আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দুঃখ তার লেখে নাম। মানুষের ‘প্রজ্ঞার ওপর’ ভরসা রাখুন

শুচি সৈয়দ




শুচি সৈয়দ
আমার প্রিয়জন, প্রিয় লেখক মুহম্মদ জাফর ইকবাল। এই প্রজšে§র তরুণদের কাছেও প্রিয় লেখক, প্রিয়জন তিনি। মনে পড়ে সেই ১৯৭৯ সনে তাঁকে নিয়ে একটি রচনা লিখেছিলাম, ‘আমার প্রিয় লেখক : মুহম্মদ জাফর ইকবাল’Ñ শিরনামে। তখন দেশব্যাপী পরিচিত প্রকাশনা সংস্থা মুক্তধারা সারাদেশের স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের ছাত্র-শিক্ষার্থীদের জন্য আয়োজন করেছিল এই রচনা প্রতিযোগিতার। তাতে অংশ গ্রহণ করে মুহম্মদ জাফর ইকবাল কে নিয়ে লিখেছিলাম আমার লেখাটি।

তখন মাত্র কয়েকটি বইয়ের লেখক তিনি। কপোট্রনিক সুখ দুঃখ, মহাকাশে মহাত্রাস, হাত কাটা রবিন এবং দীপু ্নাম্বার টুÑ সাকুল্যে এই কয়টি বইয়ের রচয়িতা। মাত্র ৪টি গ্রন্থের এই গ্রন্থকারকে নিয়ে ফুলস্কেপ কাগজের প্রায় ৫০ পৃষ্ঠার এক দীর্ঘ রচনা লিখে প্রথম পুরস্কারের আশায় বসে থাকলেও আমার কপালে জুটেছিল তৃতীয় পুরস্কারটি। রীতিমত যাকে বলে অভিসন্দর্ভ সে রকম একটি রচনার এমন মূল্যায়নে যারপর নাই দুঃখ পেয়েছিলাম। সেই সদ্য কৈশোরের দুঃখের চেয়েও অনেক বেশি দুঃখে আজ মন ভারক্রান্ত হয়ে গেল সকাল বেলা এই খবর পড়ে যে, তিনি এবং তাঁর স্ত্রী দুজনই সিলেট শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদত্যাগ করেছেন! খবরটি পড়ে বোধ করছিলাম প্রচণ্ডভাবে পরাজিত হবার বেদনা! আমার জানা এই অসাধারণ দেশপ্রেমিক সাহসী মানুষটি, আমি যাকে আমার নায়কের মত শ্রদ্ধা করি ভালবাসি সেই মানুষটির পরাজিত মুখচ্ছবি দেখতে হবেÑ একথা ভাবতেই আমি ম্লান ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ি।

দেশকে তিনি তার অধীত বিদ্যা দিয়ে সমৃদ্ধ করার ব্রতে ব্রতী। যিনি দেশকে রিক্ত নিঃস্ব অন্ধকার করা দুর্বৃত্তদের দলের নন, তিনি যদি পরাজিত হন তাহলে কোন গন্তব্যে যাবে আমাদের প্রিয় এই দেশ? প্রায় এক যুগের বেশি আগে তাঁকে নিয়ে অন্ধকারের শক্তি বিতর্কিত তৎপরতায় মেতে উঠেছিল। তখন তাঁর সঙ্গে প্রতিবাদে প্রতীকী অনশনে শরিক হয়েছিল সমস্ত দেশ। তাঁর আরেক অগ্রজ প্রয়াত হুমায়ূন আহমেদ অনশন করেছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়টির গেটে। সে এক অভূতপূর্ব ঘটনা।

বাংলাদেশের ইতিহাসে যা ইতিপূর্বে ঘটেনি, ভবিষ্যতে ঘটবে কিনা জানি না। সেদিন জয় হয়েছিল মুক্তবুদ্ধির মানুষের। পিছু হটেছিল প্রতিক্রিয়াশীল অন্ধকারের শক্তি। আর আজ? সেই প্রতিক্রিয়ার কাছেই কি হার মানবেন আমার নায়ক? তাহলে কি আমার আরেক প্রিয় লেখ ড. হুমায়ূন আজাদের ভবিষ্যদ্বাণীই সত্য প্রমাণিত হবেÑ ‘সবকিছু নষ্টদের অধিকারে যাবে’Ñ ‘প্রতিক্রিয়াশীলতার দীর্ঘ ছায়ার নিচে’ বিলীন কিংবা ধ্বংস হয়ে যাবে আমার স্বদেশ?
যে কারণে পদত্যাগ করেছেন তিনি তাহলÑ এ বছর সিলেটের হযরত শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে একই সঙ্গে গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার কথা। ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠেয় ২০১৩-১৪ শিক্ষা বর্ষের প্রথম বর্ষ øাতক ভর্তি পরীক্ষা গত ২৬ নভেম্বর স্থগিত করার সিদ্ধান্ত নেয় শাবিপ্রবি-র একাডেমিক কাউন্সিল।

