আমি সত্য জানতে চাই
বাংলা চলচ্চিত্রের আকাশ যে কয়েকজন নক্ষত্রের আলোতে আলোকিত, ঋত্বিক ঘটক তাঁদের মধ্যে অন্যতম। এখন পর্যন্ত বিভিন্ন চলচ্চিত্র প্রেমীদের কাছে তাঁর পরিচালিত ছবিগুলো একেকটি ইতিহাস হয়ে আছে। বিখ্যাত বাঙালি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক কুমার ঘটক। ঋত্বিক ঘটক নামে যিনি সমাধিক পরিচিত। ভারতবর্ষের মননশীল জীবনবাদী ছবির জগতে যাদের নাম আলোচিত হয়, তাদের মধ্যে অন্যতম হচ্ছে ঋত্বিক ঘটক।
তাঁর প্রথম পরিচালিত ছবি নাগরিক এবং প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত পূর্ণদৈর্ঘ্য ছবি অযান্ত্রিক। বাংলা চলচ্চিত্র পরিচালকদের মধ্যে তিনি সত্যজিৎ রায় এবং মৃণাল সেনের সাথে তুলনীয়। তাঁর জন্ম বাংলাদেশে। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে তাঁর পরিবার কলকাতায় চলে যায়। ভিন্নধর্মী চলচ্চিত্র নির্মাণের কারণে তিনি যেমন প্রশংসিত ছিলেন; ঠিক তেমনি বিতর্কিত ভূমিকাও রাখেন।
বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাসে তাঁর নাম বহুল উচ্চারিত। ১৯৭৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি তিনি মৃত্যুবরণ করেন। আজ এই চলচ্চিত্র ব্যক্তিত্বের ৩৮তম মৃত্যুদিন। মৃত্যুদিনে তাঁর প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধা।
ঋত্বিক ঘটক ১৯২৫ সালের ৪ই নভেম্বর বাংলাদেশের ঢাকা জেলার জিন্দাবজারের ঋষিকেশ দাশ লেনে ঐতিহ্যময় ঘটক বংশে জন্মগ্রহণ করেন।
ঋত্বিক ঘটকের বংশের আদি পুরুষ পণ্ডিত কবি ভট্টনারায়ণ। তাঁর পিতা সুরেশচন্দ্র ঘটক এবং মায়ের নাম ইন্দুবালা দেবী। তিনি ছিলেন বাবা-মায়ের ১১তম এবং কনিষ্ঠতম সন্তান। তাঁর বাবা সুরেশ চন্দ্র ঘটক একজন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন এবং তিনি কবিতা ও নাটক লিখতেন। তার বদলীর চাকুরীর কারণে তারা ঘুরেছেন দেশের নানা প্রান্তে।
তাঁর বাবা অবসরের পর রাজশাহীতে গিয়ে বাড়ি করেন; উল্লেখ্য যে তাদের রাজশাহীর বাড়িটাকে এখন হোমিওপ্যাথিক কলেজ করা হয়েছে এবং তার নাম ঋত্বিক ঘটক হোমিওপ্যাথিক কলেজ। ঋত্বিক ঘটকের শৈশবের একটা বড় সময় কেটেছে রাজশাহী শহরে। তিনি রাজশাহীর কলেজিয়েট স্কুল থেকে মেট্রিক পাশ করেন এবং ১৯৪৬ সালে রাজশাহী কলেজ থেকে আই.এ পাশ করেন। ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে পূর্ববঙ্গের প্রচুর লোক কলকাতায় আশ্রয় নেয় এবং এরই ধারাবাহিকতায় তাঁর পরিবারও কলকাতায় চলে যায়। তবে নিজের জন্মভূমি ত্যাগ করে শরনার্থী হবার মর্মবেদনা ঋত্বিক কোনোদিন ভুলতে পারেননি এবং তাঁর জীবন-দর্শন নির্মাণে এই ঘটনা ছিল সবচেয়ে বড় প্রভাবক যা পরবর্তীকালে তার সৃষ্টির মধ্যে বারংবার ফুটে ওঠে।
কলকাতায় ঋত্বিক ঘটক ১৯৪৮ সালে বহরমপুর কৃষ্ণনাথ কলেজ থেকে বি.এ ডিগ্রি লাভ করেন এবং ১৯৫০ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজিতে এম এ কোর্সে ভর্তি হন। এরই মাঝে নাটকের প্রতি এতই আকৃষ্ট হয়ে পড়ে যে নাটকের নেশাতেই এম.এ কোর্স শেষ করেও পরীক্ষা না দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় ত্যাগ করেন তিনি।
