ভাবনার বিষয়, চলচ্চিত্রের বিষয়, বা শিল্পে তুলে আনার বিষয় হিসেবে তিনটি বিষয়ের প্রতি তারেক ভাইয়ের বিশেষ দুর্বলতা ছিল। বিষয় তিনটি হল- মুক্তিযুদ্ধ, নারী এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। শুধু তার মুখ থেকে শোনা নয়, তার কাজের দিকে তাকালেও বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে সমান ভাবেই। ‘মুক্তির গান’ থেকে শুরু করে সর্বশেষ নির্মাণ ‘নরসুন্দর’ কিংবা ‘রানওয়ে’সহ প্রতিটি নির্মাণেই এই বিষয়ের যে কোনো একটি, কখনো বা একাধিক বিষয়ের উপস্থিতি দেখা যায়।
অবশ্য বিষয়-ভাবনা হিসেবে প্রতিটি বিষয়ই এতো ব্যাপক এবং বিস্তৃত যে একটি মাত্র ছবিতে তার সামান্যই তুলে আনা সম্ভব।

প্রতিটি বিষয়ই এই ভূখন্ডের সামগ্রিক রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সমাজনীতির সকল অনুসর্গ এবং উপসর্গের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আর একজন সমাজ সচেতন চলচ্চিত্রকারের তখন দায়িত্ব হয়ে পড়ে তাকে যথার্থভাবে শিল্পে তুলে আনার।
তারেক ভাইয়ের কাছে চলচ্চিত্র শুধু চলমান চিত্র ছিল না, চলচ্চিত্র ছিল তার জীবনচর্চার অংশ। চলচ্চিত্র ছিল তার সমাজ ভাবনা, তার রাজনৈতিক বক্তব্য এবং দার্শনিক চিন্তা প্রকাশের মাধ্যম। তাইতো তিনি একের পর এক নির্মাণ করেছেন, করে যাচ্ছিলেন তার সহজাত ভাবনা প্রসূত জীবনের চালচিত্র।

পরিকল্পনা করছিলেন আরও কয়েকটি স্বপ্নসংশ্লিষ্ট ও জীবনঘনিষ্ট যথার্থ নির্মাণের। তার বলার ছিল অনেক কিছু, করার ছিল অনেক কিছু, দেওয়ার ছিল অনেক কিছু, কিন্তু আমরা বঞ্চিত হলাম। অসময়ে তার চলে যাওয়া বঞ্চিত করল এই জাতিকে, বঞ্চিত করল বাংলা চলচ্চিত্রের ইতিহাস সমৃদ্ধ করবার অফুরন্ত সম্ভাবনাকে।  
তার কাছ থেকে, তার কাজ থেকেই আমরা জেনেছিলাম একটি চলচ্চিত্র একটি পশ্চাদমুখী জনগোষ্ঠীর জন্যে কতোটা শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তাকে দেখেই আমরা বুঝেছিলাম চলচ্চিত্রের আসল নায়ক হচ্ছেন চলচ্চিত্র নির্মাতা নিজে।

চলচ্চিত্রের আঙ্গিনায় তার নায়কোচিত আবির্ভাব, নায়কোচিত অবস্থান, অর্জন এবং নায়কোচিত জীবনাচার আমার মতো অনেক তরুণকেই চলচ্চিত্র নির্মাণে আগ্রহী করেছে, উদ্যমী করেছে, সাহস যুগিয়েছে স্বপ্ন দেখবার।   
আমরা হয়তো জীবনযাপন করি, কিন্তু তাকে দেখে মনে হয়েছে তিনি সিনেমাযাপন করতেন। তার কাছে গেলে পাওয়া যেত চলচ্চিত্রসংশ্লিষ্ট সকল সাম্প্রতিকতম তথ্য, সম্ভাব্য সকল প্রশ্নের উত্তর, সকল সমস্যার সমাধান। শুধুমাত্র সিনেমার তাত্ত্বিক বিষয়ে নয়, প্রযুক্তিগত সকল বিষয়েও তিনি ছিলেন সবার চেয়ে অগ্রগামী।  
তাঁর অকাল প্রয়াণে আমরা যে শুধু একজন চলচ্চিত্রনির্মাতাকে হারিয়েছিলাম তাই নয়।

হারিয়েছিলাম ছায়া দেবার মানুষটিও। হারিয়েছিলাম প্রিয় শিক্ষক, প্রিয়তম সুহৃদ। তরুণদের জন্য এতটা আশ্রয় এতটা প্রশ্রয় আর কারও কাছে কখনও ছিল না, এখনও নেই।
তারেক ভাই, ভাবতে ভালো লাগে না আপনি নেই। তবুও আজ দুবছর হয়ে গেলো, আপনি নেই এটাই সত্যি।

আপনি অনেকের স্বপ্নের নায়ক ছিলেন। আপনার স্বপ্নের বীজ ছড়িয়ে পড়েছে আজ লাখো তরুণের প্রাণে। যে স্বপ্নের বীজ আপনি বপন করে গেছেন, তা নিশ্চয়ই একদিন নানা বর্ণের ফুল হয়ে ফুটবে সমাজ ও সংস্কৃতির সকল স্তরে, সকল ধর্মের সকল পার্বণ আর সকল উৎসবে।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সামনে রেখে অসাম্প্রদায়িক সমাজ গঠনে আপনার ভূমিকা ও স্বপ্নকে আরেকবার শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি বাংলা চলচ্চিত্রকে বিশ্বদরবারে এগিয়ে নেওয়ার আপনার সফল প্রচেষ্টা ও প্রত্যয়।

শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি ২০১১ সালের ১৩ অগাস্ট মানিকগঞ্জের সেই সড়ক দুর্ঘটনায় আপনার সঙ্গে হারিয়ে যাওয়া আপনার সকল প্রকল্পের মেধাবী সহযোদ্ধা মিশুক ভাই, মিশুক মুনীরকে। স্মরণ করছি প্রিয় সহযোগী ওয়াসিম ভাই, গাড়িচালক মুস্তাফিজ ও জামালকে। আপনাদের সকলের কাজ ও কাজের মধ্য দিয়ে তৈরি হওয়া অনেক স্মৃতি আমাদের পাথেয় হয়ে আছে, থাকবে।
আপনি বলতেন, “সংস্কৃতির অগ্রযাত্রা হচ্ছে রিলে-রেসের মতো। এক প্রজন্ম আরেক প্রজন্মের কাছে হস্তান্তর করে যায়।

” নতুন প্রজন্ম আপনার চাওয়ার মতো করেই তৈরি হচ্ছে আপনার দেওয়া আলোকবর্তিকাটি এগিয়ে নেওয়ার জন্যে। আমরা জানি, চলচ্চিত্র সংস্কৃতির উত্তরণেই আপনার অসমাপ্ত কাজের পূর্ণতা। আপনার আত্মার প্রশান্তি।  
যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন। আমরা সকলে আপনাদের শান্তি কামনা করি সবসময়।


।