গুচ্ছ পদ্ধতিতে দুটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা বাতিলের দাবিতে সিলেটের বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ নাকি নানা কর্মসূচি পালন করছিল। তাদের দাবি মেনে একাডেমিক কাউন্সিল গুচ্ছ প™ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা স্থগিতের সিদ্ধান্ত নেয়।
দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে শাবিপ্রবি যে কারণে বিশেষ খ্যাতির অধিকারী তা হলÑ এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিচ্ছুক শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ফরম পূরণ করে ভর্তি পরীক্ষা অংশ গ্রহণ করে থাকে। দেশের প্রথম শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বোধকরি শাবিপ্রবি এবং এই পদ্ধতিটি প্রচলনের পেছনে যার অক্লান্ত অবদান আছে বলে আমি জানি তিনি ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল। বাংলাভাষায় দেশের একমাত্র সার্চ ইঞ্জিন ‘পিপীলিকা’ এই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছাত্রীদের আরেকটি অন্যতম কৃতিত্ব।

তাঁরও নেপথ্যের প্রেরণা প্রাণপুরুষ এই মানুষটি। শাবিপ্রবি-র নামের সঙ্গে ওতপ্রোত যাঁর নাম সেও এই মানুষটি। তিনিই কিনা বিদায় নিতে চান তাঁর এই প্রিয়ভূমি থেকে? তাঁর শৈশবের প্রিয় শহর থেকে!

#
ট্রেন আসার সময়ের অনেক আগে কমলাপুর স্টেশনে গিয়ে বসে থেকেও সামান্য অমনোযোগে আমি ট্রেন ফেল করেছি! ঝুম বৃষ্টিতে পথে আটকে গিয়ে ট্রেন ফেল করেছি!! কিন্তু ট্রেন কখনো যাত্রীকে ফেল করে তেমন ঘটনা বাংলাদেশে বিরল! সেই বিরল ঘটনারও অভিজ্ঞতায় সমৃদ্ধ হয়েছি। আমার মা অসুস্থ, অফিসে ছুটি ম্যানেজ করা কঠিন। আমি আমার ডে অফ-এর আগের দিনের ট্রেনের টিকেট কেটে কমলাপুর স্টেশন থেকে টিকেটের টাকা ফেরত পেয়ে ফিরে এসেছি।

রাত ১১:১৫-এর ট্রেন রাজনৈতিক অস্থিরতার শিকার হয়ে ঢাকায় আসবে ভোর ৪:৩০-এ। টাকা ফেরত নিয়ে ছুটলাম বাসের টিকেটের জন্য, ৩/৪ টি বাস কোম্পানির একটিতেও টিকেট নেই। পরিচিত টিকেট কাউন্টার ম্যানেজারকে অনুরোধ উপরোধ করেও টিকেট পেলাম না; কারণ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি পরীক্ষা আছে, পরীক্ষার্থীদের চাপে টিকেট শেষ। আামার আর বাড়ি যাওয়া হল না। আমি বাসায় ফিরে এলাম রাত ১টা নাগাদ।

তখনও জেগে থাকা আমার মেয়ে সামান্থাকে বললাম, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর মাতৃজ্ঞা পালনে ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ দামোদর নদী পাড়ি দিয়ে মায়ের কাছে পৌঁছেছিল আর আমি বাস-ট্রেনের একটা টিকেটও জোগার করতে পারলাম না! এই হল বাস্তবতা!!
বিশ্ববিদ্যালয় গুলোর ভর্তি পরীক্ষার সময় ছাত্র-ছাত্রী, অভিভাবকদের পাগলপ্রায় অবস্থা হয়। সেই পাগলপ্রায় অবস্থা থেকে মুক্তি দিতে গত কয়েক বছর ধরে মুহম্মদ জাফর ইকবাল দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ে সমন্বিত পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেয়ার জন্য শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ইউজিসিসহ শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকল ফোরামে প্রস্তাব করে আসছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পুরনো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এই ডিজিটাল, সহজ এবং দুর্দশা লাঘবকারী পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নিতে অনিচ্ছুক কারণ তাতে তাদের কয়েমী স্বার্থধারীদের স্বার্থের ব্যাঘাত ঘটবে। অর্থনৈতিক ভাবে তারা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। আর এই যুগোপযোগী পদ্ধতিটি সব বিশ্ববিদ্যালয়ে চালু করতে না পাড়ায় শিক্ষার্থী, অভিভাবকরা তো বটেই সর্বোপরি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শিক্ষা।

