আসলে সব মানুষই বন্দী থাকে এক আকাশ সীমানায়
মাত্র দু’বছর আগেও এদেশের তরুণ প্রজন্মেরর একজন কবি লিটল ম্যাগ কিংবা দৈনিকে তার কবিতা ছাপা হবে কিনা এই চিন্তা নিয়ে ঘুমাতে যেতেন। এবং মোটামুটি একটা স্বপ্নমিশেল কাব্যবন্দী ঘুম হতো। এদেশের তরুণ প্রজম্ন এখনও ঘুমাতে যান। তবে আবহটা একটু ভিন্ন। এখন তাদের চোখের স্বপ্ন রূপালী, এখন তাদের ফ্রেমবন্দী ঘুম।
দেশে একটি নিরব বিপ্লব ঘটে গেছে। সেলুলয়েড বিপ্লব।
যিনি গান লিখছেন, যিনি সুর দিচ্ছেন, যিনি গাচ্ছেন। যারা অল্প লিখতে জানেন, যারা মোটামুটি লিখতে জানেন, যারা বিস্তর লিখতে জানেন। যিনি ক্যামেরা করেন, যিনি আলো দেন, যিনি শব্দ নিয়ন্ত্রন করেন।
যারা আইডিয়াবাজ, যারা আড্ডাবাজ, যারা স্বপ্নবিলাসি পাঠক। যিনি চিত্রশিল্পী, যিনি চলচ্চিত্র সংসদকর্মী, যিনি নাট্য নির্মাতা। কে পুরস্কার পাওয়ার মত একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের কথা ভাবছেন না?
অনেকেই ইতিমধ্যে কাজে ঝাঁপিয়ে পরেছেন। ছোট ছোট চলচ্চিত্র বানিয়েছেন (ডিজিটাল ফিল্ম বিপ্লবের ক্ষুদ্র রূপ)। বাংলাদেশ শর্ট ফিল্ম ফোরামের কল্যানে তা জনসম্মুখে প্রদর্শীতও হচ্ছে দু’বছরে একবার।
এদের কেউ আবার Ôশুরুর খানিক, মৃনাল-মানিক, অন্তে সুভাষ ঘাই'। অর্থাr বুকে মূলধারার চলচ্চিত্র ধারণ করে অর্থাভাবে আপাতত নাটক বা প্রামাণ্যচিত্র বানাচ্ছেন। অনেকে কবে সিনেমা বানাবার সুযোগ আসবে সেই আশায় না থেকে নাটক বানানোয় হাত দিয়েছেন। ফলে ভাল সিনেমা হতে পারত এরকম অনেক গল্পই নাটকে রুপান্তরিত হচ্ছে। এদের বাস্তবতা জানা আছে আমার।
কতগুলি চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য তৈরী করে রেখেছি, ছুটোছুটি করেছি বিস্তর কিন্তু কাজ হয়নি। তবু স্বপ্ন ছাড়িনি। যারা আপোষ করছেন তাদের দেখলেই আমার সুভাষ মুখপাধ্যায়ের কয়েকটি লাইন মনে পড়ে যায়-
আমার যে সকল বন্ধুরা
একদা পৃথিবী বদলের স্বপ্ন দেখেছিল
খুব ত্বরা সইতে না পেরে এখন
নিজেরাই নিজেদের বদলে নিয়েছে
এইটুকু লেখা পড়ে যে কেউ ভাবতে পারেন আমি বোধ হয় চলচ্চিত্রের এই প্রক্রিয়ায় বেশ হতাশ হয়ে লিখতে বসেছি। তা নয়। এতক্ষণ একজন চলচ্চিত্রপ্রেমীর সাধারণ চোখে সমসাময়ীক অবস্থা যতটুকু দেখা যায় তার একটা সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দেয়ার চেষ্টা করেছি মাত্র।
কিন্তু হতাশ নই। কারণ আমি জানি যে কোন আর্টফর্মকে দাঁড়াতে হলে তার পিছনে প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট থাকতে হয়। বাংলাদেশে এখন সেই এক্সপেরিমেন্ট পর্ব চলছে। ষাটের দশক থেকে এদেশে সাহিত্য ও কবিতার এমনই এক্সপেরিমেন্ট এর ভিত তৈরী করেছে। আমরা পেয়েছি আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, শামসুর রাহমান, নির্মুলেন্দু গুণ, সৈয়দ শামসুল হক, আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ।
বছর দুয়েক আগে আজেবাজে অডিও এ্যালবামে বাজার ছেয়ে গিয়েছিল। এখন গানের সুদিন ফিরে আসায় সেটাকে এক্সপেরিমেন্ট হিসেবে ধরে নেয়া যায়। মোদ্দা কথা হচ্ছে ভাল চলচ্চিত্রের আশায় প্রচুর এক্সপেরিমেন্ট হচ্ছে। এবং দেশে চলচ্চিত্রেরও সুদিন আসছে।
বিভিন্ন চ্যানেল তো ইতিমধ্যেই ছবি নির্মাণে হাত দিয়েছে।
