ুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুুু ঠিক গল্প নয়-তবে অনেকটা গল্পের মতোই। অন্য কারো মুখে শুনলে হয়তো আমি বিশ্বাসই করতাম না। কিন্তু রাসুর মুখে শুনে বিশ্বাস না করে পারলাম না।
রাসুর সাথে আমার পরিচয় ইউনিভার্সিটির সেকেন্ড ইয়ারে। ও পড়তো মার্কেটিং ডিপার্টমেন্টে আর আমি আন্তর্জাতিক সম্পর্কে।
একই হলে থাকতাম আমরা। রাসুর একটা বদভ্যাস ছিল হলের মামার দোকানে নাস্তা খাওয়ার সময় মুখের সামনে একটা বই ধরে রাখত। বাংলা সাহিত্যের সব প্রখ্যাত লেখকদের বই সে পড়ে শেষ করেছিল হলে থাকতেই। আমারও তখন বই পড়ার নেশা। তবে রাসুর সাথে আমার তফাত ছিল ও পড়ত প্রখ্যাত লেখকদের সাহিত্যকর্ম আর আমি পড়তাম বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ধারার বইগুলো।
মাঝে মাঝে রাসুর কাছ থেকে কিছু প্রখ্যাত লেখকদের বই এনে পড়ার চেষ্টা করতাম। রাসু কদাচিত আমার কাছ থেকে দু-একটা বই নিয়ে পড়ত। ওর সাহিত্যরূচি আমার চেয়ে উন্নত ছিল এটা আমি স্বীকার করি। বই লেনদেনের বাইরেও রাসুর সাথে আমার একটা সম্পর্ক ছিলো। ও ছিলো আমার নিশিযাত্রার সঙ্গী।
নিশিযাত্রা কথাটি এই জন্য বললাম আমরা দুজনই রাতের বেলা হাটতাম। দুইজন দুই ডিপার্টমেন্টে পড়তাম। তাই দিনের বেলা খুব বেশি দেখা হত না দুজনের। তবে রাতে খাওয়া দাওয়ার পর প্রায় প্রতিদিনই আমরা হাটতে বেরুতাম। আমাদের হল এবং ক্যাম্পাসে হাটাহাটির জায়গার কোন অভাব ছিল না।
মলচত্বর হয়ে ফুলার রোড, পলাশী, বুয়েট ক্যাম্পাস ঘুরে শহীদ মিনার এলাকায় চলে আসতাম আমরা। কখনো কখনো টিএসসি বা হাকিম চত্বরে দাঁড়িয়ে চা খেতাম। মাঝে মাঝে কলা ভবনের পেছনে বা অপারাজেয় বাঙ্গলার সামনে বসে গল্প করতাম আর আকাশ দেখতাম। রাসু ওর গ্রামের গল্প বলত আমাকে। আমি মুগ্ধ হয়ে শোনতাম।
ও কোন আজে বাজে কথা বলত না। গ্রামের মানুষের সহজ সরল জীবনের গল্প করত আমার কাছে। কিন্তু সেদিনের গল্পটা অতটা সহজ-সরল ছিলো না। তাই আমারও বিশ্বাস করতে খুব কস্ট হয়েছিল। তারপরও বিশ্বাস করেছিলাম রাসুর মুখে শুনেছিলাম বলে।
সেদিন ছিল ভরা পূর্ণিমা। পূর্ণিমা আমার ভালো লাগে, তবে এ নিয়ে আমার মধ্যে কোন রকেমের বাড়াবাড়ি নেই। রাসুরও পূর্ণিমা ভালো লাগে। তবে পূর্ণিমার দিন ও কেমন যেনো অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে। ওর চোখে-মুখে এক ধরনের উদ্বেগের ছায়া যেন ভেসে উঠে।
পূর্ণিমার রাতে রাসু খুব বেশি হাটতে চায় না। এক জায়গায় বসে থেকে আকাশ দেখে। আমরা আকশের রহস্য নিয়ে কথা বলি। রাসু বলে, এই আকাশের রহস্য মানুষ কখনই শেষ করতে পারবে না। আমি জিজ্ঞেস করি, কেন? ও বলে, আকাশের রহস্য আকাশের মতই সীমাহীন।
একটা রহস্যের মীমাংসা হলে আরেকটা রহস্যের খোজ পাওয়া যায়।
“জানিস, এমন পূর্ণিমা রাতে আমাদের গ্রামে কেউ ঘর থেকে বের হয় না। ”
“কেন, তোদের গ্রামের মানুষ কি পূর্ণিমা পছন্দ করে না”
“পূর্ণিমা পছন্দ করে না এমন লোক কি পৃথিবীতে আছে নাকি। ”
“তবে কেন পূর্ণিমা রাতে তোদের গ্রামের লোক ঘর থেকে বের হয় না, তারা কি পূর্ণিমা ভয় পায়। ”
“ঠিক পূর্ণিমা ভয় পায় না, তবে পূর্ণিমা রাতের ডাক ভীষণ ভয় পায়…”
“পূর্ণিমা রাতের ডাক… মানে?”
