বাঙালি জাতিকে সবসময় বীরের জাতি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়ে থাকে। আর স্বাধীনতার পর থেকে বাঙালি যখন স্বতন্ত্র জাতি ‘বাংলাদেশী’ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করল, তখন থেকে বীরের উপাখ্যানের পৃষ্ঠার সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়ে গেল কারণ মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করে একটি দেশ স্বাধীন করা কোন সাধারণ মানুষের কাজ নয়। দেশ স্বাধীনের পেছনে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদানকে ছোট বা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করতে আমি এইটা লিখছি না। আমি বলতে চাচ্ছি স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমাদের মধ্যে যে অকুতোভয় ব্যাপারটা ছিল, আজ স্বাধীনতার ৪০ বছর পরে এসে তার কোনকিছুই অবশিষ্ট নেই। আজ আমরা যেন অনেকটা গোল্ডফিশের মত হয়ে যাচ্ছি।
একেকটা ঘটনা ঘটছে। বড়জোর মাসখানেক মনে রাখছি, তারপর সব ভুলে যাচ্ছি। আসলে ভুলে যাচ্ছি বললে ভুল হবে। আমরা সবকিছু মেনে নিচ্ছি, অর্থাৎ আমরা বীরের জাতি থেকে ধীরে ধীরে সহনশীল জাতিতে পরিণত হচ্ছি। এর মধ্যে গর্বের কোন বিষয় নেই, অত্যন্ত লজ্জার বিষয় যে আমরা প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া সব অপরাধের বিচারের জন্য কোন ধরণের যুদ্ধে নামি না।
যুদ্ধ মানেই অস্ত্র হাতে অন্যের উপর ঝাঁপিয়ে পড়া নয়। যুদ্ধ মানে ন্যায়কে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া। কিন্তু এসব গালভরা কথা বলে কি লাভ? আমার কথাগুলো কিছু ব্লগার পড়বেন। হয়তো কিছু লিখবেনও। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সমাজের উপরতলায় বা তৃণমূল পর্যায়ে আমার কথা পৌঁছাবে না।
আমাদের সমস্যাটা হচ্ছে আমরা বলার সময় অনেক কিছুই বলে ফেলি, কিন্তু আমাদের কথাগুলো বাস্তবায়ন করার জন্য যখন সমাজের দুচারজন মানুষ এগিয়ে আসে, তখন তাদের দুইটি বিশেষ দলের যে কোন একটির অন্তর্ভুক্ত করার জন্য উঠেপড়ে লেগে যাই। সবশেষে, সমাজ সংস্কারের সংকল্পটি রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির পাঁয়তারা হিসেবে গৃহীত হয়।
ক্ষুধার জ্বালায় দীপালি যখন আত্মহত্যা করে, তখন আমরা দীপালির মত আরও শত শত ক্ষুধার্ত মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে যাইনি,বরং ক্ষমতাসীনদের সান্নিধ্য লাভের জন্য, নিজের পকেট ভারী করার জন্য বিশেষ বিশেষ দিনে ৫০-৬০ পাউন্ডের কেক কেটে। আমরা প্রতি বছর নির্দ্বিধায় মেনে নিয়েছি ক্ষুধার জ্বালায় এরকম একের পর এক আত্মহত্যা। কিছু মিডিয়ায় এসেছে, কিছু আসেনি।
এসব নিয়ে কিছুদিন খবর প্রচার হয়েছে, তারপর সবাই বেমালুম ভুলে গিয়ে অন্য কোন বিষয়ে মেতে উঠেছে।
আমাদের দেশ এমন একটা দেশ যেখানে তীব্র হতাশায় আক্রান্ত হয়ে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেওয়ার কারণে বছরের পর বছরের পর জেল হয়ে যায়, কিন্তু ক্ষুধার জ্বালায় আত্মহত্যা করলে মৌলিক অধিকার পূরণে ব্যর্থ হওয়ার অপরাধে সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়না।
আমরা সেই দেশ যেখানে একটি লঞ্চ দুর্ঘটনায় শত শত মানুষ মারা যায়, আর দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা বলেন, তাদের কিছুই করার ছিল না। সবই তাদের নিয়তি ছিল। প্রতিটা মৃত্যুর পরিবর্তে একটা করে ছাগল ধরিয়ে দেওয়া হয়।
ছাগল দেওয়াটাই ঠিক আছে, আমরা তো একেকটা ছাগলই। নাহলে কি আর এই অভাগা দেশে একের পর এক দুর্ভাগ্যের স্বীকার হই।
এমনই অভাগা দেশের নাগরিক আমরা যেখানে চালকের অদক্ষতায় দুর্ঘটনা ঘটলে এবং তাতে মানুষ মারা গেলে মাত্র কয়েক বছরের শাস্তি হয়। আমরা যারা মানুষ খুন করতে চাই, তারা কেন অযথা বন্দুক কিনে বা লোক ভাড়া করে খুন করাতে চাই। একটা গাড়ি চালিয়ে লোকটার উপর উঠিয়ে তাকে পিষ্ট করে মেরে ফেললেই তো হয়।
কাজটি অগোচরেও করতে হবে না। হাজার হাজার লোকের সামনেও করতে পারেন, তাতে আপনার ফাঁসি হবেনা। কারণ আপনি শুধুমাত্র একটি দুর্ঘটনা(!) ঘটিয়েছেন, কোন মানুষকে হত্যা করেননি।
