আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিজামী বাবরসহ ১৪ জনের ফাঁসি

দীর্ঘ প্রায় ১০ বছর পর অবশেষে বহুল আলোচিত ১০ ট্রাক অস্ত্র আটকের ঘটনায় পৃথক দুটি মামলার রায় ঘোষণা হয়েছে। এতে দুটি মামলার তদন্ত ও সাক্ষ্য-প্রমাণে অপরাধ প্রমাণিত হওয়ায় চোরাচালান মামলায় সাবেক শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, পলাতক আসামি উলফার সামরিক কমান্ডার পরেশ বড়ুয়াসহ ১৪ আসামির মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত। তাদের প্রত্যেক আসামিকে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানাও করা হয়। একইভাবে অস্ত্র আইনে দায়ের করা আরেক মামলায় ওই ১৪ জন আসামির যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে সাত বছর কারাদণ্ডও দিয়েছেন।

অপর আসামিদের খালাস প্রদান করেছেন আদালত। তবে এ মামলার মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত তিনজন আসামির মধ্যে উলফা নেতা পরেশ বড়ুয়া ও সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন পলাতক রয়েছেন এবং অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী হাজী আবদুস সোবহান জামিনে থেকে গতকাল আদালতে উপস্থিত হওয়ার পর তাকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

গতকাল সোয়া ১১টায় উপস্থিত হন চট্টগ্রামের স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল-১ এর বিচারক এস এম মুজিবুর রহমান। বিচারক প্রথমে অস্ত্র আইনে দায়ের হওয়া মামলার রায়ের সারসংক্ষেপ পড়েন বেলা ১২টা ২৫ মিনিটে। পরে বিচারক অস্ত্র চোরাচালান মামলার রায় দেন বলে ট্রাইব্যুনালের বেঞ্চ সহকারী মোহাম্মদ ফুয়াদ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেন।

জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী এবং সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরসহ হাজতে থাকা ১১ আসামি এবং জামিনে থাকা বেশ কয়েকজন আসামি এ সময় আদালতে উপস্থিত ছিলেন এবং রায়ের আগে বেলা ১১টায় কঠোর নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে হাজতে থাকা ১১ আসামিকে কারাগার থেকে আদালতে আনা হয়। চোরাচালান ও অস্ত্র মামলার পৃথক আদেশের নামের সিরিয়াল অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ও যাবজ্জীবন দণ্ডাদেশপ্রাপ্ত অন্য ১১ জন আসামি হচ্ছেন- এনএসআই'র সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী, এনএসআইর সাবেক মহাপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবদুর রহিম, ডিজিএফআইর সাবেক পরিচালক (নিরাপত্তা) অবসরপ্রাপ্ত উইং কমান্ডার সাহাবুদ্দিন আহমেদ, এনএসআইর সাবেক উপপরিচালক অবসরপ্রাপ্ত মেজর লিয়াকত হোসেন, এনএসআইর সাবেক মাঠ কর্মকর্তা আকবর হোসেন খান, রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহসিন উদ্দিন তালুকদার, সিইউএফএলের সাবেক মহাব্যবস্থাপক (প্রশাসন) কে এম এনামুল হক, সাবেক ভারপ্রাপ্ত শিল্প সচিব নুরুল আমিন, চোরাচালানি হিসেবে অভিযুক্ত হাফিজুর রহমান, অস্ত্র খালাসের জন্য শ্রমিক সরবরাহকারী দীন মোহাম্মদ ও হাজী আবদুস সোবহান। অস্ত্র চোরাচালান মামলায় ৫২ জনের মধ্যে বাকি ৩৮ জন আসামি বেকসুর খালাস পেয়েছেন। অস্ত্র আটক মামলায় ৫০ জনের মধ্যে বাকি ৩৬ জন বেকসুর খালাস পান। এতে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ড একই সঙ্গে কার্যকর হবে এবং আসামিরা গ্রেফতারের পর থেকে যে কারাভোগ করছেন, সে গুলো কারাদণ্ডের মধ্যে যুক্ত হবে।

মামলার ৩৮ জন খালাসপ্রাপ্ত আসামি : অস্ত্র চোরাচালান ও অস্ত্র আটক পৃথক মামলার ৩৮ জন খালাসপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- সানোয়ার হোসেন চৌধুরী (৫০), দিলদার হোসেন চৌধুরী (৪৭), মরিয়ম বেগম ওরফে বদনি মেম্বার (৪৩), জসীম উদ্দিন ওরফে জসীম (৩৫), আবদুল আজিজ (৪৯), মো. আকতার (৪৬), মো. জাহাঙ্গীর (৪৩), নূরুল আবছার ওরফে আবছার মেম্বার (৪৫), আরজু মিয়া প্রকাশ পাগলা (৫৮), এজাহার মিয়া (৫৫), মুজিবুর রহমান ভুলু (৫৭), শেখ মোহাম্মদ (৪৭), ফজল আহাম্মদ চৌধুরী (৪৩), আকবর আলী (৪৬), বাদশাহ মিয়া (২৪), ওসমান মিস্ত্রি (৩৬), আবদুল মান্নান (৩২), কবির আহাম্মদ (৩৪), মো. রফিক (৩০), মনির আহাম্মদ (৩২), আবদুল মালেক (৩৫), মঞ্জুরুল আলম (২৮), সালেহ জহুর প্রকাশ গুরা মিয়া (৩০), ফিরোজ আহম্মদ (৩২), সাইফুদ্দিন (৫০), কামাল মিয়া (৩৮), প্রদীপ কুমার দাশ (৩৮), নূরনবী (৩৬), সিরাজুল ইসলাম (৩৩), হেলাল উদ্দিন (৩০), বাবুল মিয়া (৩৪), আবদুর রহিম মাঝি (৩৫), আবদুস সবুর (৩২), মো. শাহআলম (৩৪), মো. সোবহান (৩৩), শাহজাহান (৩৮), আবুল হোসেন (৩২) ও সফিকুর ওরফে সফিউর রহমান (৩০)।

