জাতীয় সংস্কৃতি উৎসব হিসেবে একুশের বইমেলা অন্যতম। এই বইমেলার পথিকৃৎ চিত্তরঞ্জন সাহা। প্রকাশনা-শিল্পকে এগিয়ে নিতে এ ধরনের সার্বজনীন উৎসব বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছে। আমাদের বইমেলা তাই বইপ্রেমী মানুষের কাছে প্রাণের মেলা। এর সঙ্গে আমাদের সংস্কৃতি যেভাবে মিলেমিশে আছে তার আবেদন অতুলনীয়।
আমাদের প্রকাশনা শিল্পের সার্বিক অবস্থার বিপরীতে এই প্রাণের উৎসবকে জমিয়ে তুলতে এখনো অনেক কিছু করার বাকি রয়ে গেছে। এ কথা এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই, সুশিক্ষা এবং প্রকাশনা-শিল্প পরস্পরের সহযোগী। জাতিগত উন্নয়নের পূর্বশর্ত হিসেবে সুশিক্ষা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই শিক্ষাকে অর্ধবহ করতে প্রকাশনা শিল্পের মজবুত ভিত্তি চাই। আর সৃজনশীলতা ও মননশীলতার বিকাশের কথা উঠলেই চাই, ভালো বই।
এ কারণেই মননশীলতার বিকাশে প্রকাশনার গুরুত্বকে আলাদাভাবে আলোচনায় রাখতে হয়। উন্নত দেশ ও জাতির স্বপ্ন বাস্তবায়নে একটি উন্নত প্রকাশনা শিল্পের প্রয়োজন। বৈশ্বিক অগ্রগতির দিকে তাকালে অবাধ তথ্যপ্রবাহের এই যুগে জ্ঞানে-বিজ্ঞানে প্রজন্মকে অগ্রসর হতেই হবে। বাংলাদেশে প্রকাশনা শিল্পটি সমৃদ্ধ শিল্পে পরিণত হওয়ার পথ ধরেই এগোচ্ছে। প্রকাশনা শিল্প প্রত্যাশিতভাবে এগিয়ে না গেলেও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যেতে সব পর্যায়েই উন্নয়নের সর্বোচ্চ প্রচেষ্টা চলছে।
কিন্তু এ পথটি মসৃণ নয়। ভালো লেখক, ভালো প্রকাশক ও ভালো পাঠকের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারলেই সুশিক্ষা ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব। বিশ্বায়নের যুগে এখন কমে যাচ্ছে মননশীলতার চর্চা। এ ছাড়া ডিজিটাল ভাচর্্যুয়াল জগতে বুঁধ থাকা প্রজন্মও ঝুঁকে পড়েছে অনলাইন-ইন্টারনেট, ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, মোবাইল ফোন এবং আকাশ সংস্কৃতির রঙিন পথে। এসব পেরিয়ে সত্যি বলতে বই পড়ার প্রতি আগ্রহ কমে যাচ্ছে।
অবশ্য একুশের বইমেলা নতুন করে পাঠকের মনে প্রাণের সঞ্চার করে। বছরজুড়ে লেখক, প্রকাশক থেকে শুরু করে বইপ্রেমী পাঠকরাও নতুন করে জেগে এই মেলাকে ঘিরে। বইমেলা এখন জাতীয় উৎসব হিসেবে প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মিলনমেলায় এসে পেঁৗছেছে। যা বাংলাদেশের সংস্কৃতিকে বিশ্ব-দরবারে সাংস্কৃতিক উৎকর্ষের প্রতীক হিসেবে প্রতিষ্ঠার উপযুক্ত সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। আর সেদিকে লেখক-প্রকাশকদের নিয়ে বাংলা একাডেমির আয়োজনে বইমেলা সৃজনশীলতা ও নান্দনিকতার সাংস্কৃতিক উৎসবে পরিণত করার প্রত্যয়ে অবিরাম কাজ করছে।