এ বছর প্রাথমিকভাবে শাবিপ্রবি এবং যবিপ্রবি গুচ্ছ পদ্ধতিতে ভর্তি পরীক্ষা নেওয়ার কল্যাণকর সিদ্ধান্তটি নিয়েছিল। এখন এই পদ্ধতিতে বাধসাধল স্বয়ং মুহম্মদ জাফর ইকবালের প্রতিষ্ঠান শাবিপ্রবি। কাউন্সিল হার মানল ‘সচেতন সিলেটবাসী’ ইত্যাদি ইত্যাদি নামধারী ভুঁইফোড় ব্যানার সর্বস্ব সংগঠনের দাবির কাছে। মাত্র মাস খানেক আগে দেশের অর্থমন্ত্রী যাদেরকে ‘ক্রিমিনাল’ এবং ‘স্টুপিড’ বলে গালি দিয়ে এসেছেন তাদেরই স্বগোত্রীয়দের কাছে। সিলেট এমসি কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে ভর্তি করিয়ে দেয়ার বিনিময়ে অর্থ নিয়ে ভাগ বাঁটোয়ারা করে আÍসাৎ করেছে এমসি কলেজের ছাত্রলীগ নেতারাÑ অর্থমন্ত্রীর কাছে এমন অভিযোগের স্তূপ জমা হয়ায় তিনি বিরক্ত হয়ে উপর্যুক্ত মন্তব্য করেন।

এখন শাবিপ্রবিও তার ছাত্র-ছাত্রীদের সেই ব্যবস্থার বলি হতে ঠেলে দিচ্ছে। শুধু শাবিপ্রবি নয় শিক্ষার্থীদের ক্রিমিনাল আর স্টুপিডদের খক্ষের নিচ সপে দিচ্ছে ঢাবিসহ দেশের আরও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়।
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো গুচ্ছপদ্ধতিতে পরীক্ষা না নেবার কারণে কি পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তার সাক্ষ্য নিচের সংবাদটিÑ

ইবি ও চবিতে একই দিনে পরীক্ষা
বিপাকে শিক্ষার্থীরা
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধি : ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে ধর্মতত্ত্ব অনুষদের ‘এ’ এবং আইন অনুুষদের ‘এইচ’ ইউনিট ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ও মানববিদ্যা অনুষদের ‘বি-৩’ ও ‘বি-৭’ ইউনিটে ভর্তি পরীক্ষা ৩০ নভেম্বর অনুষ্ঠিত হবে। একইদিনে দুই বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার তারিখ পড়ায় বিপাকে পড়ছেন ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীরা। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্ব অনুষদ ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়েল কলা ও মানববিদ্যা অনুষদ আরবি ও ইসলামিক স্ট্যাডিজ বিভাগ নিয়ে গঠিত।

অনেক শিক্ষার্থী দুই বিশ্ববিদ্যালয়ের ওইসব ইউনিটে ভর্তি ফরম উঠিয়েছেন। কিন্তু দুই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা একই দিনে পড়ায় কোথায় পরীক্ষা দিবেন, কোথায় দিবেন না, কোথাও ভর্তি হতে পারবেন কিনা এ চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। একইদিনে পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হলে অনেক মেধাবী শিক্ষার্থী হারাবে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। ফলে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে মেধাশূন্য ও আঞ্চলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত হবে। ফলে শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবক উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।


(অর্থনীতি প্রতিদিন, ২৮ নভেম্বর ২০১৩)

হ্যাঁ, এভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে পড়ছে স্থানীয় কলেজ অথচ উটপাখির মত বালিতে মুখগুঁজে নিজেদের ব্যাংক ব্যালান্স এবং পকেট ফোলাচ্ছেন তথাকথিত উপাচার্যরা সমন্বিত ভর্তি ব্যবস্থার বাস্তবতাকে উপেক্ষা করে। যখন দেশের অশিক্ষিত ইউনিয়ন পরিষদের সদস্যরা পর্যন্ত ইউনিয়ন পরিষদ তথ্যকেন্দ্রের মাধ্যমে সেবা দিচ্ছেন গহীন গ্রামের মানুষকে তখনও এই তথাকথিত উচ্চশিক্ষিতরা দিনের পর দিন মানুষকে ভোগান্তির শিকার হতে বাধ্য করছেন। এরা কি ক্রিমিনাল নন?


