টাকার বিপরীতে ডলারের শক্তিশালী অবস্থান এবং শেয়ারের দর নেমে যাওয়ায় মুনাফার আশায় বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশে ঝুঁকছেন বলে বাজার সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন।
একে ইতিবাচক বললেও কোনো কারণে চলে গেলে তা বাজারকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলতে পারে বলে আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক অর্থ উপদেষ্টা এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) দেশে আড়াই হাজার কোটি টাকার নিট বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে।
এই অঙ্ক গত বছরের পুরো সময়ের চেয়েও প্রায় ২০০ কোটি টাকা বেশি। আর জুলাই-ডিসেম্বর সময়ের চেয়ে প্রায় তিন গুণ বেশি।
চলতি ২০১৩-১৪ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থ্যাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে পুঁজিবাজারে ৩১ কোটি ডলারের (আড়াই হাজার কোটি টাকা) বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে। গত বছরের একই সময়ে এর পরিমাণ ছিল ১১ কোটি ৬০ লাখ ডলার।
২০১২-১৩ অর্থবছরের পুরো সময়ে (জুলাই-জুন) এসেছিল ২৮ কোটি ৭০ ডলার। ২০১১-১২ অর্থবছরে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগের পরিমাণ ছিল ২৪ কোটি ডলার।
পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ সহায়তাকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠান আইডিএলসি ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেডের ব্যাবস্থাপনা পরিচালক মো. মুনিরুজ্জামান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “প্রতিদিনই বিদেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা কিছু নতুন নতুন মুখ দেখতে পাচ্ছি।
”
এতে আস্থা ফিরে পেয়ে স্থানীয় বিনিয়োগকারীরাও বাজারমুখী হচ্ছেন এবং তার প্রভাবেই লেনদেনে সাম্প্রতিক চাঙাভাব দেখা যাচ্ছে বলে মনে করেন তিনি।
কী কারণে বিদেশি বিনিয়োগে প্রবাহ বেড়েছে- এই প্রশ্নে মুনিরুজ্জামান বলেন, “ব্যাংক খাতের শেয়ারসহ মৌলভিত্তিক শেয়ারের দর অনেক কমে গিয়েছিল। এছাড়া বেশ কিছু দিন ধরে আমরা বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হারকে স্থিতিশীল রাখতে পেরেছি। ”
বিদেশি বিনিয়োগ বেড়ে যাওয়াকে সার্বিক অর্থে ইতিবাচক বলে মনে করছেন পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা-বিএসইসি’র সাবেক চেয়ারম্যান মির্জ্জা আজিজ।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যে কোনো পুঁজিবাজারে ৪ থেকে ৫ শতাংশ বিদেশি বিনিয়োগ থাকা ভালো।
“২০০৯-১০ সালে বাজারে বড় ধসের পর বিদেশি বিনিয়োগ ছিল না বললেই চলে। গত বছরের প্রথম দিক থেকে কিছুটা আসতে শুরু করে। ”
মির্জ্জা আজিজও বলেন, বিশ্বের অনেক দেশের পুঁজিবাজারে ধস এবং এর বিপরীতে বাংলাদেশে টাকার শক্তিশালী অবস্থান বিদেশিদের আকৃষ্ট করেছে।
বিদেশি বিনিয়োগের উল্লম্ফনকে ইতিবাচক বললেও এই বিষয়ে সতর্ক থাকার প্রয়োজন রয়েছে বলেও মনে করেন তিনি।
“একটা ঘটনা মনে রাখতে হবে, ১৯৯৭/৯৮ সালে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কোরিয়া এবং থাইল্যান্ডে যে ধস নেমেছিল, তা কিন্তু এই মোবাইল (অল্প সময়ের জন্য যে বিনিয়োগ) বিদেশি বিনিয়োগের কারেণে ঘটেছিল।
”
