর কিছু করার থাকে না। তবে অনেকে যোগদান করেই আবার অর্জিত ও সাধারণ ছুটি নিয়ে অনুপস্থিত থাকেন বলে সিভিল সার্জন স্বীকার করেছেন।
সুনামগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ বলেন, শহরের নাগরিক সমাজ, সাধারণ মানুষ ও রোগীরা দীর্ঘদিন ধরে হাসপাতালের অব্যবস্থাপনা, ডাক্তার ও নার্স শূন্যতার বিষয়ে আমাকে অবগত করেছেন। জনদুর্ভোগ লাঘবের জন্য আমি সংসদ অধিবেশনে সুনামগঞ্জের চিকিৎসাসেবার উন্নয়নে কথা বলব। প্রয়োজনে বারবার মন্ত্রীর কাছে গিয়ে আমার সুনামগঞ্জের চিরবিড়ম্বিত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের কথা বলব।
উল্লেখ্য, ছাত্রজীবন থেকে ছাত্র রাজনীতিতে হাতেখড়ি পীর ফজলুর রহমান স্থানীয় ইস্যুতে দীর্ঘ সময় রাজপথে ছিলেন। প্রতিভাদীপ্ত আইনজীবী ও ক্লিন ইমেজের রাজনৈতিক কর্মী পীর মিসবাহ জাতীয় পার্টির মনোনয়নে এমপি হয়ে নিজ শহরে ফিরলে জনতা তাকে স্বতঃস্ফূর্ত অভ্যর্থনা জানায়। প্রথম দিনই তিনি বলেছেন, দুর্নীতি, সন্ত্রাস, মাদক ও সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জনগণের কর্মী হয়ে তিনি লড়বেন। অকাল বন্যায় যাতে হাওরের ফসল তলিয়ে না যায় সে জন্য বাঁধ নির্মাণে জনতাকে তার সঙ্গে পাহারাদার হতে গ্রামে গ্রামে সমাবেশ করেন। সংসদের অধিবেশনে যোগদানের আগে তিনি তার পূর্বপুরুষের ভিটেমাটি মাইজবাড়ি, মোল্লাপাড়াসহ পৌরসভাসংলগ্ন কয়েকটি গ্রামে সব মত-পথের মানুষকে নিয়ে সমাবেশ করেন।
এরই মধ্যে তার দুর্নীতির সঙ্গে আপস নয়; ডানে-বামে সিন্ডিকেট নয়; মাদক-সন্ত্রাস-দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম আর সাহেব নয়, জনগণের সেবক বা কর্মী হতে এসেছি। এমন বক্তব্য মানুষের মধ্যে সাড়া জাগিয়েছে। সুনামগঞ্জে দুর্নীতি করে ঢাকায় বিত্তবৈভব আর বিলাসী জীবন নয়। পরিবার থাকবে সুনামগঞ্জে, সন্তানরাও লেখাপড়া করবে এখানে, তিনি সাধারণ জীবনেই থাকবেন এ অঙ্গীকার মানুষের মধ্যে আস্থা জুগিয়েছে। যেখানেই যাচ্ছেন তার বিনয়ী আচরণ মানুষকে টানছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।