ছাত্র অবস্থাতেই লেখালেখির সাথে যুক্ত ঋত্বিক ঘটক। ১৯৪৮ সালে ঋত্বিক ঘটক লেখেন তাঁর প্রথম নাটক কালো সায়র। একই বছর তিনি নবান্ন নামক পুণর্জাগরণমূলক নাটকে অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫১ সালে তিনি ভারতীয় গণনাট্য সংঘে (আইপিটিএ) যোগদান করেন। এসময় তিনি নাটক লেখেন, পরিচালনা করেন ও অভিনয় করেন এবং বের্টোল্ট ব্রেশ্ট ও নিকোলাই গোগোল-এর রচনাবলি বাংলায় অনুবাদ করেন। ঋত্বিক ঘটক ১৯৫১ সালে চলচ্চিত্র জগতে পা রাখেন নিমাই ঘোষের ছিন্নমূল সিনেমার মধ্য দিয়ে; তিনি এই ছবিতে একই সাথে অভিনয় এবং বিমল রায়ের সহকারী পরিচালক হিসাবে কাজ করেন। এর দু'বছর পর তাঁর একক পরিচালনায় মুক্তি পায় নাগরিক। দু'টি চলচ্চিত্রই ভারতীয় চলচ্চিত্রের গতানুগতিক ধারাকে জোর ঝাঁকুনি দিতে সমর্থ হয়েছিল।
ছিন্নমূল ছাড়াও কুমারী মন, সুবর্ণরেখা, তিতাস একটি নদীর নাম, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ইত্যাদি ছবিতে অভিনয় করেন ঋত্বিক ঘটক। ১৯৪৩ এর দুর্ভিক্ষ এবং ১৯৪৭ এর ভারত বিভাগের পরে শরণার্থীদের অস্তিত্বের সংকট তাঁকে গভীরভাবে আলোড়িত করে এবং পরবর্তী জীবনে তাঁর চলচ্চিত্রে এর স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। অযান্ত্রিক মুক্তির সাথে সাথেই তিনি শক্তিশালী চলচ্চিত্রকার, হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এরপর একে একে নির্মাণ করেন চলচ্চিত্র- বাড়ি থেকে পালিয়ে, মেঘে ঢাকা তারা, কোমল গান্ধার, সুবর্ণ রেখা, তিতাস একটি নদীর নাম, যুক্তি তক্কো আর গপ্পো। তথ্যচিত্র নির্মান করেন ওরাও, ওস্তাদ আলাউদ্দিন খান, সায়েন্টিস্টস অফ টুমরো, পুরুলিয়া চৌ ইত্যাদি।
১৯৫৭ সালে বিমল রায়ের জ্বালা নাটকটি তিনি লেখেন এবং পরিচালনা করেন। এটিই তাঁর পরিচালনায় শেষ নাটক।
তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যে মেঘে ঢাকা তারা (১৯৬০), কোমল গান্ধার (১৯৬১) এবং সুবর্ণরেখা (১৯৬২) অন্যতম। এই তিনটি চলচ্চিত্রকে ট্রিলজি বা ত্রয়ী হিসাবে চিহ্নিত করা হয়, যার মাধ্যমে কলকাতার তৎকালীন অবস্থা এবং উদ্বাস্তু জীবনের রুঢ় বাস্তবতা চিত্রিত হয়েছে। তবে কোমল গান্ধার এবং সুবর্ণরেখা'র ব্যবসায়িক ব্যর্থতার কারণে এই দশকে আর কোন চলচ্চিত্র নির্মাণ তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি।
ঋত্বিক ঘটকের চলচ্চিত্রের জগতে পুণরাবির্ভাব ঘটে সত্তরের দশকে। সুবর্ণরেখা চলচ্চিত্র নির্মাণের পর প্রায় এক যুগ বিরতি নিয়ে অদ্বৈত মল্লবর্মণের তিতাস একটি নদীর নাম শীর্ষক উপন্যাসের কাহিনীকে উপজীব্য করে ঋত্বিক ঘটক ১৯৭৩ সালে স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আগমন করে তিতাস একটি নদীর নাম শিরোনামে চলচ্চিত্র পরিচালনা করেন যখন এক বাংলাদেশী প্রযোজক তিতাস একটি নদীর নাম (চলচ্চিত্র) নির্মাণে এগিয়ে আসেন। অদ্বৈত মল্লবর্মন রচিত একই নামের বাংলা সাহিত্যের একটি বিখ্যাত উপন্যাস ঋত্বিক ঘটকের পরিচালনায় চলচ্চিত্রে রূপদান সম্পন্ন হয়। তিতাস একটি নদীর নাম চলচ্চিত্র আকারে মুক্তি পায় ১৯৭৩ সালে। মাঝখানে কোন পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র তৈরী করেননি তিনি।