বাংলাদেশে এখন আসা এই অর্থকেও ‘মোবাইল’ বিনিয়োগ আখ্যায়িত করেন তিনি। অর্থাৎ ভালো মুনাফার লোভে কিছু বিদেশি বিনিয়োগকারী এখানে আসছেন।
যে কোনো কারণে বিদেশি বিনিয়োগের একটি অংশ চলে গেলেও যাতে বাজারে তার নেতিবাচক প্রভাব না পড়ে অথবা এটাকে ‘গুজব’ হিসেবে ব্যবহার করে কারসাজি করার সুযোগ যেন কেউ নিতে না পারে, সেজন্য সরকার, নিয়ন্ত্রক সংস্থা, ডিএসই, সিএসই, বিনিয়োগকারী সবাইকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন তিনি।
মির্জ্জা আজিজ বলেন, “তারা (বিদেশি) যখন দেখবে- ডলারের দর কমে যেতে পারে অথবা রাজনৈতিক অস্থিরতা আসন্ন, তখন তারা কিন্তু বিক্রি-টিক্রি করে আবার দ্রুত চলে যাবেন। ”
তবে ডলারের দর কমার কোনো লক্ষণ না দেখার পাশাপাশি রপ্তানি আয়, রিজার্ভ ও রেমিটেন্স প্রবাহ ভাল থাকায় বড় ধরনের ঝুঁকিতে পড়তে হবে না বলে আশা করছেন তিনি।
দেশের প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের (ডিএসই) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ সালে প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ এসেছে, যা আগের বছর ছিল ৮০০ কোটি টাকা। অর্থাৎ বিদায়ী বছরে ঢাকার পুঁজিবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ প্রায় ১৪৫ শতাংশ বেড়েছে।
গত বছরে এই বাজারে প্রায় ৩ হাজার ৩৬১ কোটি টাকার বৈদেশিক লেনদেন হয়। এর মধ্যে বিদেশিরা দুই হাজার ৬৫২ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন, বিক্রি করেছেন ৭০৯ কোটি টাকার শেয়ার।
এতে বছর শেষে প্রকৃত বিদেশি বিনিয়োগ দাঁড়ায় ১ হাজার ৯৪৪ কোটি টাকা; যা ২০১২ সালে ছিল ৭৯৩ কোটি টাকা।
১৯৮০ সালের ফরেন প্রাইভেট ইনভেস্টমেন্ট (প্রমোশন অ্যান্ড প্রোটেকশন) আইনের আওতায় বিদেশিরা সহজ শর্তে বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে বিনিয়োগ করতে পারে। পরে মুনাফা তুলে নেয়ার ক্ষেত্রে কোনো বিধি-নিষেধ নেই।
তবে প্রাইভেট প্লেসমেন্টের মাধ্যমে কোম্পানির প্রাথমিক শেয়ার কিনলে তাতে নির্ধারিত সময়ের জন্য লক ইন থাকে। অর্থাৎ একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত বিদেশিরা ওইসব শেয়ার বিক্রি করতে পারেন না।
মনিরুজ্জামান বলেন,“যখন কোম্পানির শেয়ারের বাজারমূল্য মৌলভিত্তির নিচে নেমে আসে, তখনি বিদেশি বিনিয়োগকারীরা বিনিয়োগে আকৃষ্ট হন।
বিশেষ করে যখন বাজারের ওপর অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর হতাশা বাড়তে থাকে, সেই সময়েই বিদেশিরা শেয়ার কেনেন।
“আর বাজারের প্রতি যখন অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর আগ্রহ বাড়ে, তখন বিদেশিরা বিক্রি করেন। এখন সেটি হচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। ”
মির্জ্জা আজিজ বলেন, অতীতের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, কোনো দেশে সরকার বদলকে কেন্দ্র করে যখন রাজনৈতিক অস্থিরতা দেখা দেয়, তখন শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়ে।
কারণ, রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে দেশীয় বিনিয়োগকারীদের মধ্যে হতাশা তৈরি হয়, যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে পুঁজিবাজারে।
এই সুযোগটি কাজে লাগান বিদেশিরা।
“পরে যখন দাম বাড়ে, তখন তারা বিক্রি করে দিয়ে মুনাফা করেন,” বলেন এই পুঁজিবাজার বিশ্লেষক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।