সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলা করা যত সহজ, তাদের প্রতি উপযুক্ত সম্মান দেখানো এবং রাষ্ট্রের অন্যান্য নাগরিকের মত তাদের জন্য সমান অধিকার নিশ্চিত করা অত্যন্ত কঠিন কাজ। একটি রাষ্ট্র যখন সেই কাজটি করতে ব্যর্থ হয়, তখন সেই রাষ্ট্রে ওই সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠী বসবাসের জন্য আর নিরাপদ মনে করে না। তখন তারা ভিনদেশে শরনার্থী জীবন বেছে নেয়াকেই শ্রেয় মনে করে, যুক্তিযুক্ত মনে করে, অনেক বেশি নিরাপদ মনে করে। কিন্তু রাষ্ট্রের এই ব্যর্থতার জন্য আসলে কারা দায়ী? অবশ্যই সেই রাষ্ট্রের যারা শাসকগোষ্ঠী তারা সর্বপ্রথমে দায়ী। আর দায়ী সেই রাষ্ট্রে বসবাসরত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী'র অপরাধবোধ।
রাষ্ট্রের সকল নাগরিকের জন্য সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় শাসকগোষ্ঠীর ব্যর্থতা যখন একটি চরম সীমা অতিক্রম করে, তখন সেই রাষ্ট্রকে সবাই বলে ব্যর্থ রাষ্ট্র। সেই রাষ্ট্রে তখন আইনের কোনো শাসন থাকে না। সেখানে সংখ্যালঘু গোষ্ঠী নিপীড়িত হয়, নির্যাতিত হয়, উচ্ছেদ হয়, তাদের ঘরবাড়ি, বসতভিটা, ব্যবসা-সম্পদ, জমি-বাগান সবকিছু তখন জোরজবরদস্তি করে দখল করে নেয় আইনের চোখে পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া লোলুপ সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর একদল দুবৃত্ত। বাংলাদেশে এই দুবৃত্ত শ্রেণীর উত্থান আমরা বারবার দেখেছি। এই দুবৃত্ত শ্রেণীর উত্থানের পেছনে রাষ্ট্রীয় মদদ যেমন থাকে, তেমনি থাকে জাতি-ধর্ম-গোষ্ঠী-শ্রেণী'র নানান কৌশলী ব্যবহার।
মানবতা সেখানে ঠায় ঠুকরে মরে। দানবতা সেখানে উল্লাসী হুঙ্কার দেয়। রাষ্ট্রের সুনির্দিষ্ট আইনের কাঠামো এই দানবতাকে প্রতিরোধের বিপরীতে ঠুনকো প্রলেপ দিয়ে ঘটনাকে তখন অন্যখাতে প্রবাহিত করার জন্য ভিন্ন কৌশলে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মত ঘটনাও ঘটায়। এই চিরায়ত বাস্তবতা থেকে বাংলাদেশ এখনো সভ্য হতে পারেনি।
বঙ্গভঙ্গ, বঙ্গভঙ্গ-রোধ, দেশভাগ, স্বাধীনতা যুদ্ধ, বিভিন্ন সময়ের সাধারণ নির্বাচনকালীন সময়ে, প্রতিবেশী ভারতে উগ্রবাদীদের আগ্রাসনের সময়ে, প্রতিবেশী মায়ানমারে জাতিগত দাঙ্গা'র সময়ে, ইত্যাদি নানান উছিলায় বাংলাদেশে বিভিন্ন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর বিভিন্ন সময়ে নানান কৌশলে, নানান ফন্দিফিকিরে, নানান আয়োজনে বর্বর হামলা হয়েছে, দাঙ্গা হয়েছে, সংখ্যালঘু নারীদের ধর্ষণ করা হয়েছে, তাদের চৌদ্দ-পুরুষের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করা হয়েছে, ধর্মীয় উগ্রতার ভয়াল থাবায় সংখ্যালঘু বারবার উচ্ছেদ হয়েছে।
সাম্প্রতিক দশম সাধারণ নির্বাচনের আগে ও পরেও এমন ঘটনা বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘটেছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের এই উচ্ছেদকে প্রেক্ষিত করে অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত ও যুগপোযুগী এক গল্প লিখেছেন গল্পকার আনোয়ার শাহাদাত।
দুর্বলের উপর সবলের অত্যাচার যুগে যুগে দেশে দেশে যতভাবে যখন যখন হয়েছে, সেসবের এক নির্ভিক প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে আনোয়ার শাহাদাত-এর গল্প 'নাগরিকের গাছকাটা দা'-তে। এই গল্পের প্রেক্ষাপট বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের একটি ধোপাবাড়িকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠলেও, এই গল্পের সুদূরবিস্তারি পটভূমি আমাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা ছাড়িয়ে বৈশ্বিক সীমানার নানা প্রান্তের নানান জাতিগত বৈষম্যের নির্ভেজাল প্রতিচ্ছবিকেই কেবল স্মরণ করিয়ে দেয়। তখন এই গল্পটি আঞ্চলিকতার উর্ধ্বে উঠে গোটা বিশ্বের নিপীড়িত মানুষের হাহাকারের এক জ্বলন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে ওঠে।