মারা যাওয়া চার আসামি : চোরাচালান ও অস্ত্র আটক মামলার মৃত্যুবরণকারী চার আসামি হলেন- ইয়াকুব আলী, মুনির আহমেদ, আতাউর রহমান ও আবুল কাশেম মধু।

অস্ত্র আটকের দুটি মামলা : ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল রাতে রাষ্ট্রায়ত্ত সার কারখানা চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেডের (সিইউএফএল) জেটিঘাটে দশ ট্রাক অস্ত্রের চালানটি খালাসের সময় ধরা পড়ে। এমভি শাহ আমান ও এমভি খাজার দান নামে দুটি ফিশিং ট্রলার থেকে অস্ত্রগুলো খালাসের সময় গোপন সংবাদের ভিত্তিতে পুলিশ গিয়ে সেগুলো আটক করে। এ ঘটনায় কর্ণফুলী থানার তৎকালীন ওসি আহাদুর রহমান বাদী হয়ে অস্ত্র আইনের ১৯(ক) ধারায় ৪৩ জনকে এবং চোরাচালানের অভিযোগে বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২৫(বি) ধারায় ৪৫ জনকে আসামি করে পৃথক দুটি মামলা দায়ের করেন একই থানায়।

এ মামলায় আসামি করা হয়েছিল ট্রলার মালিক, ঘাট শ্রমিক, পরিবহন শ্রমিক, ট্রলারের সারেং, স্থানীয় ইউপি সদস্য, এলাকার সাধারণ মানুষকে। মামলা দুটির তদন্তের দায়িত্ব ওসি আহাদুর রহমান নিজেই নেন। পরে বাদী ও তদন্তকারী কর্মকর্তা একই ব্যক্তি নিয়ে সমালোচনা সৃষ্টি হলে তদন্তভার যায় সিআইডির কাছেই। ২৬ এপ্রিল তদন্তভার নেন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন। দুই মাস তদন্তের পর ২০০৪ সালের ১১ জুন সিআইডির এএসপি কবির উদ্দিন অস্ত্র আটক মামলায় ৪৩ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন।

একই বছরের ৯ নভেম্বর সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান চোরচালান মামলায় ৪৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন। পিপি আবদুস সাত্তারের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সিআইডির এএসপি নওশের আলী খান পুনঃতদন্ত করে অস্ত্র আটক মামলায় ২০০৪ সালের ২৫ আগস্ট আরও এক দফা অভিযোগপত্র দেন। দীর্ঘ তদন্তের পর ২০০৫ সালের ২৩ এপ্রিল অস্ত্র আটক মামলায় এবং ২০০৪ সালের ৩০ নভেম্বর চোরাচালান মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। ২০০৫ সালের ৬ জুলাই দুই মামলায় বাদী আহাদুর রহমান প্রথম সাক্ষ্য দেন। ২০০৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণ চলে।

তখন পর্যন্ত অস্ত্র আটক মামলায় ৩১ জন এবং চোরাচালান মামলায় ২৮ জন সাক্ষী সাক্ষ্য দেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে ২০০৭ সালের ২০ নভেম্বর রাষ্ট্রপক্ষের তৎকালীন কেঁৗসুলি ও অতিরিক্ত মহানগর পিপি হুমায়ন কবির রাসেল মামলার অধিকতর তদন্তের জন্য মহানগর দায়রা জজ আদালতে আবেদন করেন। আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আদালত অস্ত্রের উৎস, গন্তব্য, অস্ত্রের ধরন, চালান থেকে অস্ত্র খোয়া গিয়েছিল কিনা, কাদের জন্য অস্ত্র আনা হয়েছিল, কোন জলযানে অস্ত্র ঢুকেছিল- এ ধরনের সাতটি পর্যবেক্ষণসহ অধিকতর তদন্তেরে আদেশ দেন। সিআইডির এএসপি ইসমাইল হোসেন প্রথম দফা অধিকতর তদন্তের দায়িত্ব পেলেও তিনি তদন্ত শেষের আগেই বিদায় নেন। পরে সিআইডির চট্টগ্রাম অঞ্চলের সিনিয়র এএসপি মনিরুজ্জামান চৌধুরী ২০০৯ সালের ২৯ জানুয়ারি তদন্তভার গ্রহণ করেন।

মনিরুজ্জামানের তদন্তে বেরিয়ে আসতে থাকে ঘটনার সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালদের নাম, উলফার প্রসঙ্গ, একের পর এক স্পর্শকাতর ও চাঞ্চল্যকর বিষয়। অধিকতর তদন্ত শেষে ২০১১ সালের ২৬ জুন দুটি মামলায় সম্পূরক অভিযোগপত্র জমা দেন তদন্তকারী কর্মকর্তা মনিরুজ্জামান। এতে দুই মামলায় নতুনভাবে ১১ জনকে আসামি হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিলের পর নতুন ১১ জনসহ অস্ত্র আইনের মামলায় আসামির সংখ্যা দাঁড়ায় ৫৪ জনে এবং চোরাচালান মামলায় আসামি হয় ৫২ জন।

 

 



অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।