ভারত ও পশ্চিমের ষড়যন্ত্রকারীদের বিরুদ্ধে জিহাদের ডাক দিয়েছে আন্তর্জাতিক ধর্মীয় জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদা। সংগঠনটির বর্তমান প্রধান আইমান আল-জাওয়াহিরির নাম ও ছবিসহ এমনই একটি অডিও বার্তা প্রচারিত হচ্ছে ইন্টারনেটে। 'বাংলাদেশ : ম্যাসাকার বিহাইন্ড এ ওয়াল অব সাইলেন্স' শিরোনামে ২৮ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের দুটি অডিও বার্তার প্রথম সোয়া দুই মিনিট গত বছর ৫ মে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং ওই দিন রাতে তাদের তুলে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কিছু আলোকচিত্র দেখানো হয়েছে। অডিও বার্তায় বাংলাদেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলে 'ইসলামবিরোধী ষড়যন্ত্রের' বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। ইন্টারনেটে প্রচারিত হওয়া ওই অডিও বার্তাটি নিয়ে ইতিমধ্যে দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
অডিও বার্তার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে এলিট ফোর্স র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহ্সান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, 'আল-কায়েদার নাম করে ইন্টারনেটে জাওয়াহিরির ওই অডিও বার্তাটি আমরা গুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখছি। শরিয়াভিত্তিক রাষ্ট্র পরিচালনার বিষয়টি হেফাজতে ইসলাম আগে থেকেই দাবি করে আসছিল। সব জঙ্গিবাদ একই সূত্রে গাঁথা। জঙ্গিরা শুরু থেকেই শরিয়া আইন প্রতিষ্ঠার বিষয়ে বলে আসছে। '
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) যুগ্ম-কমিশনার মনিরুল ইসলাম জানান, 'এক মাস আগেই বিষয়টি আমাদের গোচরীভূত হয়েছে।
এরই মধ্যে আমরা তিনজন পাকিস্তানি জঙ্গিকে গ্রেফতার করেছি। তবে অডিও বার্তাটি প্রকৃতপক্ষেই আল-জাওয়াহিরির কি না, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। আবার একই সঙ্গে এ ঘটনায় দেশীয় কিছু জঙ্গি সংগঠনকেও রাখা হচ্ছে সন্দেহের তালিকায়। '
অডিও বার্তাটি ঘেঁটে দেখা গেছে, গত বছরের হেফাজতি কাণ্ডের সূত্র ধরে এ বার্তায় রাজপথে হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করার অভিযোগ আনা হয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। আর বাংলাদেশ সরকারকে উল্লেখ করা হয়েছে 'ইসলামবিরোধী, ধর্মনিরপেক্ষ সরকার'।
অডিও বার্তায় জাওয়াহিরির পরিচয় দেওয়া ব্যক্তিটি বলেন, 'বাংলাদেশের মুসলিম ভাইয়েরা, ইসলামের বিরুদ্ধে যারা ক্রুসেড ঘোষণা করেছে, তাদের প্রতিরোধ করার জন্য আমি আপনাদের আহ্বান জানাচ্ছি। উপমহাদেশ ও পশ্চিমের শীর্ষ ক্রিমিনালরা ইসলামের বিরুদ্ধে, ইসলামের নবীর বিরুদ্ধে এই ষড়যন্ত্র করছে, মুসলিম উম্মাহ্র বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে, যাতে আপনাদের তারা অবিশ্বাসীদের দাসে পরিণত করতে পারে। '
জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলামসহ উগ্র ইসলামী দলগুলোও বিভিন্ন সময় বাংলাদেশ সরকার ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার আহ্বান জানিয়েছে।
বার্তায় জাওয়াহিরির পরিচয় দেওয়া ওই ব্যক্তিকে আরবিতে বলতে শোনা যায়, পাশাপাশি ইংরেজি সাবটাইটেলে দেখা যায় এর তরজমা। বাংলাদেশকে 'বিরাট এক জেলখানা' হিসেবে তুলে ধরে এ বার্তায় বলা হয়, এ দেশে মুসলমানদের সম্মান আজ ভূলুণ্ঠিত।