তখন শীলারানী হয়ে ওঠে সেই নির্যাতিত রমনীর প্রতিচ্ছবি। আর আনসার আলী হয়ে যান রাষ্ট্রের অনিয়মের বিরুদ্ধে এক দুঃসাহসী প্রতিবাদী চরিত্র। যার চাল চুলো হয়তো ততটা জোড়ালো নয়, কিন্তু তার হাতের চাঁদবাঁকা গাছ কাঁটা দা হয়ে ওঠে মিসাইলের চেয়েও শক্তিশালী এক চরম অস্ত্র। রাষ্ট্রীয় শক্তির কাছে আনসার আলীদের মত ক্ষীণকন্ঠের প্রতিবাদ যদিও হালে পানি পায় না, তবুও 'নাগরিকের গাছকাটা দা' গল্পে আনসার আলী'র এই রুদ্রমুর্তি পাঠকের পরম দৃষ্টি আকর্ষণ করে। আনসার আলী হয়ে ওঠেন সময়ের প্রতিবাদী তেজাল কণ্ঠস্বর।
যার ভয়ে প্রবল শক্তিধর বদরু তালুকদার পর্যন্ত শামুকের মত গুটিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যদিও শীলারানীদের সকল সম্পত্তি বদরু তালুকদার লুফে নিতে সক্ষম হন। কিন্তু আনসার আলী'র সঙ্গে লড়াই করার মত সাহস পান না।
আনোয়ার শাহাদাত খুব কম কথা বলে একটি শক্তিশালী গল্প পাঠকের সামনে নানান রূপকের তীর্যক ব্যবহারে হাজির করেন। গল্পকে আরো বিশ্বাসযোগ্য করার জন্য লেখক হয়তো মোতাহার ফকির বা লোকাল লঞ্চের ধূতি পড়ুয়া সুলতান বিড়ি ধরানো অসহায় লোকটাকে হাজির করেন।
কিংম্বা রাষ্ট্রের চূড়ান্ত বিশৃঙ্খলাকে তুলে ধরার জন্য গল্পে কিছু ঘটনার বিস্তার দেখা যায়, কিন্তু পাঠকের অনুসন্ধানী মন পড়ে থাকে দুটি জায়গায়। এক শীলারানী'র পরবর্তী কর্মকাণ্ড কি কি। দুই আনসার আলী বদরু তালুকদারের দামড়া ছেলে নাজিমুদ্দিন বা স্বয়ং তালুকদারের বিরুদ্ধে আর কি কি করল, তা জানার দিকে।
তবু গল্পের বিস্তারে আনোয়ার শাহাদাত অত্যন্ত সচেতন। কলমটি নিজের হাতেই রাখেন লেখক।
বরিশালের আঞ্চলিক ভাষাকে অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে লেখক 'নাগরিকের গাছকাটা দা' গল্পে ব্যবহার করে মুন্সিয়ানার ছাপ রেখেছেন। আঞ্চলিক শ্লাংয়ের ব্যবহারে গল্পটি আরো চরিত্রঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে। কিন্তু দৃশ্য বর্ণনায় এবং বাক্য গঠনে লেখকের আরো বেশি যত্নবান হবার দাবী রাখে। বাক্যে রূপকের ব্যবহারের পাশাপাশি ব্যঞ্জনা ও তুলনার মিশ্রনে যদিও সেটি কাটিয়ে ওঠার একটা চেষ্টা প্রতীয়মান। তবু এই গল্পে রাতের কোনো দৃশ্য নেই।
যা ঘটে, দিনের আলোতে লোকচক্ষুর সামনেই সবকিছু ঘটে। শীলারানীদের দৌড় যেমন থামে না, পাঠকের চিন্তার জায়গাটি তেমনি বেশ কৌশলের সঙ্গেই লেখক গল্পে রেখে দেন। কিন্তু আনসার আলী'র গাছ কাঁটা দা'র সক্রিয় হয়ে ওঠার আগ পর্যন্ত হয়তো পাঠক এই গল্পকে ভাবতে চাইবেন। এখানেই লেখকের স্বার্থকতা।
আনোয়ার শাহাদাত মৃদ্যু ভাষী।
এটি গল্পের একটি শক্তিশালী দিক। দেশ-কাল-স্থান-পাত্রপাত্রী সবকিছু মিলে তাই 'নাগরিকের গাছকাটা দা' গল্পটি পাঠকের অন্তরে অনুরণন জাগায়।
বদরু তালুকদারের রক্তচক্ষুকে প্রতিবাদী আনসার আলী যেমন তোয়াক্কা করেন না, তেমনি গল্পের কাঠামো যতই বঙ্কিম হোক না কেন, যতোক্ষণ রাঙা বালির খিঁজখিঁজ শব্দ তুলে আনসার আলী চাঁদবাঁকা গাছ কাঁটা দা-তে ধার দেন, ততক্ষণ পাঠকের আকুলতা বরং প্রবল থেকে প্রবলতর হয়। মানবতার জয়গান করার জন্য তখন বিশ্বস্ত ভরসার প্রতীক হয়ে ওঠে চাঁদবাঁকা গাছকাঁটা দা। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।