জাহাঙ্গীর আলম আকাশ :
গত ১৩ ডিসেম্বর, ২০০৮ তারিখে যখন রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসি তখনই সিদ্ধান্ত নিয়েছি সিমির পরিবারের সদস্যদের সাথে দেখার করার। দৈনিক প্রথম আলো এর সিনিয়র রিপোর্টার প্রখ্যাত টিপু সুলতান এর কাছ থেকে সিমির বাড়ির ঠিকানাটা সংগ্রহ করি।
বন্ধু উইলিয়াম গোমেজ ও বিখ্যাত কার্টুনিষ্ট আরিফুর রহমানকে সাথে নিয়ে ২৪ ডিসেম্বর, ২০০৮ বিকেলে বসুন্ধরা সিটিতে আড্ডা দিচ্ছিলাম। আড্ডা শেষে চা পান করার পর উইলিয়াম চলে গেলেন তার নিজ বাসায়। কারণ বড়দিনের অনুষ্ঠানে যোগদান করা।
এরপর আমি ও আরিফ পায়ে হেঁটে রওনা হলাম ইষ্টার্ণ প্লাজার দিকে। উদ্দেশ্য হাইকোর্টে আমার মামলা পরিচালনাকারী আইনজীবী মোহাম্মদ হোসেন এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে রাজশাহী ও ঢাকায় চলাম মামলার বিষয়ে পরামর্শ করা।
কিন্তু ইষ্টার্ণ প্লাজায় গিয়ে দেখি আইনজীবী মহোদয় নেই। উনার সঙ্গে মোবাইলে কথা সেরে নিলাম। পুনরায় পদব্রজে পান্থপথে ফিরে এলাম।
সেখানে দিবানিশি বাস সার্ভিসের দু’টি টিকিট কাটলাম। টিকিট কাটার পর বাসের জন্য অপো করতে হলো প্রায় ৪০ মিনিট। বাস এলো কিন্তু কোন সিট নেই। অগত্যা ঠাসাঠাসির মধ্যেই উঠলাম আমরা। মালিবাগ রেলক্রসিং মোড়ে নেমে তুরাগ বাসে উঠে খিলগাঁও ওভার ব্রীজের গোড়ায় নামি।
এরপর রিকশার জন্য অপো। দীর্ঘ প্রায় ১০ মিনিট পর রিকশা পাওয়া গেল। একজন বয়স্ক রিকশাচালক রাজি হলেন। ২৫ টাকার ভাড়া মিটিয়ে রওনা হলাম মেরাদিয়া ভূঁইয়াপাড়ার উদ্দেশে। এক সময় রিকশা থেমে গেল, রিকশাচালক বললেন আর যাওয়া যাবে না।
অনেক অনুরোধ করেও তাকে নেয় গেল না। অবশ্য আর না এগাবার যথেষ্ট কারণও আছে। কারণ হলো রাস্তাটি চলাচলের একেবারেই অনুপযুক্ত। রাস্তার বিভিন্ন স্থানে খানা-খন্দক, হাঁটু পানি ও কাদায় ভরপুর। এটি ঢাকা সিটি করপোরেশনের ২৬ নম্বর ওয়ার্ডের অধীন এলাকা।
শ্রদ্ধেয় টিপু সুলতন যে ঠিকানা দিয়েছিলেন সেই ঠিকানাটা ছিল সামান্য ভুল। ফলে প্রথম দিকে আমাদের বেশ বেগ পেতে হলো সিমির বাসা খুঁজে পেতে। মেরাদিয়া ভূঁইয়াপাড়া মসজিদের কাছে একদল তরুণ ব্যাডমিন্টন খেলছিলেন, তাদেরকে জিজ্ঞেস করতেই তারা বললেন, সিমির বাড়ি এদিকে নয় ওদিকে। এরপর দুইজন তরুণী আমাদেরকে সিমির বাসার কাছাকাছি নিয়ে গেলেন। অবশেষে বাসা এলা আমাদের দৃষ্টিতে।
অর্ধনির্মিত বাসার তিনতলা এখনও সম্পূর্ণ হয়নি। বাড়ির চারিদিকে ফাঁকা, কোন বাউন্ডারী ওয়াল নেই। আমরা যখন সিমির বাসার গেটে কলিংবেল বাজালাম, ঠিক তখনই সিমিদের বাসার নিচতলার ভাড়াটেও বাড়ির ভেতরে ঢুকছিলেন। তখন রাত পৌনে ৯টা।
