প্রিয় মিস্টার নিকন,
আপনি আমাকে চিনবেন না। আমি আপনাদের জাপান থেকে অনেক দূরে অবস্থিত বাংলার পদ্মাপারে বড় হয়ে ওঠা এক চালশে ছুঁই ছুঁই পুরুষ, পদ্মার বুকে সাদা রঙের পালতোলা নৌকো দেখে যার শৈশব অতিবাহিত হয়েছে। আপনাকে আমার কিছু অনুরোধ ব্যাক্ত করব বলে আজ চিঠি লিখতে বসা। জানিনা, এই ভাষায় জানানো আকুতিটুকু আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছাবে কিনা। যাই হোক, বাংলাদেশের পদ্মা নদীর নাম বোধ করি শুনে থাকবেন যদিও এর তীর ঘেঁষা রাজশাহী নগরীর কথা হয়ত আপনার অজানা।
বেড়ে উঠেছি সেই নগরীর ছোট্ট একটি ভূখণ্ড মতিহারের সবুজ চত্বরে। পদ্মা নদীর কথা বলছিলাম কারণ পদ্মার কোলেই আমার কিংবা এ শহরের জন্ম এবং বেড়ে ওঠা।
ছোটবেলায় আমাদের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণের বিস্ময় ছিল বছরান্তে একবার অনুষ্ঠিত আলোকচিত্র প্রদর্শনী। মাঝে মাঝে বাবার আঙুল ধরে সেখানে যাবার সুযোগ পেতাম আর সেখান থেকেই পদ্মা নদীর নানান ছবি দেখে প্রথম আলোকচিত্রের প্রেমে পরি। ভাল লাগার ঘোর কাটতে দীর্ঘ দিবস রজনী কেটে যেত।
তবে ছবি দেখে ভয়ও পেতাম। মনে হত, এই বিদ্যাটি অর্জন ভীষণ কঠিন। তখন ক্যামেরার দেখেও কেমন সন্ত্রস্ত হতাম। ভাবতাম যারা ছবি তোলে তাঁরা বোধ হয় ভিন্ন জগতের বাসিন্দা। আশির দশকের গোড়ায় মাত্র দুই ধরণের মানুষের হাতে ক্যামেরা দেখেছি বলে মনে পরে।
এক স্টুডিওর ক্যামেরাম্যান আর দুই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের আনুষ্ঠানিক আলোকচিত্রগ্রাহক।
ছোটবেলায় আমার বাবার মাধ্যমে আপনার সাথে আমার প্রথম পরিচয়। ঠিক কিভাবে আপনার এক ছোট্ট ক্যামেরা আমার বাবার হাতে এল, এখন আর তা স্মরণে নেই, তবে কিছুদিন পরে সেটি কিভাবে যেন উধাও হয়ে গেল। তখন আমার বয়স পাঁচ কি ছয়। তবে ঠিক তখন থেকেই আপনার নামটি আমার মর্মমূলে প্রবেশ করেছে।
কি অদ্ভুত নাম! নিকন, বেশ রিনঝিন করতে থাকে, একটা রেশ রয়ে যায়। ওই যে আপনার নাম একবার শুনেছি, আমার আর সারা জীবনে তা ভোলা হয়নি।
যখন ক্যামেরা কিনব বলে ঠিক করলাম, তখন কিভাবে যেন পেনট্যাক্স কিনে ফেলেছি আপনাকে ভুলে, তাও আবার বিদেশ বিভূঁই- এ এসে। তবে সেটির প্রতি ভালোবাসা জন্মাবার আগেই আপনার ডি ৪০ কেনা সারা। আপনার ক্যামেরা কিনব, এ ছিল আমার সারা জীবনের এক স্বপ্নের মতন।