খারাপ স্বাস্থ্য এবং অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে নিয়মিত কাজ চালিয়ে যাওয়া তাঁর পক্ষে প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। তাঁর সমালোচকরা বলে থাকেন ঋত্বিক সিনেমার নেশায় কি পড়বে? বাংলা মদ আর বিড়ির ধোঁয়ার নেশায়ই তো বুঁদ হয়ে আছে। সমালোচকরা সব যুগেই থাকে এবং তারা সমালোচনাও করবে এটাই স্বাভাবিক। তবে তাঁর শুধু সমালোচকই ছিলো না অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী ও গুণমুগ্ধ মানুষ ও ছিল। বাংলার অপর কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিৎ রায়কেও বলতে শোনা যায় ঋত্বিকের ভিতর সত্যিকারের শিল্পীর যন্ত্রণা ছিলো এবং তিনি আসলেই অনেক বড় মানের নির্মাতা।
শিল্পী হিসেবে সার্থক ঋত্বিক ঘটকের মহত্য শুধু চলচ্চিত্রেই সীমাবদ্ধ থাকে নি। মানবতার প্রতি ছিল তাঁর অসীম ভালোবাসা। তিনি সবসময় স্বপ্ন দেখতেন ও দেখাতেন এমন এক সমাজ ব্যবস্থার যেখানে শোষক ও শোষিত সম্পর্ক থাকবে না, শ্রেণী বিভাজন থাকবে না, সাম্প্রদায়িকতা, কাড়াকাড়ি, সাংস্কৃতিহীনতা থাকবে না। তাইতো মানবতার টানে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তাকে কলকাতার রাস্তায় রাস্তায় বাংলাদেশি শরণার্থীদের জন্য ত্রাণকার্যে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করতে দেখা যায়। ১৯৭৪ সালে তাঁর শেষ চলচ্চিত্র যুক্তি তক্কো আর গপ্পো ছিলো তাঁর অন্যান্য চলচ্চিত্র থেকে ভিন্ন ধাঁচের এবং অনেকটা আত্মজীবনীমূলক ছবিটিতে তিনি নিজের রাজনৈতিক মতবাদকে দ্বিধাহীনভাবে প্রকাশ করেছেন।
কাহিনীর ছলে তিনি নিজের কথা বলে গেছেন এ ছবিতে। চলচ্চিত্রে অসামান্য অবদানের জন্য ১৯৬৯ সালে ভারত সরকার তাঁকে পদ্মশ্রী উপাধিতে ভূষিত করেন। ১৯৭৫ সালে যুক্তি তক্কো আর গপ্পো চলচ্চিত্রের শ্রেষ্ঠ কাহিনীর জন্য ভারতের জাতীয় পুরস্কার লাভ করেন।
ঋত্বিক ঘটক যুগ সচেতন চলচ্চিত্রকার, গল্পকার, নাট্যকার এবং অভিনেতাসহ দৃশ্যশিল্পের প্রায় সব রূপেই ছিলেন এক মহামানব। তবে এটাও ঠিক যে ঋত্বিক যে মানের নির্মাতা ছিল তাঁর যোগ্য সন্মান সে সময় তিনি পায়নি।
তাঁর সময়ের অনেক কুখ্যাত নির্মাতাও তাঁর থেকে বেশি পদক পেয়ছে। কিন্তু ঋত্বিকরা যুগে যুগে একবারই জন্মায় এবং তাঁরা পদক পাবার জন্য কাজ করে না, তাঁরা নিজের মনের তাগিদে, সমাজের তাগিদে কাজ করে যায় এবং কাজের মাধ্যমেই তাঁরা নিজেদের প্রমান করে যায়। আর তাই তো আজ চলচ্চিত্র জগৎ-এর প্রতিটি মানুষের কাছে তাঁর ছবি শিক্ষার এক অবিচ্ছেদ মাধ্যম হয়ে থেকে গিয়েছে। প্রয়াত এ চিত্র পরিচালকের জীবন নিয়ে ছবি বানাতে যাচ্ছেন পরিচালক কমলেশ্বর মুখোপাধ্যায়।
যুক্তি তক্কো আর গপ্পো মুক্তির পর অনেক দিন তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন মানসিক হাসপাতালে।
এরপর ১৯৭৬-এর ৬ই ফেব্রুয়ারি মাত্র ৫০ বছর বয়সে চলচ্চিত্রের এই মহামানব পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় পরলোকগমন করেন। ইহজগৎ থেকে তিনি ছুটি নিলেও, তাঁর সৃষ্টি ছবিগুলো আজও চলচ্চিত্র জগতের সম্পদ। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের আজ ৩৮তম মৃত্যুদিন। বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি চলচ্চিত্র পরিচালক ঋত্বিক ঘটকের ৩৮তম মৃত্যুদিনে শ্রদ্ধাঞ্জলি
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।