#
আমার বাবা রাজনীতি করতেন। সমাজ বদলের স্বপ্ন দেখতেন। তাই পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন শিক্ষকতাকে।

গ্রামের মানুষকে শিক্ষা দেবার ব্রত নিয়ে চলে গিয়েছিলেন গ্রামে। বড় হয়ে পিতার ব্যবহƒত ইংরেজি ডিকশনারীর একটি পাতায় কয়েকটি শব্দ দেখেছি তাঁর হাস্তক্ষরেÑ ‘বিলং গো টু শাহপুর, মাহমুদ। ’ পাকশীর শাহপুর স্কুলের মাস্টারের প্রতি এটি তাঁর আÍিক অটোসাজেশন নাকি অন্তর্গত তৃষ্ণা তা আমার জানা নেইÑ আমাকে বিদ্যুস্পৃষ্ট করেছিল শব্দ ক’টি। উন্নত দেশের উন্নত জীবন সর্বোপরি অনেক ডলারের হাতছানি এসব উপেক্ষা করে মুহম্মদ জাফর ইকবাল তার শৈশবের স্মৃতি ভারাতুর শহর সিলেটের শাবিপ্রবিতে এসে কি ফিরে যাবেন পরাজয়ের বেদনা মেখে!
আমি শুধু বুক ফাটা হাহাকারে এই সত্যটি উচ্চারণ করিতে পারিÑ জাফর ইকবাল পরাজিত হলে পরাজিত হবে বাংলাদেশ!
শেষ পর্যন্ত সহকর্মী, ছাত্র-ছাত্রীদের দাবিতে বহাল রাখা হয়েছে শাবিপ্রবি ও যবিপ্রবি-র ভর্তি পরীক্ষা। পদত্যাগপত্র তাদের ভালোবাসায় প্রত্যাহার করেছেন মুহম্মদ জাফর ইকবাল।


আমার বুকের বিষন্ন মেঘ সরে গেলেও ক্যাম্পাসে প্রতিক্রিয়াশীলদের ঘৃণ্য বোমাবাজির ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি।


২.

কাক্সিক্ষত-অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা-দুর্ঘটনার ঘূর্ণাবর্তে পড়েছে দেশ এবং দেশের রাজনীতি। এই ঘূর্ণাবর্ত থেকে বেরিয়ে আসার জন্য প্রয়োজন শক্ত সদিচ্ছার। সেই সদিচ্ছারই যেন দেখা মিলছে না। নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করেছেন।

বিরোধী দল সে তফসিল প্রত্যাখ্যান করে অবরোধ কর্মসূচি পালনের ডাক দিয়েছে। ৪৮ ঘণ্টার অবরোধের প্রথম দিনে আট জন নিহত হয়েছে। দ্বিতীয় দিন ৯ জন। লাশের মিছিল বাড়ছে।
বাংলাদেশের রাজনীতি নানা সময়ে নানাভাবে কলুষিত, প্রভাবিত হয়েছে।

বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নভাবে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়ে ক্ষমতাবানরা ক্ষমতাকে চিরস্থায়ী করার ঘৃণ্য অভীপ্সায় রাজনৈতিক সংস্কৃতিকে বিকৃত বিভ্রান্ত অনৈতিকতায় ভার তুলেছে। ক্ষমতাসীন-ক্ষমতাবানরা সব সময়ই এসব করেছে জনগণের নামে, জনগণের দোহাই দিয়ে। দেশের বর্তমান সংঘাত-সহিংসতার সময়ের ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা প্রত্যাশীরা জনগণের দোহাই দিয়েই নির্বাচন ও নির্বাচন বিরোধিতায় অবতীর্ণ। আর তাদের সেই পরস্পরবিরোধী সহিংসতার মাঝখানে অগ্নিদগ্ধ, বোমায় হত হচ্ছে অসহায় ‘জনগণ’। প্রধান নির্বাচন কমিশনার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে নির্বাচন তফসিল ঘোষণার পর থেকে দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী আচরণবিধি মেনে চলার কথা কিন্তু নির্বাচনী আরচণবিধি কেউই মেনে চলার গরজ দেখাচ্ছে না।

