আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।
দীর্ঘসময় ভেবে মনঃস্থির করা সিদ্ধান্তের পূর্ণ বাস্তবায়ন যেই সময়ে করতে পারলো তখন সন্ধ্যা হয়ে প্রায় রাত নামতে বসেছে ।
এতো দেরী লেগে যাবে জায়গাটিতে পৌঁছে যেতে বুঝতে পারেনি । ট্রাফিক জ্যামকে আন্ডারএস্টিমেট করে ঘর থেকে বের হয়েছিলো তার খেসারত দিতে হলো । আজকে খুব বেশীক্ষণ গন্তব্যে সময় কাটানো যাবেনা ।
অথচ এই সংক্ষিপ্ত পরিসরের সফরের জন্য অপেক্ষারত ছিলো বহুদিন । যেসময় নিজেকে হারিয়ে ফেলতে ফেলতে দিশেহারা অবস্থার থ্রেসহোল্ড লিমিটে চলে যাওয়া হয়েছে বলে মনে হচ্ছিলো তেমনই এক রুক্ষ বিকালের তড়িৎ ক্ষণে মনের কোনায় ঝিলিক দিয়েই নিমেষে ইচ্ছাটা হারিয়ে যায়নি । তার মনে হয়েছিলো এই সামান্য ইচ্ছাটা পূরণ করতে ব্যর্থ হলে তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসবে । তার নিবিষ্ট মনে কিছুক্ষণ দম ফেলাটা একান্তই জরুরী হয়ে গেছে । মানুষ হাঁফিয়ে উঠলে কেবলই আতিপাতি করে যেভাবে পারে অপশন হাতড়ায় ।
তার বেলাতে সেই বালাই ছিলোনা । কারণ তার অপশনের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত হতে হতে প্রায় শূন্য হয়ে গেছে । যেই দুই একটা এখনো নিভু নিভু করে জ্বলছে সেগুলোর সলতে নিভিয়ে দিলে জীবন ধারণই করতে হবে জ্বলতে জ্বলতে । এক অসম্ভব অসহনীয় সময়ের দরজায় ধারাবাহিকভাবে কড়া নেড়ে যাচ্ছে তার বিপর্যস্ত জীবন ।
কোয়ার্টারটা পেরিয়েই সেই পুরনো শ্যাওলাময় ছোট নালাটার সামনে চলে আসলো প্রথম ।
প্রায় রাত্রি হয়ে যাওয়া সময়টায় জায়গাটাতে আশেপাশে কাউকেই দেখতে পাচ্ছেনা । প্রথমে সে অত ভালো করে তাকিয়ে দেখেনি । যখন দেখলো চোখে পড়লো জনা পাঁচেকের নির্বিঘ্নে গাঁজা খাওয়ায় সে বাঁধা হয়ে দাঁড়িয়েছে । সেই পাঁচজন তাকে দেখে আচমকা বিব্রত । বিপরীতক্রমে সে হকচকিত ।
শ্যাওলা কি কেবল সামনের নালাটাতেই নাকি তার মনেও বিষের মতো ঢুকে গেছে তা নিয়ে নিজের সাথে মিনিট দুয়েকের যুক্তি-তর্কের লড়াইয়ে অবতীর্ণ হলে শেষে মন বিষাক্ত হয়ে গেছে এই সিদ্ধান্তে আসলো । এরপর আর এই জায়গায় এক মুহূর্তও থাকবার কোন অর্থ হয়না ।
সেই স্মৃতিময় নালা থেকে হাঁটতে হাঁটতে চারশো গজ পশ্চীমে এসে খুঁজে নিতে চাইলো এখনো রাতের দিকে ছমছমে সেই অনুভূতিটা সমগ্র মনকে গ্রাস করে নেয় কিনা । জায়গাটায় দাঁড়ালো কতক্ষণ । বুক ভরে বাতাস নিতে দেখে গাছের পাতার পরিবর্তে তিরতির করে তার সম্পূর্ণ চেতনা কেঁপে যাচ্ছে ।
এতোটা বিশুদ্ধ আবেগ এতোদিন পরেও এভাবে সঞ্চারিত হতে পারে উপলব্ধি করে যুগপৎ অবাক এবং আনন্দিত হলো । তাহলে বিষাক্ততাই কেবল তার মনোজগতে নিজের আধিপত্য গেড়ে বসেনি ? তাহলে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবার জন্য সঞ্চারিত হতে থাকা দ্রবীভূত চেতনাও প্রয়োজনবোধে যথাসময়েই আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম । বেশ তো , কোনভাবে বেঁচে থাকবার নূন্যতম মানসিক রসদ সঞ্চিত থাকলে ক্ষতি কোথায় ?