ইটালির এক শপিং মলে যেই না আপনার ক্যামেরার একটা পছন্দসই দাম দেখলাম, সাথে সাথে ছোঁ মেরে কিনে ফেলেছি! আমার স্পষ্ট মনে আছে সেই রাত্রির কথা যখন আপনার ক্যামেরা ডি ৪০ নিয়ে সারারাত শুধু নাড়াচাড়া করেছি, এক ফোঁটা ঘুমাতে পারিনি। আপনাকে বলতেই হয় যে আপনি আমার জীবনে এক ব্যাগ মুগ্ধতা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়। আর তারপর কত কত ছবি যে তুলেছি আপনার মাধ্যমে, তাঁর ইয়ত্তা নেই। পুরো ইটালি ঘুরেছি আপনার সাথে। যে আমি ছোটবেলায় আলোকচিত্র প্রদর্শনী দেখে বিস্মিত হয়েছি, সেই আমার আলোকচিত্র ঠাই পেয়েছে একটি প্রদর্শনীতে, সেই মতিহার অঙ্গনেই, আপনি কি ভাবতে পারেন? আমি তো এখনো কল্পনাই করতে পারিনা।
পদ্মার জল শুকিয়ে গেছে আজ। পদ্মার বুক জুরে নিষ্ঠুর চরের আবাহন। যে আমি ক্যামেরা কিনে ভেবেছিলাম পদ্মার বুকে পাল তোলা নৌকোর ছবি তুলবো, আজ পদ্মার জলের সাথে আমার চোখও শুকিয়ে আসে তাকে দেখলে! পদ্মার ছবি আর তোলা হয়নি সেভাবে, রাজশাহীতে যখন আপনার ক্যামেরা নিয়ে গিয়েছি, কত মানুষ প্রথমে ভেবেছে আমি বুঝি ফটোগ্রাফার। সন্ধ্যায় ট্রাইপড বসিয়ে বরেন্দ্র জাদুঘরের ছবি তোলার সময় এক অপরিচিত পথিক পুরোটা সময় আমার প্রস্তুতিটা খেয়াল করলেন। পরে জিজ্ঞেস করলেন, আপনার ছবি পরে কোন একসময় দেখতে চাই! মনে আছে, আমার চোখে জল চলে এসেছিল।
ক্যামেরা দিয়ে স্থির চিত্রগ্রহণ নিছক ছবি তোলা নয় তাই, এ আমার জীবনের এক অমুল্য অংশ। যখন আমার কন্যা একটু একটু করে বড় হচ্ছিল, তখন তাঁর এই বেড়ে ওঠার স্মৃতিগুলি আপনার মাধ্যমে আমি ধারণ করে যে কি সন্তুষ্টি পেয়েছি, তা বলার নয়।
একটি বিষয়ের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকৃষ্ট করতে চাই আজ। আপনি আপনাদের বিগিনার বা নবীন শিক্ষার্থীদের জন্য যে ক্যামেরা ফি বছর উৎপাদন এবং বাজারজাত করেন, সেই ক্যামেরার সাথে আপনি একটি লেন্স জুরে দেন যাকে আমরা কিট লেন্স বলি। আমি নিজে এই ১৮-৫৫ মিমি এফ ৩.৫-৫.৬ কিনে এবং এর সাথে ছবি তুলে খুব খুশী।
তবে এই কিট লেন্সের ওয়াইড আ্যাঙ্গেল নিয়ে ভারী বিপত্তিতে পরি মাঝে মাঝে। কারণ আমি যে ছবি তুলতে চাই, ২৮ মিমি আমাকে সে ছবি তোলার ক্ষেত্রে যথেষ্ট জায়গা দেয়না, আর এর ৩.৫ এফ স্টপ অল্প আলোয় আমাকে নাকানি চুবানি খাইয়ে মারে। তাছাড়া এই এন্ডে বেশ ফ্লেয়ার আছে এই লেন্সের, যা এই মানের প্লাস্টিক লেন্সের ক্ষেত্রে খুব অস্বাভাবিক নয়।
আপনারা ২০০৬ সাল থেকে আজ পর্যন্ত নবীনদের জন্য যে ডি এক্স লেন্সগুলি উৎপাদন করে চলেছেন তার মধ্যে এই কিট লেন্স, ৫৫-২০০ মিমি ভিআর এবং ৩৫ মিমি এফ ১.৮ জি লেন্স তিনটি একইসাথে সস্তা এবং চমৎকার ইমেজ গুনের জন্য বেশ জনপ্রিয়। মানে ওপরোক্ত তিনটি লেন্সই আমাদের মতন ছা পোষা মানুষের একমাত্র সহায়।