এ কারণেই বইমেলা সব শ্রেণীর মানুষের মিলনমেলায় পরিণত হয়। শুধু বইয়ের ক্রেতা-পাঠকরাই নন লেখক-পাঠক, প্রকাশক-ক্রেতা-দর্শক এবং মিডিয়ার সাহচর্যে সর্বোতভাবে একটি জাতীয় মিলনমেলায় পরিণত হয়। প্রকাশকরাও নব উদ্যমে বিনিয়োগ করার জন্যও এ সময়টাকে বেছে নিয়ে থাকেন। বইপ্রেমীদের হাতে নতুন বই তুলে দিতে তারা বইমেলা শুরুর আগ থেকেই ফেব্রুয়ারি-জুড়ে প্রকাশনার কর্মযজ্ঞে ব্যস্ত সময় কাটান। এর ইতিবাচক ফল পাওয়া যায় বইমেলায়।
বইমেলার শুরুর দিন থেকে শেষ দিন পর্যন্ত নানান স্বাদের নতুন নতুন বই আসতে থাকে। এ ছাড়া আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে, বছরজুড়ে এত বড় আকারে প্রকাশনার প্রচলন না থাকায় পাঠকরাও মনস্তাত্তি্বকভাবে বইমেলা কেন্দ্রিক হয়ে যাচ্ছে। এটা ধর্তব্য বিষয়। তবে প্রকাশনা শিল্পকে আরও দীর্ঘস্থায়ী কাঠামোতে দাঁড় করাতে বইমেলা হয়তো একটি প্রভাবক হিসেবে কাজ করবে। শিল্প হিসেবে মেলাকেন্দ্রিক নির্ভরতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।
কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে সেটা যথেষ্ট দুরূহ বলেই সমীচীন। এ জন্য এখন বিকল্প উপায়গুলো নিয়ে সবার ভাবার সময় এসেছে। প্রকাশনা শিল্পকে টিকিয়ে রাখতে বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভাগীয় এবং জেলাভিত্তিক বইমেলার আয়োজনকে কীভাবে আরও জনপ্রিয় করা যায় তা নিয়ে সংশ্লিষ্টদের গভীরভাবে ভাবার সময় এসেছে। ইতিবাচক পরিবর্তনের জন্য পাঠকদের কীভাবে বইমুখী করা যায় সেটাও কর্ম-পরিকল্পনায় রাখতে হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রেই ইতিবাচক পরিবর্তনের অংশ হিসেবে প্রকাশনার প্রতি প্রকাশকরা মনোযোগী ও যত্নশীল হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
তবে সব কিছুর ফল পাওয়া যাবে ভালো ও সচেতন পাঠক সৃষ্টির মাধ্যমে। বইকেনা ও বইপড়া এ দুটি বিষয় প্রকাশনা শিল্পের আরও ভালো করে পর্যবেক্ষণের দাবি রাখে। নতুন বই কেনা ও বই পড়ার আগ্রহ বাড়াতে স্কুলপর্যায়ের সিলেবাস থেকেই ইতোমধ্যে বিভিন্ন কর্ম-পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। এগুলোকে আরও বাস্তবমুখী পরিকল্পনার সঙ্গে যোগ করতে হবে। এর দুর্দান্ত উদাহরণ বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র।
একই সঙ্গে তরুণ পাঠকদের মধ্যে বই কেনা ও বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। সম্ভাবনাময় আগামী প্রজন্মকে জাগ্রত করতে এই পঠন বিমুখতার অভ্যাসকে বদলানোর দায়িত্ব এককভাবে কারও নয়। বইপাঠে নিজের সন্তানকে উৎসাহ প্রদান করতে হবে পরিবারের অভিভাবকদের। শিক্ষাঙ্গনে পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি সুখপাঠ্য সাহিত্যের সমাবেশ করতে হবে। সবচেয়ে বড় কথা সম্ভাব্য সব শ্রেণী থেকে নতুন প্রজন্মকে বইমুখী করতে হবে।
বই পড়ার চর্চা বাড়াতে হবে। বইমেলা নতুন করে প্রকাশক, লেখক ও পাঠকের মধ্যে সে অমিত সম্ভাবনার যোগসূত্র স্থাপন করে দেয় সমৃদ্ধ আগামীর বুনিয়াদ গড়তে তাকে কাজে লাগাতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।