কিছু দূরে দাঁড়িয়ে দেখতে চেষ্টা করলো আগের সময়ের ছোট ছোট দোকানগুলো চোখে পড়ে কিনা । আলো ঠিকই দেখতে পাচ্ছে কিন্তু দোকানগুলো থেকেই কি ? কৌতুহলী হয়ে সামনে এগোতে থাকলে একসময়ে তাকে হতাশ হতে হলো । সেই ছোট দোকানগুলোর কিছুই অবশিষ্ট নেই ।
একটা বেশ বড় ধরণের গ্রোসারী শপ খোলা হয়েছে । সবকিছুই সময়ের ফেরে এক অনাকাঙ্খিত ট্রান্সফর্মেশনের দিকে এগোয় । কোনভাবেই মেনে নেওয়া যায়না । এক অদ্ভুতুড়ে ছেলেমানুষী রাগ হতে থাকলো । যেন গ্রোসারী শপটা বোমা মেরে উড়িয়ে দিতে পারলেই ছোট ছোট দোকানগুলো অটোমেটিক আগের মতো এই জায়গাতে বসে যাবে ।
২ টাকার অসাধারণ কিছু লজেন্সের জন্য ৩৮ বছরে এসেও বড্ড মন টানছে । লজেন্সগুলা অন্য কোথাও পাওয়া যেতোনা । যেই একবার কিনতো বারবার ফিরে আসতো । ছোট ভাই অন্তুর সাথে এই লজেন্স কাড়াকাড়ি নিয়ে প্রাত্যহিক মারামারি নিয়ে মাইয়ের নাভিশ্বাস উঠে যেতো । সিডনীতে থাকা অন্তুর এসবের কথা মনে পড়ে কিনা বলতে পারেনা ।
পড়েনা নিশ্চয়ই । বছর দেড়েক আগে শেষ কল দিয়েছিলো অপদার্থ বড় ভাইটাকে । ঘনিষ্ঠজনদের মধ্যে সামাজিক প্রতিষ্ঠার দূরত্বটা ভাঙ্গা ইটের মতো । ইট যেমন একবার ভাঙ্গলে দুই টুকরা হয় তেমনি সহোদরদের মধ্যকার সামাজিক ব্যবধানটা হঠাৎ একদিন চোখের সামনে এমনভাবেই স্ফিত হয়ে ধরা দেয় যাকে কোন অপত্য স্নেহের ইরেজারই মুছে দিতে পারেনা । এসব অপ্রিয় ভাবনা ভেবে একটা গাঢ় দীর্ঘশ্বাস ফেলে ।
ছোট্ট অথচ অত্যন্ত প্রয়োজনীয় একটা ইচ্ছাপূরণের বেলাতেও এমন অজস্র মন বিষিয়ে দেওয়া চিন্তাকে প্রশ্রয় দিতে হচ্ছে চিন্তা করে বিরক্ত হলো । তারপর চারপাশের মানুষজনকে মন দিয়ে দেখতে শুরু করলো । আচ্ছা ২৫ বছর পরে এসে জায়গাটিকে দেখছে আমূল পাল্টে যেতে , মানুষগুলো কি পাল্টেছে নাকি একই যন্ত্রণাক্লিষ্ট মন নিয়ে হাসিমুখে চলাফেরা করার নাটক মঞ্চস্থ করে যাচ্ছে প্রতিদিন ? ভাবতে ভাবতে কোত্থেকে আচমকা বাতাস এসে আশেপাশের গাছ সমেত তাকেই উড়িয়ে নিয়ে যায় এমন এক অবস্থার সৃষ্টি করলো । আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখলো বৃষ্টি আসবার সম্ভাবনা আছে কিনা । ঠিক সেই মুহূর্তেই যেখানে একসময় কাঠগোলাপ আর শিউলী ফুল কুড়িয়ে নিতে প্রতিদিন বাড়ি ফিরে যাওয়াটা রুটিনে পরিণত হয়েছিলো সেখান থেকেই কান জোড়ায় আর্তচিৎকার ভেসে আসলো ।
মধ্যবিত্তের তৃতীয় শ্রেণীর বোকাচোদা জীবন যাপনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছে এসবে কান কিংবা মস্তিষ্ক কোনটাই দিতে নেই । সে এমনটা করে এসেছে বরাবর । কিন্তু পুরনো স্মৃতিই হোক কিংবা শৈশবের ঘ্রাণ লেগে থাকা জায়গাটির মাদকতাই হোক সে শুনতে পাওয়া অসহায় ধ্বনির দিক বরাবর ছুটে গেলো । চব্বিশ গজ ডানের দিকে সেই ধ্বনির মর্মার্থ টের পাওয়া গেলো । এক অষ্টাদশীর পায়জামা নেমে এসেছে পায়ের পাতা বরাবর , সালোয়ার কাঁধ বরাবর ক্রমশ গলার দিকে উঠে যাচ্ছে ।