২৮ মিনিট ৫৮ সেকেন্ডের ওই ক্লিপের প্রথম সোয়া দুই মিনিট গত বছর মে মাসে মতিঝিলে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ এবং তাদের তুলে দিতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানের কিছু আলোকচিত্র দেখানো হয়েছে। এরপর শুরু হয়েছে জাওয়াহিরির বক্তব্য।
বার্তায় বলা হয়, 'মুসলমানদের ওপর একটি নৃশংস হত্যাযজ্ঞ শুরু হয়েছে। পশ্চিমা গণমাধ্যমগুলো হত্যাকারীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে সত্য গোপন করছে। আর এই রক্ত ঝরছে বাংলাদেশে।
'
বার্তার একটি অংশে উল্লেখ করা হয়, ''বাংলাদেশ আজ এমন এক ষড়যন্ত্রের শিকার, যাতে ভারতীয় এজেন্ট, পাকিস্তানের দুর্নীতিগ্রস্ত সেনা নেতৃত্ব এবং বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের ক্ষমতালোভী, বিশ্বাসঘাতক রাজনীতিবিদরাও জড়িত। আর উপমহাদেশের, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের 'মুসলিম উম্মাহ্' এই ষড়যন্ত্রের 'মূল শিকার'। ''
'বাংলাদেশে ইসলামের মৌল বিশ্বাস ও রসুল (স.)-এর বিরুদ্ধে আজ যে অপরাধ ঘটানো হচ্ছে, তার বীজ বপন করেছে সেই ক্রিমিনালরাই। পাকিস্তান থেকে স্বাধীন হওয়া তাদের উদ্দেশ্য ছিল না। বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে আগ্রাসন ঠেকানো বা পাকিস্তানি সামরিক শাসন থেকে মুক্তি- কোনোটাই এর মূল লক্ষ্য ছিল না।
আসল লক্ষ্য ছিল এই উপমহাদেশে মুসলিম উম্মাহ্র ভিত্তি দুর্বল করা, মুসলমানদের বিশ্বাসকে ছিন্নভিন্ন করা, আঞ্চলিক বিভেদ আর যুদ্ধের মধ্য দিয়ে এর মৃত্যু ডেকে আনা। '
বার্তায় বলা হয়, পাকিস্তান, বাংলাদেশ, ভারত ও আফগানিস্তানে আজ যা হচ্ছে, তা সেই 'শয়তানি পরিকল্পনা' বাস্তবায়নেরই প্রাথমিক পর্যায়।
জাওয়াহিরি পরিচয়দানকারী ওই ব্যক্তি বলেন, 'কাল যারা বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ চালাল, আজ তারাই পকিস্তানে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। একইভাবে বাঙালির সম্মান রক্ষার ধুয়া তুলে যারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের সঙ্গে জোট বেঁধেছিল, তারাই আজ বাঙালির বিশ্বাস, সম্মান, জীবন ও সম্পদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। '
জাওয়াহিরি বলেন, 'তারা দাবি করে, ইসলাম ও এই উপমহাদেশের মুসলমানদের রক্ষায় ৬০ বছরের বেশি সময় আগে তারা পাকিস্তান সৃষ্টি করেছিল।
আর আজ আমরা যে পাকিস্তান দেখি, সেখানে শরিয়ার কোনো স্থান নেই।
একইভাবে তারা দাবি করে, ৪০ বছর আগে তারা বাংলাদেশ সৃষ্টি করেছিল স্বাধীনতা ও জনগণের মুক্তির জন্য। কিন্তু আমরা দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশ আজ পরিণত হয়েছে বিরাট এক কারাগারে, যেখানে মুসলমানদের সম্মান ও পবিত্র স্থান অপবিত্র করা হচ্ছে। ক্রুসেডার কসাইদের হয়ে তাদের ওপর চালানো হচ্ছে হত্যা-নির্যাতন। '
জাওয়াহিরি, যিনি একাধিকবার বাংলাদেশে এসেছেন বলে ধারণা করা হয়, এ বার্তায় ইসলামের 'সত্যিকারের নেতাদের' জড়ো হয়ে তাদের সমর্থন ও সুরক্ষা দেওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের প্রতি আহ্বান জানান।