যারা নির্বাচনী তফসিল প্রত্যাখ্যান করেছে তারা তো নয়ই, যারা নির্বাচনী তফসিলকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দ মিছিল করেছে তারাও নয়। দেশের প্রধান কবি প্রয়াত শামসুর রাহমান মরুপশু উট নিয়ে পীর-ফকিরের শিষ্য-সামন্তদের উল্লাস দেখে কবিতা লিখেছিলেনÑ ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’ তেমনই যেন বর্তমানে উদ্ভট সময়ের পিঠে সওয়ার হয়েছে দেশ।
নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ঐকান্তিক ইচ্ছায় নির্বাচনকালীন সরকারের মন্ত্রিসভায় যোগ দিয়েও জাতীয় পার্টির নেতা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তুলে ধরেছেন বাস্তবতাকে। সুষ্ঠু নির্বাচন নিয়ে সংশয় জানিয়েছেন তিনিও। তিনি বলেছেন, ‘কোথায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড! এভাবে নির্বাচন সুষ্ঠু হওয়া সম্ভব নয়।

পরিবেশ নেই। ’
দেশে সুষ্ঠু একটি রাজনৈতিক-সংস্কৃতি গড়ে তোলার দায়িত্ব ছিল প্রধানত যে রাজনীতিবিদদের মূলত, তাদেরই ক্ষমতা লিপ্সা, ক্ষমতাসক্তি, যে কোনো মূল্যে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার দুর্মর ইচ্ছা-আকাক্সক্ষার কারণে তাদের হাতেই কলুষিত হয়েছে এদেশের রাজনীতি। তারাই রাজনীতিকে জনসেবার পরিবর্তে জনশাসনে রূপান্তরিত করেছেন। তারাই রাজনীতিতে রাজনীতির বাইরের লোকদের ডেকে এনে বসিয়ে দিয়েছেন। তারাই সেনাশাসন, বিচারপতিদের সরকার এসব উদ্ভট সরকারের দ্বারস্থ হয়েছেন।

এমনকি তারাই ডেকে এনেছেন দেশের রাজনীতিতে বিদেশী নিনিয়ান, কফি আনান থেকে শুরু করে বর্তমানে মজিনা, পঙ্কজ শরণ, ইউরোপীয় ইউনিয়নের দূতদের পর্যন্ত। মার্কিন-চীন-ভারত ডিলেমা তাদেরই অক্ষমতার সাইনবোর্ড। পৃথিবীর কোনো স্বাধীন রাষ্ট্র তো দূরের কথা কোনো ফেডারেল রাষ্ট্রের প্রাদেশিক রাজ্যেও এমন বিদেশী কিংবা কেন্দ্রীয় হস্তক্ষেপ, উপদেশ অনুরোধের আসর বসে বলে নজির দেখা যায় না। যা কিনা ঘটছে আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম দেশের রাজনৈতিক সংকটের সমাধানে। মার্কিন ও ভারতীয় দূত জানিয়ে দিয়েছেন, এদেশের ‘জনগণের প্রজ্ঞা’ ও ‘সিদ্ধান্তে’র ওপর তাদের পরিপূর্ণ আস্থা রয়েছে।

সরকার পরিবর্তনে জনগণ যে সিদ্ধান্ত দেবেন তারা তাকেই স্বাগত জানাবেন। অথচ যারা ক্ষমতায় থাকতে এবং আসতে চান তারা প্রভুর সন্ধানে হয়রান। তারা জনগণের ‘প্রজ্ঞা’ এবং ‘সিদ্ধান্তে’র ওপর ভরসা করতে পারছেন না; তাই কাঁটা বিছাচ্ছেন পরস্পরের জন্য পথেÑ আর সেই কাঁটায় ছিন্নভিন্ন হচ্ছে মানুষ।
লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করার দায়িত্ব কেবল নির্বাচন কমিশনের একার নয়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠনের দায়িত্ব ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য যারা নির্বাচনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হবেন তাদের সবার।

দেশের সব রাজনৈতিক দলের তো বটেই এমনকি যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে ভোটে দাঁড়াবেন তাদেরও পবিত্র দায়িত্ব নির্বাচনের জন্য লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড গঠন করা ও রক্ষা করা। যারা নির্বাচন বিরোধিতা করছেন সমার দায়িত্ব তাদেরও। কেননা শেষ পর্যন্ত তাদেরও নির্বাচনে আসতে হবে তো বটেই। বর্তমান নির্বাচন কমিশনের উচিত দেশের সব দলকে নিয়ে যে নির্বাচন সম্পন্ন করা যাবে তেমন নির্বাচনেরই সর্বাÍক উদ্যোগ গ্রহণ। বিকৃত কিংবা অপূর্ণাঙ্গ নির্বাচন অনুষ্ঠান দেশের সাধারণ মানুষের কাম্য নয়।

ক্ষমতাসীন এবং ক্ষমতা প্রত্যাশী রাজনীতিবিদদের প্রতি বলার, বিদেশীদের ওপর নয়, দেশের মানুষের ‘প্রজ্ঞা’র ওপর আস্থা রাখুনÑ সেটাই একমাত্র পথ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.