এগুলি ছাড়া আর যে লেন্সগুলি আছে সেগুলি আমাদের ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তবে আমি বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করেছি যে আপনারা বেশ অনেকদিন যাবত কোন ওয়াইড আ্যাঙ্গেল প্রাইম ডিএক্স লেন্স বাজারে বের করেন নি। আর এখানেই আমার অভিযোগ, আমার আপত্তি।
আপনারা যখন ডি এক্স লেন্স হিসেবে বাজারে ৩৫ মিমি এফ ১.৮ জি প্রাইম বের করেছিলেন, আমার মনে আছে, আমি এক দৌড়ে গিয়ে কিনে এনেছিলাম। আর দাম $২০০ (১৬,০০০ টাকা) ছিল এক অসাধারণ প্রাইস পয়েন্ট।
শুধু তাই নয় এই লেন্সের ইমেজগুন, নির্মাণগুন, আকার আকৃতি সবই এক কথায় দুর্দান্ত। এই লেন্স আপনাদের ভাণ্ডারে আমাদের জন্য এক ব্রহ্মাস্ত্র বলা যায়। এমন কোন ডি এক্স শুটার নেই বা থাকার কথা নয়, যার কাছে এই লেন্স নেই! সত্যি বলতে কি আমরা যারা একটু আঁধারের ছবি তুলতে চাই, বলা যায় আপনি আমাদের বাঁচিয়ে দিয়েছিলেন সেই সময়। তবে আশার বেলুনও ফুলিয়ে দিয়েছিলেন সেই সাথে। আমরা ভেবেছিলাম আপনারা ৩৫ মিমির পাশাপাশি আরও কিছু ডি এক্স প্রাইম লেন্স বাজারে আনবেন।
বিশেষ করে ওয়াইড লেন্স। আমরা আশা করেছিলাম আপনারা ৩৫ এর পর পর ১৪ কিংবা ১৬ ফোকাল দুরত্বের ছোট কমপ্যাক্ট কিছু লেন্স আমাদের জন্য উৎপাদন করবেন। আর ডি এক্স লেন্সের যে বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ কমপ্যাক্ট, তুলনামুলক ভাবে সস্তা- সবই আমরা পেয়ে যাব এক সাথে। কিন্তু দীর্ঘ প্রায় পাঁচ বছর কেটে যাবার পরেও আপনি আমাদের জন্য কিচ্ছু দিলেন না। আমাদেরও আশার বেলুন ফুলতে ফুলতে একসময় ফেটেই গেল!
আমরা যদি এখন ওয়াইড তুলতে চাই, আমাদের জন্য আপনার অপশন কি? ১৪-২৪, ১৬-৩৫ এগুলি কি আপনি আমাদের অপশন মনে করেন? এগুলির আকার, ওজন, দাম-কোনটিই কি আমাদের জন্য আদর্শ বলে আপনার মনে হয়? আমাদের মতন হাজারো লাখো শৌখিন চিত্রগ্রাহক যে আশা যে আস্থা নিয়ে আপনার সিস্টেমকে আপন করে নিয়েছি, আজ পাঁচ পাঁচটি টি বছর কেটে গেলেও আপনি আমাদেরকে একটি ওয়াইড আ্যাঙ্গেল ডি এক্স প্রাইম লেন্স উপহার দিলেন না, তাহলে কি এখন আমরা সদলবলে মাইক্রো ফোর থার্ড ক্যামেরার কাছে আত্মসমর্পন করব? এই কি আপনি চেয়েছিলেন? তারা বছর বছর ছোট ছোট কম্প্যাক্ট ওয়াইড লেন্স তৈরি করবে আর আমরা তা চেয়ে চেয়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলব?