আমাদের দেশ নাকি সামরিক শাসন আর একনায়কতন্ত্রের ছায়া থেকে বের হয়ে এসে গণতন্ত্রের সুশীল ছায়ায় অবস্থান করছে। এই নাকি গণতন্ত্রের নমুনা।
যেখানে সত্যি কথা বলতে গেলে কোটি কোটি টাকার মানহানির মামলার মুখোমুখি হতে হয়। সমালোচনা করতে গেলে হত্যা হুমকি হিসেবে গণ্য করা হয়। যেখানে দলীয় প্রধান সকলের ভোটে নির্বাচিত হননা, তিনি আসেন কারও ছেলে বা মেয়ে, কারও স্বামী বা স্ত্রী নয়তো কার নাতিনাতনি হিসেবে। এই গণতন্ত্র শুধু জনগণকেই সহনশীল হতে শেখায়। যখন যে দল ক্ষমতায় তখনি সেই দল জনগণকে চুষে খাবে।
আমজনতা কিছুই বলবে না, কারণ অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গেলেই তাকে দেশদ্রোহী হিসেবে গণ্য হতে হবে।
আমাদের বুদ্ধিজীবীরা বলেন, আমাদের মারটিন লুথার কিং বা মাহাথির মোহাম্মাদ কিংবা নিদেনপক্ষে একজন আন্না হাজারে হলেই দেশটিকে অনেকখানি পাল্টানো যেত। তাদের বলতে চাই, আপনারা নিজেরা কেন এরকম মানুষ হিসেবে নিজেদের মেলে ধরতে পারেন না। আপনারা কেন বিদ্যমান দুইটি রাজনৈতিক দলের একটির হয়েই কথা বলেন? আপনারা কেন সবসময় অপ্রতুল সম্পদ/সুবিধার কথা উল্লেখ করে নিজেদের ব্যর্থতাকে ঢাকতে চান? একটিবারও কেন এই অল্প সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার করে দেশের কল্যাণে একটি অনন্য উদাহরণ রাখেন না? কেন সবসময় বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সমালোচনা করে ‘ব্রেইন ড্রেইনের’ উদাহরণ টেনে আনেন? সমাজের নীতিনির্ধারকরা তো আপনাদের কথা শুনেই সব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, তাহলে কেন তাদের রাজি করাতে পারেন না বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তন আনতে? উত্তরটা হয়তো এমনই, যদি দেশের আগামী প্রজন্ম প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারে তাহলে তারা স্বীয় প্রচেষ্টাতেই এই পিছিয়ে পড়া দেশকে অনেক সামনে নিতে পারবে। ‘আমলাতান্ত্রিক জটিলতা’ কথাটি চিরতরে দেশ থেকে মুছে ফেলতে পারবে।
আপনাদের মত আগাছাদের লাখ লাখ টাকা দিয়ে পুষতে হবে না। আপনারা মোটেও কল্যাণকর নন। আপনারা ভীরু, কাপুরুষ , সত্য স্বীকার করার মানসিকতা যেমন আপনাদের নেই, ঠিক তেমনি দেশের জনগণকেও সত্য প্রতিষ্ঠা করার সংগ্রাম থেকে বিরত রাখতে উৎসাহিত করেন।
আমরা অতিমাত্রায় সহনশীল কারণ যখন দেশের কোটি কোটি টাকা বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে। দেশের রাজকুমারগণ কোটি কোটি টাকা খরচ করে বছরের পর বছর বিদেশে বিলাসবহুল জীবনযাপন করছেন আর সেখানে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায়, স্টেশনে, ফুটপাথে রাত কাটাচ্ছে।
আমরা কিছুই বলি না। কারণ আমরা ভয় পায়, পাছে আমাদের জেলখানায় রাত কাটাতে হয়।
আমাদের নেত্রীগণ যেখানে জামাকাপড় আর প্রসাধনীর পেছনে লাখ লাখ টাকা খরচ করেন সেই একই দেশে উৎসবের সময় একটা নতুন জামা না পেয়ে ১২ বছরের ছোট্ট বালককে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হয়। তারপরও আমরা ঘটনাগুলো এড়িয়ে যাই। আমরা এমনই দেশ যেখানে ৫ লাখ টাকার লেহেঙ্গা পরা তরুণীর হাস্যোজ্জল ছবির পাশাপাশি সারাদিন অমানুষিক পরিশ্রম করে মাত্র ৫ টাকা আয় করা শ্রমিকের ঘামে ভেজা হতাশ চাহনি তুলে ধরা হয়।
আমরা হয়তো ভাবতে থাকি, কিন্তু ওই ভাবাই শেষ। যে মুহূর্তে খবরটি চোখের সামনে থেকে সরে যাচ্ছে, তখনই আমরা ঘটনাটি ভুলে যাচ্ছি।
আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত মঙ্গলপ্রদীপ জ্বালিয়ে উৎসব করা হয়। হাজার হাজার ওয়াটের আলো জ্বালিয়ে সম্মেলন করা হয়। কিন্তু প্রদীপ জ্বালানোর জন্য কয়েক ফোঁটা তেলের অভাবে যখন প্রত্যন্ত অঞ্চলের কোন মেধাবী শিক্ষার্থী অকালেই ঝরে পড়ে, সেগুলোর জন্য আমরা কিছুই বলিনা।
এরকম এক বাংলাদেশের জন্যই কি দুই লাখ বীরাঙ্গনা সম্ভ্রম হারিয়েছিল?আমাদের সাহসী বীরযোদ্ধারা যুদ্ধের প্রান্তরে অকাতরে প্রাণ বিলিয়েছিল? ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।