কলিংবেলের শব্দ পেয়ে সিমির ভাই শামীম বেরিয়ে এলেন।
তিনি কলাপসিবল গেটের তালা খুলে আমাদের নিয়ে গেলেন দোতালায়। সিমির মা জরিনা বেগম আমাদের বসতে দিলেন ড্রয়িং রুমে। ড্রয়িং রুমের শোকেজের ওপর সুন্দর করে সাজানো হাস্যোজ্জল সিমির ছবি। একটু পরেই এলেন সিমির বাবা ব্যবসায়ী আলী ইমদাদ। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
অস্ত্রহাতে দেশ মাতৃকার জন্য লড়াই করেছিলেন পাক সেনা ও এদেশীয় দোসর রাজাকার-আল বদরদের বিরুদ্ধে। অথচ সেই বীর যোদ্ধা পরিবারটির আজ কি অবস্থা। সিমিদের গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের নাগরপুরে। ১৪ বছর আগে সিমিরা ঢাকার খিলগাঁও ভূঁইয়াপাড়া নবীন বাগের বর্তমান বাসায় আসেন। তিনি ােভ আর অভিমানের সুরে বললেন, দেশটা দুর্নীতি, ঘুস, লুটপাটকারীদের হাতে চলে গেছে।
এই অবস্থার জন্যতো আমরা যুদ্ধ করিনি। কি পেলাম, কি দেখছি আজকের বাংলাদেশে।
সিমির আত্মহননে প্ররোচনা দেয়ার মামলা মামলা এবং সিমির পরিবারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আলোচনায় আসা যাক। নারায়ণগঞ্জ চালুকলা ইনষ্টিটিউটের ছাত্রী সিমি বানু সিমি। ২০০১ সালের ১ অক্টোবরের নির্বাচনের পর সরকার গঠন করে বিএনপি-জামায়াত জোট।
জোট সরকার মতা নেয়ার পর পরই দেশজুড়ে শুরু হয় ধর্মীয় সংখ্যালঘু-আদিবাসী ও আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ওপর আক্রমণ, লুটপাট, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ আর নারী লাঞ্ছনা। ২০০১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সমর্থক ক্যাডারদের উৎপীড়নের হাত থেকে নিজেকে এবং পরিবারকে বাঁচাতে আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছিলেন সীমা বানু সিমি। সিমির আত্মহত্যার পর পুলিশ পুরো ঘটনাটি ধামাচাপা দিতেই তৎপর ছিল। আর তাই সিমির বাবার সই ছাড়াই তার নাম ব্যবহার করে খিলগাঁও থানায় দায়ের করা হয় অপমৃত্যু মামলা। সিমির আত্মহত্যার ঘটনায় দুর্বৃত্তদের বিচারের দাবিতে দেশজুড়ে শুরু হয় আন্দোলন।
এই অবস্থায় জোট সরকারের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বাধ্য হয়ে পুলিশের প্রতি নির্দেশ দেন আত্মহত্যার প্ররোচনা দেয়ার অভিযোগে মামলা নেয়ার জন্য। পুলিশের করা মামলার ত্রুটির কারণে পরবর্তীতে বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সহায়তায় সিমির বাবা একটি পিটিশন মামলা করেন।
খিলগাঁও থানা পুলিশের দায়ের করা আত্মহনন প্ররোচনা মামলা ও পিটিশন মামলার সমন্বয়ে পুলিশ তদন্ত শেষে চার্জশিট দাখিল করে। ওই মামলার রায়ে আসামিরা খালাস পেয়ে যায়। তবে ঢাকা মহানগর পুলিশ আইনের (ডিএমপি আইন) অধীনে তাদের ৬ জনের মধ্যে এক আসামি খালাস ও অন্য ৫ আসামির এক বছর করে কারাদন্ড এবং এক হাজার টাকা করে জরিমানা করে আদালত।