“মানে আমাদের গ্রামে পূর্ণিমা রাতে এক বিচিত্র ডাক শোনা যেত- মানুষের আত্মা কেপে ওঠে অমন বিচিত্র চিতকারে- কেউ বলত মরা মানুষের ডাক, কেউ বলত জিন্দালাশের চিতকার, আসলে ওটা ছিল জীবিত মানুষ মাটির নীচে পুতে ফেললে যেমন আকাশ বাতাস ফাটিয়ে চিতকার দেয় তেমনই গগন বিদারী আর্তনাদ -যা মানুষের পক্ষে সহ্য করা খুব কঠিন।
”
“শোনা যেত বলছিস, এখন কি আর সেই বিচিত্র ডাক শোনা যায় না। ”
“না এখন আর শোনা যায় না। চিঠি আসার পর থেকে সব স্বাভাবিক। তবে মানুষের মনের ভয়টা এখনো দূর হয়নি। ”
“বিষয়টা খুলে বল তো।
”
“বলছি, তার আগে আরেক দফা চা খেয়ে নেই। “
“চল তাহলে, পাবলিক লাইব্রেরীর দিকে যাই। ”
তখন রাত প্রায় পৌনে একটা। পাবলিক লাইব্রেরী সামনের রোড ডিভাইডারে বসে চা খেতে খেতে গল্প বলা শুরু করল রাসু।
আমাদের গ্রামটা বেশ ছোট।
আশপাশে আর কোন গ্রাম নেই-বেশির ভাগই হাওর এলাকা। গ্রামের উত্তরে মাঘাই টিলা । কোন এককালে মাঘাই সিং নামে এক প্রভাবশালী জমিদার এ গ্রামে বাস করত। তার নামেই এ টিলার নাম। মাঘাই টিলার উপরে গ্রামের কবরস্থান।
গ্রামের লোকজন মারা গেলে এখানে কবর দেওয়া হয়্। পূর্ণিমা রাতে মাঘাই টিলা থেকেই সেই বিচিত্র ডাক ভেসে আসত। গ্রামের লোকজনের বিভিন্ন ধরনের ব্যাখ্যা ছিল এ ডাক সম্পর্কে। তবে সবাই এ ডাক ভয় পেত। পূর্ণিমা রাতে সবাই দরজা বন্ধ করে ঘরে বসে থাকত।
নিতান্ত কোন প্রয়োজন ছাড়া কেউ ঘরের বাইরে বের হত না। একবার গ্রামে এক চিঠি আসে। চিঠি নিয়ে ডাক পিয়ন বেশ ঝামেলায় পড়ে যায়। চিঠিটা কোথা থেকে এসেছে তা বোঝার কোন উপায় নেই। কারণ চিঠিতে প্রেরকের কোন নাম-ঠিকানা নাই।
খামের উপর ডাকঘরের সীলটাও অস্পষ্ট। প্রাপকের নাম সুনির্দিষ্ট নয়। প্রাপকের জায়গায় লেখা আছে-
মাঘাইটিলা কবর খনন কমিটি,
ডাক- উত্তরপাড়া,
থানা-হবিবপুর,
জিলা-বীরগঞ্জ ।
মাঘাইটিলা গোরস্থানের খাদেম ও কবরখনন কমিটির সভাপতি ইদ্রিস মিয়া চিঠি পেয়েই জরুরী মিটিং ডাকলেন। কবরখনন কমিটির সদস্য ও গ্রামের গন্যমান্য লোকজন মিটিংযে উপস্থিত হলেন।
গোর খোদক এমরানকেও ডাকা হল। মিটিংযে ইদ্রিস মিয়া সবার সামনে চিঠিটা পড়লেন। চিঠির ভাষা প্রায় দূর্বোধ্য। আরবী হরফের মত করে বাংলায় লেখা বাক্যগুলো অসম্পূর্ণ আর ভুল শব্দে ভরা। যতটুকু বুঝা গেল, কেউ একজন লিখেছে, মাঘাই টিলা গোরস্থানের পূর্ব পাশের ছাতিম গাছের নীচে জীবিত মানুষ পুতা আছে, সে মুক্ত হতে চায়।