এ চলচ্চিত্রে যে অর্থলগ্নি কম থাকে তা এর শ্রী দেখলেই বোঝা যায়। ছবি তৈরির সর্বোচ্চ মূল্য পঁচিশ লক্ষ টাকা মাত্র যেখানে দেশে বেশ কয়েকটি বিজ্ঞাপনই বানানো হয়েছে কোটি টাকায়। আবার সেই স্বল্প বাজেটের ছবি থেকে বিজ্ঞাপন বাবদ চ্যানেল গুলি যা কামাচ্ছে তার অর্ধেক টাকাও ওই ছবির পিছনে ব্যয় করলে মান বেড়ে যেত দ্বিগুন। এটা যত গুড় তত মিষ্টি প্রক্রিয়া। ছবিতে যত অর্থলগ্নি হবে তার মান তত বেড়ে যাবে।
দেশের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রিতে মাত্র দশ কোটি টাকার ফিল্ম নামুক, নায়িকাদের স্বাস্থ্য তার পরদিন থেকে স্লিম হতে শুরু করবে কিংবা স্লিম মেয়েদের নায়িকা হবার প্রবনতা বেড়ে যাবে।
ভাল চলচ্চিত্রের জন্যে এই সময়ই ইন্ডিপেন্ডেন্ট চলচ্চিত্র নির্মাতাদের ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির ভিতরে প্রবেশ দরকার(সত্যজিr রায় পেরেছিলেন)। কারণ আমি একটা কথা অনেক বেশি বিশ্বাস করি তা হলো Ôসিস্টেমের বাইরে থেকে কখনও সিস্টেম পরিবর্তন করা যায় নাÕ।
আবার এই স্বাতন্ত্র চলচ্চিত্র বা বিকল্পধারার ছবিগুলির বিষয়বস্তুও গড়ে একই ধাচের। গতিহীন দু;খ কষ্টের ছড়াছড়ি, মধ্যবিত্ত টানাপোড়েন নয়ত ঈষr সংক্ষেপিত মুক্তিযুদ্ধ।
একজন কর্মজীবি মানুষ সে যে শ্রেনীরই হোক না কেন দিন শেষে কর্মক্লান্তির পর দাম দিয়ে (টিকিট কেটে) দু;খ কষ্ট দেখতে কেন যাবে? তার জীবনে কি দুঃখ কষ্টের কমতি হচ্ছে?
এর মধ্যে রুপকথার গল্প ছবিটিতে কিছুটা গল্পের ভিন্নতা পাওয়া গেলো আর পাওয়া গেল গতি।
এই বিকল্পধারার ছবি বা ইন্ডিপেন্ডেন্ট ছবিগুলির প্রধান যে সমস্যা তা হলো প্রদর্শনের। দেশে দুÕটি সিনেমা হল ছাড়া অন্য কোথাও এর প্রদর্শনের ব্যবস্থা নেই। এই ছবিগুলি প্রদর্শনের সবচেয়ে ভাল স্থান হল চলচ্চিত্র সংসদ আয়োজিত চলচ্চিত্র উৎসব। দর্শক ও নির্মাতা উভয়ই মুখিয়ে থাকেন এই চলচ্চিত্র উৎসবের জন্য।
দর্শক দেখবেন আর নির্মাতা দেখাবেন। কি সহজ একটা ব্যাপার। কিন্তু সেই সহজ ব্যাপারটা কত কঠিন তা এই ছবিগুলির দর্শক জানেন, নির্মাতাও। সেই কবে একটা উৎসব হবে!
ভাল চলচ্চিত্র প্রচার ও প্রসারের ক্ষেত্রে চলচ্চিত্র সংসদগুলি সবচেয়ে বেশি ভুমিকা পালন করতে পারে। এগুলি যত বেশি কার্যকরী হবে ততই এই স্বাতন্ত্র চলচ্চিত্রের(ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম এখন বিশ্ব জুড়েই সমাদৃত)কদর বেড়ে যাবে।
কারণ বিজ্ঞাপণেরর ভাষায় Ôপ্রচারই প্রসারÕ। এরাই হবে এই ভাল চলচ্চিত্রের প্রচারক। তাই দেশে চলচ্চিত্র সংসদ ষাটটিতে(পরিতাপের বিষয় এর মধ্যে তৎপর ও কার্যকরী মাত্র ৪ থেকে ৫ টি)থেমে থাকলে চলবে না। আরও আরও চলচ্চিত্র সংসদ চাই তবে অবশ্যই কার্যকরী। চলচ্চিত্র সংসদ হলে যে যে লাভ আমাদের এবং চলচ্চিত্রের তা হল-
ক. নিয়মিত এরা সুস্থ্য ও রুচিশীল চলচ্চিত্র প্রদর্শন করবে
খ. চলচ্চিত্রের যে কোন বিপর্যয়ে এরা এগিয়ে আসবে
গ. ভাল চলচ্চিত্র দেখার প্রচুর দর্শক তৈরী করবে(খারাপ চলচ্চিত্র দর্শক হারাবে)
ঘ. সিনেমা হলের বাইরে চলচ্চিত্র প্রদর্শনের বিকিল্প অনেক ভেন্যু তৈরী হবে
ঙ. চর্চার মধ্য থেকে আনেক সম্ভাবনাময় নির্মাতা তৈরী হতে পারে
আর একজন চলচ্চিত্র সংসদকর্মী হলে যা লাভ
ক. সে সিনেমায় টাকা খাটালে ভাল সিনেমায় টাকা খাটাবেন
খ. অভিনেতা হলে ভাল চলচ্চিত্রের ভাল অভিনেতা হবেন
গ. নির্মাতা হলে সুস্থ্য ধারার চলচ্চিত্রের নির্মাতা হবেন
ঘ. ক্যামেরা করলে ভাল ভাল চলচ্চিত্রের ভাল ক্যামেরা করবেন
ঙ. জীবনের ক্যারিয়ারে চলচ্চিত্র না থাকলেও আজীবন ভাল চলচ্চিত্রের পৃষ্ঠপোষকতা ও রস আস্বাদন করে যাবেন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।