সতর্ক থাকবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : আল-কায়েদা নেতার বার্তা ইন্টারনেটে প্রচারিত হওয়ার 'ঘটনা'র দিকে দৃষ্টি রাখবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর বাস্তব পরিপ্রেক্ষিত বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনীয় পর্যালোচনা করা হবে। তবে এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কোনো আনুষ্ঠানিক বক্তব্য বা প্রতিক্রিয়া নেই। মন্ত্রণালয়ের এক পদস্থ কূটনীতিক এ প্রতিবেদকের সঙ্গে নিজেদের এ অবস্থানের কথা জানিয়েছেন। বিবৃতি না থাকা বিষয়ে আল-কায়েদা কোনো স্বীকৃত গোষ্ঠী বা রাষ্ট্র নয় এমন কথা উল্লেখ করে ওই পররাষ্ট্র কর্মকর্তা বলেন, তবে নিজেদের মধ্যে সতর্ক থাকা হবে।
বার্তার আগের-পরের ঘটনাপ্রবাহ পর্যবেক্ষণে রাখা হবে।
হেফাজতের বিবৃতি : নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম জানায়, আল-কায়েদা নেতা আইমান আল-জাওয়াহিরীর নামে প্রচারিত অডিও বার্তার সঙ্গে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের কোনো সম্পর্ক নেই। গতকাল রাতে হেফাজতে ইসলামের আমির আল্লামা আহমদ শফী এবং মহাসচিব আল্লামা মুহাম্মদ জুনায়েদ বাবুনগরীর পাঠানো যৌথ বিবৃতিতে এ দাবি করা হয়। বিবৃতিতে তারা বলেন, 'আইমান আল-জাওয়াহিরী আল-কায়েদার নেতা। আল-কায়েদা সংগঠনটি সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সৃষ্টি।
কারা কোন উদ্দেশ্যে এ অডিও বার্তা প্রচার করেছে আমাদের জানা নেই। আমাদের সন্দেহ, দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বসহ এ দেশের মুসলমানদের বিরুদ্ধে এটা নতুন আরেক ষড়যন্ত্র হতে পারে এ অডিও বার্তা। ' হেফাজতের পক্ষ থেকে পাঠানো বিবৃতির সত্যতা নিশ্চিত করে হেফাজত আমিরের প্রেসসচিব মাওলানা মুনির আহমদ বলেন, 'আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরীর নামে প্রচারিত অডিও বার্তার সঙ্গে হেফাজতের কোনো সম্পর্ক নেই। এ অডিও বার্তা নিয়ে দেশের মানুষের কাছে হেফাজতের অবস্থান নিশ্চিত করতে এ বিবৃতি পাঠানো হয়েছে। '
বিবৃতিতে হেফাজতের এ দুই শীর্ষ নেতা বলেন, 'দীর্ঘদিন থেকেই একটি চক্র শিক্ষা, সংস্কৃতিসহ ইসলাম ও মুসলিম স্বার্থের উপর একের পর এক আঘাত হেনে চলেছে।
পাশাপাশি সংখ্যালঘুদের সঙ্গে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের শান্তিপূর্ণ সামাজিক সহবস্থানকে বিনষ্ট ও বিশৃঙ্খল করার জন্য একের পর এক ষড়যন্ত্র করে যাচ্ছে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারীদের যোগসাজশে কথিত জঙ্গীবাদের জড়ানোর মত চরম মিথ্যাচার চালিয়ে এদেশে আফগানিস্তান ও ইরাকের মতো পরিস্থিতি তৈরি করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চেষ্টা চালাচ্ছে। ' বিবৃতিতে তারা বলেন, 'হেফাজতে ইসলাম এ দেশের তৌহিদী জনতাকে সঙ্গে নিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ১৩ দফা আদায় আন্দোলন করে যাচ্ছে। শাপলা চত্বরের ট্রাজেডিসহ নানা জুলুম-অত্যাচার, হামলা-মামলা, গ্রেফতারের সত্ত্বেও হেফাজতে ইসলাম কোনোরূপ বিশৃঙ্খলা বা ভাঙচুরের সঙ্গে না জড়িয়ে চরম ধৈর্য্যের পরিচয় দিয়ে যাচ্ছে। ' বিবৃতিতে হেফাজত নেতারা বলেন, বিভিন্ন সময় সন্ত্রাস ও কথিত জঙ্গিবাদের সঙ্গে কওমি মাদ্রাসা ও আলেম সমাজকে জড়িয়ে নানা মিথ্যাচার ও প্রোপাগান্ডা চালিয়ে এদেশ থেকে ইসলামী শিক্ষা ও মুসলিম চেতনাবোধ ধ্বংস করে দিতে তৎপরতা চালান হচ্ছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।