ইতোমধ্যেই গলা আর স্তনের পাশে মনুষ্য কামড়ের বিকৃত হালকা রঙের আবির্ভাব , স্তন দুটো দুইজন ষণ্ডামার্কা ব্যাটাপুরুষ দলিতমথিত করা শুরু করে দিয়েছে । জায়গাটার নির্জনতা দেখেই বোঝা যাচ্ছে প্রায়শই এই স্থানে অনেক তরুণীর পায়জামা পায়ের পাতা পর্যন্ত নেমে যায় । অজস্র জোড়া স্তন দলিত মথিত হতে হতে একসময় তার অধিকারিণীর সমগ্র চেতনাকে অবশ করে দিয়ে মানবসভ্যতা অসভ্য গতিতে ক্রমশ এগিয়ে যায় এক অচিন্তনীয় নিস্পৃহতায় ।
কাঠগোলাপের ঘ্রাণই হোক কিংবা ইচ্ছাপূরণের স্বস্তি শৈশবের কাছে ফিরে আসা আগন্তুক নিমেষে তার যাপিত জীবনের মুখোশ খুলে ফেলে সামনেই অসহায় তরুণীর পক্ষে দাঁড়াতে রুদ্র মূর্তি ধারণ করলো । এক জান্তব চিৎকার দিয়ে মানিব্যাগের পকেটে থাকা ক্ষুর নিয়ে বিকৃত কামনা চরিতার্থ করতে হোশজ্ঞান হারিয়ে বসা জারজদের উপর আগপিছু না ভেবেই ঝাঁপিয়ে পড়লো ।
উপস্থিতদের কেউই এই অতর্কিত আক্রমনের প্রত্যাশা করেনি । এমনকি প্রায় সম্পূর্ণ নগ্ন সেই তরুণীটিও নয় । সে কাঁদতে কাঁদতেই লক্ষ্য করলো কি এক অসুরের শক্তি নিয়ে এক অসহায় চেহারার মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি তার পক্ষে লড়ে যায় । সেই ব্যক্তির হাতে কেবলমাত্র একটি ক্ষুর । এবড়োথেবড়ো কুদর্শন মুখে অজস্র ভাঙ্গাগড়ার ছাপ ।
কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে তার শক্ত চোয়ালই তরুণীর নিকট সবচেয়ে বড় ভরসার জায়গা হয়ে উঠেছে ।
মিনিট তিনেক পর রক্তাক্ত কবজির যন্ত্রণা নিয়ে আগন্তুক উঠে দাঁড়ালে সে দেখতে পেলো কেমন এক শ্রদ্ধা মিশ্রিত চোখে সেই তরুণী তার দিকে তাকিয়ে আছে । অথচ কিছুক্ষণ আগেই নোংরা জীবনের অভিজ্ঞতার পথে তার একটা বড় পাঠ নেওয়া হয়ে যাচ্ছিলো । আগন্তুক তরুণীর দিকে দুই সেকেন্ড তাকিয়েই অপ্রস্তুতবোধ করে অন্যদিকে তাকাতে চাইলে নিচে দেখতে পেলো যৌন যন্ত্রণা মেটাতে উদগ্র হারামজাদাগুলোর একজন পালাতে গিয়ে মানিব্যাগটাও নিয়ে যায়নি ।
দুইটা লাথি দিয়ে মানিব্যাগটা দূরে কোথাও ছিটকে ফেলে দেওয়ার সময় সামনে দাঁড়ানো তরুণীর খিলখিল হাসি , দূরে ট্রেনের হুইসেল আর নিজের হৃদয়ে পুনরুত্থানের সঙ্গীতের মূর্ছনায় আগন্তুক সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে রক্তাক্ত কবজিকে তোয়াক্কা না করেই নিজের ঠিকানার দিকে পা বাড়ালো ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।