গ্রামের লোকের উচিত কবর খুড়ে তাকে মুক্ত করা। গোর খোদক এমরান বলল, মাঘাই টিলায় ছাতিম গাছ আছে একটাই। তাও প্রায় শত বছর পুরনো। আর ছাতিম গাছের তলার কবরটাও বহু পুরনো। জীবিত মানুষ তো দূরের কথা, মৃত মানুষের হাড়গোড় পাওয়াও কঠিন হবে ওই কবর খূড়ে।
এমরানের কথার উপর উপস্থিত সবাই গুরুত্ব দিল। এমরান অনেক পুরনো গোর খোদক। তাছাড়া সে-ই মাঘাই টিলা গোরস্থান দেখেশুনে রাখে। গ্রামের মুরব্বীরা মত দিলেন উড়ো চিঠি পেয়েই কবর খোড়া ঠিক হবে না। তাছাড়া এটা শরীয়ত সম্মতও নয়।
তবে এক সপ্তাহ পরই সবাই মত বদলালেন। কারণ এই এক সপ্তাহে গোর খোদক এমরান সহ গ্রামের কয়েকজন লোক স্বপে দেখলেন ঐ ছাতিম তলার কবর থেকে কেউ একজন সাহায্য চাচ্ছে। অবশেষে গ্রামের মুরব্বীরা সিদ্ধান্ত নিলেন কবর খুড়ে দেখার। গোর খোদক এমরান সবার উপস্থিতিতে একদিন ছাতিম তলার কবর খুড়ল।
গল্পের এ পর্যায়ে রাসু থামল।
রাত বাড়ছে। পূর্ণিমার চাঁদ তখন আমাদের মাথা ছুঁই ছুঁই করছে। রাসুর ভেতর অস্থিরতাও খানিকটা বাড়ছে মনে হলো। রাসু বলল, এখন হলে ফেরা দরকার। আমি বললাম, তার আগে গল্পটা শেষ কর।
গল্প তো প্রায় শেষ। চল বাকিটা হলে ফিরতে ফিরতে বলি।
চল।
আমরা দুজনে হলের দিকে হাটতে শুরু করলাম। রাসু বলল, কবর খুড়ে তেমন কিছু পাওয়া গেল না-শক্ত দড়ি দিয়ে পেচানো কিছু বহু পুরনো হাড়-গোড় ছাড়া।
“দড়ি দিয়ে পেচানো হাড়-গোড়!” আমি অবাক হলাম।
“হুম, দড়ি দিয়ে পেচানো হাড়-গোড়। অনেক পুরনো দড়ি কিন্তু পচে যায় নি। শক্ত শিকড়ের মত মাটির সাথে মিশে ছিল। ” রাসু দ্রুত হাটছে।
ওর গতির সাথে তাল মেলাতে আমাকেও বেশ বেগ পেতে হচ্ছে।
“এর পেছনে এক নির্মম ইতিহাস আছে” হাটতে হাটতে কথাও দ্রুত বলছে রাসু। যেন গল্পটা সে দ্রুত শেষ করতে চায়। তার চেয়েও দ্রুত সে হলে ফিরতে চায়। “গ্রামের মুরব্বীরা বলেন, এ অঞ্চলের জমিদার মাঘাই সিং ছিল অত্যন্ত অত্যাচারী।
বিচিত্র পন্থায় সে মানুষ কে শাস্তি দিত। বিদ্রোহী প্রজাদের সে ধরে এনে হাত পা বেধে জ্যান্ত কবর দিত। ছাতিম তলার কবরটাও সম্ভবত মাঘাই সিংযের আমলের কোন জ্যান্ত মানুষের কবর। ”
“আর পূর্ণিমা রাতের সেই বিচিত্র চিতকার?”
“কবর খুড়ার পর থেকে আর সেই চিতকার শোনা যায় না। ”
“কিন্তু মানুষের মনের ভয় এখনো দূর হয় নি।
” রাসুর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম আমি। ততক্ষনে আমরা প্রায় হলের কাছাকাছি চলে এসেছি।
“হয়তো…” রাসু সংক্ষেপে জবাব দিল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।