এই আদেশের বিরুদ্ধে সিমির বাবা আপিল করেন জজ আদালতে। আসামিপও সাজা মওকুফের জন্য পৃথক দু'টি আপিল করে। সিমির বাবা পিটিশন মামলার বাদি হলেও আসামিপ মামলাটিকে পুলিশ বাদি মামলা তাই সিমির বাবা আপিল করতে পারে না উল্লেখ করে আপিল করে হাইকোর্টে। তবে হাইকোর্ট আসামিপরে আপিল গ্রহণ করেনি। এরই প্রেক্ষিতে আসামিরা আপিল করে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে।
আপিল আবেদনের ওপর এখনও শুনানি অনুষ্ঠিত হয়নি। বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আদেশে নিম্ন আদালতে সিমির বাবার করা আপিল স্থগিত থাকায় ওই আদালতে আপিল তিনটির শুনানি হচ্ছে না বলে সংশ্লিষ্ট আইনজীবী জানান। সাজা পাওয়া আসামিরা জামিনে মুক্ত হয়ে সিমির পরিবারকে নানাভাবে হুমকি দিচ্ছে। সামাজিকভাবে অবরুদ্ধ করে রেখেছে সিমির পরিবারকে।
এই অবস্থায়ও সিমির পরিবারের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন, হামলা-হুমকি বন্ধ হয়নি।
দুবত্তৃত্ত দল সিমির বাড়ির জানালার কাঁচ ভাংচুর, ঘরে অগ্নিসংযোগ করা, পোষা কুকুরকে মেরে ফেলার ঘটনা ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই সিমিদের বাড়িতে টেলিফোন করে নানারকম ভয়-ভীতি ও হুমকি দেয়াইদচ্ছে। শুধু তাই নয়, বখাটে সন্ত্রাসী বাহিনী সিমির বড়বোনকেও উত্যক্ত করছে। তারা সিমির বড়বোনকে রাস্তায় আটকিয়ে অপমান-অপদস্ত করেছে। আসামিরা মামলা তুলে নেয়ার জন্য হুমকি দিচ্ছে সিমির বাবাকে। নইলে প্রাণে মেরে ফেলারও হুমকি দিচ্ছে দুর্বৃত্ত বাহিনী।
সন্ত্রাসী দল সিমির বাবা-মার ওপরও আক্রমণ করে মারধোর করেছে। এসব ঘটনায় সিমির পরিবারের প থেকে আরও দু’টি মামলা করা হয়। সিমির পরিবারের বিরুদ্ধে আসামিপও হয়রানিমূলক একটি পাল্টা মামলা করেছে। সিমিরা যে বাসায় বসবাস করছেন সেখানকার প্রতিবেশীদেরকেও ক্ষেপিয়ে তোলা গয়েছে সিমির পরিবারের ওপর।
ঢাকায় সিমির পরিবার চতুর্মুখী নিপীড়নের মুখে।
সন্ত্রাসী-বখাটে চক্রের হাতে পরিবারটি কার্যত: অবরুদ্ধ। চরম নিরাপত্তাহীনতার মধ্যে প্রতিটি মুহুর্ত কাটছে নিরাপত্তাহীনতা আর আতংকের মধ্যে। দুর্বৃত্তরা কখন কি ঘটায় তা নিয়ে শংকিত সিমির পরিবারের সদস্যরা। সিমির মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী সেই সন্ত্রাসীদের অব্যাহত হুমকি ও মানসিক নির্যাতনের শিকার সিমির পরিবারের সদস্যরা। #
Jahangir Alam Akash
http://www.humanrightstody.info
+৮৮০১৭২০০৮৪৯৪৪
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।