আপনারা ১ ইঞ্চির সেন্সর যুক্ত ক্যামেরা বের করছেন, মিররলেস বের করছেন, ভোক্তাদের জন্য সাশ্রয়ী ফুলফ্রেম ক্যামেরা বের করছেন, আপনারা এ পি এস সি সেন্সর ঢুকিয়ে দিচ্ছেন আপনাদের পকেট ক্যামেরায়, বছরভর ফুল ফ্রেম লেন্স বের করছেন।
দুই তিনটি ডি এক্স প্রাইম লেন্স আপনারা আমাদের জন্য নির্মাণ করতে পারেন না, তাহলে আমরা এখন কোথায় যাবো? আপনাদের প্রকৌশলীরা ক্যামেরা জগতে পারেনা এমন কিছু কি আছে? ক্যামেরার এস এল আর জগতে পঞ্চাশ বছর ধরে আপনাদের গর্বিত পদাচরন, আপনারা ৮৫ মিলিয়ন সংখ্যক লেন্স নির্মাণের গর্বিত উৎপাদক , আমাদেরকে আপনারা দিয়েছেন ভাল ছবি তোলার অসাধারণ সব মাধ্যম, আমরাও তা আপন করে নিয়েছি। কিন্তু আপনাদের ভাণ্ডার আমাদের জন্য এখনও অসম্পূর্ণ, এটি সত্যিই বেদনাদায়ক।
প্লিজ মিস্টার নিকন, আপনি কি শুনছেন? আমিও ল্যান্ডস্কেপ তুলতে চাই, আমিও ওয়াইড আ্যাঙ্গেলের অসাধারণ পারস্পেক্টিভের সন্ধান পেতে চাই, আমিও আমার কন্যাকে সামনে রেখে পুরো বিশ্ব চরাচরকে আমার ছবিতে উপস্থাপন করতে চাই! মানুষের মুখ, কিট-পতঙ্গের ছবি আর স্ট্রিট তুলতে তুলতে আমি ক্লান্ত। আপনি যদি ৮৫ মিমির লেন্সকে ৫০ মিমির সাইজে উৎপাদন করতে সক্ষম হন, তাহলে একটি ছোট্ট ডি এক্স ১৪ মিমি এফ ২.৮ কি নির্মাণ করা আপনার পক্ষে কি অসম্ভব? একটু উদ্যোগী হয়ে আরেকটু আন্তরিক হয়ে আমাদের আকুতিতে আপনি আপনারা সাড়া দিতে পারেন না? আমরা চাইনা আর ফুল ফ্রেম ভারী বড়, বড় সব লেন্স। আমরা চাই, ছোট্ট ডি এক্স প্রাইম লেন্স পাক তার যোগ্য মনোযোগ।
একবার তাকিয়ে দেখুন আপনাদের ক্যামেরার দিকে, লেন্সের দিকে? আপনাদের লাভের সিংহভাগের যোগানদাতা হচ্ছে ডি এক্স। তো এই ফরম্যাটের প্রাইম লেন্সের প্রতি আপনাদের এত বিমাতাসুলভ আচরন কেন, বলুন? এইটা কোন ধরনের মার্কেটিং স্ট্র্যাটেজি?
চোখ দুটি একটু খুলুন মিস্টার নিকুন। দেখুন আপনার চারপাশের মাইক্রো ফোর থার্ডের লেন্স জগত কিভাবে দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তাদের ধরতে চাইলে আমাদের মতন ডি এক্স শুটারের কাছে আপনাকে আসতে হবেনা? আসুন, আপনার নতুন ডি এক্স প্রাইম ওয়াইড লেন্সগুলি নিয়ে আবার আসুন। আমরা অপেক্ষা করছি মিস্টার নিকন।
অপেক্ষা করছি। আমাদের অপেক্ষার পালা আর দীর্ঘ করবেন না, প্লিজ!
ভাল থাকুন। নতুন বছর আপনাদের জন্য শুভ হোক, মঙ্গলময় হোক। আপনাদের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক।
ইতি,
মনি শামিম
বোলোনিয়া, ইটালি, জানুয়ারি, ২০১৪।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।