একের পর এক মামলার আসামি হয়েও ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছেন যমুনা গ্রুপের মালিক নুরুল ইসলাম বাবুল। সম্প্রতি নির্মাণসামগ্রী ফেলে মোটরসাইকেল চালককে হত্যা এবং র্যাবের পোশাক ব্যবহার করা মামলায় ফাঁসলেও আইনের ফাঁক গলে নিরাপদেই আছেন বাবুল। রাজস্ব ফাঁকিসহ অন্তত নয়টি মামলায় তিনি আগাম জামিন নিয়েছেন আদালত থেকে।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বাবুলের মালিকানাধীন যমুনা ফিউচার পার্ক ভবনের শাটার ভেঙে কুড়িল ঘাটপাড়া এলাকার বাসিন্দা শাহীন মিয়া নিহত হওয়ার ঘটনায় তার বড় ভাই হযরত আলী ভাটারা থানায় একটি হত্যা মামলা (নম্বর ২৪(১২)১৩) দায়ের করেছেন। উচ্চ আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে আসার পর থেকেই বাবুলের সহযোগীরা নিহত শাহীনের স্বজনদের মামলা তুলে দিতে হুমকি দিচ্ছেন।
তবে বাবুলের ক্ষমতার দাপটের কারণে বাদী হযরত আলী থানা পুলিশের কোনো সহায়তাও পাচ্ছেন না। বাদীকে না জানিয়ে এরই মধ্যে হত্যা মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব ভাটারা থানা থেকে ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে।
সম্প্রতি নুরুল ইসলাম বাবুলের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা করেছে র্যাব। এলিট ফোর্স র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের (র্যাব) পোশাকসদৃশ পোশাক ব্যবহার করায় যমুনা ফিউচার পার্কের মালিক নুরুল ইসলাম বাবুলসহ ১৩ জনকে আসামি করে ১১ জানুয়ারি রাতে ভাটারা থানায় একটি মামলা করেন র্যাব-১-এর উপ-সহকারী পরিচালক পরম উদ্দিন। ওই দিন মেজর খান মোহাম্মদ আরিফুর রহমানের নেতৃত্বে একটি দল র্যাবসদৃশ পোশাক পরে দায়িত্ব পালনকালে যমুনা গ্রুপের ১২ জন নিরাপত্তা কর্মীকে গ্রেফতার করে।
তারা হলেন আবদুল হান্নান, রাসেল শাহ, মনির হোসেন, শাহ আলম, বায়েজিদ আলম, জয়েন কাজী, আবদুল আলিম, সোহাগ সরকার, ইসমাইল, মেহের আলী, সামাদ ও সাইফুল।
ওই রাতেই র্যাবের উপ-সহকারী পরিচালক পরম উদ্দিন বাদী হয়ে গ্রেফতার ১২ নিরাপত্তা কর্মীসহ যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুলকে আসামি করে মামলা করেন। গ্রেফতারকৃতরা পুলিশের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, নুরুল ইসলাম বাবুলের নির্দেশেই তারা ওই পোশাক পরতেন। ১৩ জানুয়ারি ১২ নিরাপত্তা কর্মীকে কারাগারে পাঠিয়ে দেন আদালত।
সূত্র জানায়, শাহীন হত্যাকাণ্ড ও র্যাবসদৃশ পোশাকে কথিত বাহিনী গঠনের অভিযোগে দায়ের করা দুই মামলায় হাইকোর্ট থেকে আট সপ্তাহের জামিন পান যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল।
১৮ জানুয়ারি আদালতে সশরীরে হাজির হন যমুনা গ্রুপের চেয়ারম্যান নুরুল ইসলাম বাবুল। শুনানি শেষে বিচারপতি নাঈমা হায়দার ও বিচারপতি জাফর আহমেদের হাইকোর্ট বেঞ্চ তাকে আট সপ্তাহের জামিন দেন। দুটি আলোচিত মামলায় উচ্চ আদালত থেকে জামিনে থাকার কারণে তদন্তকারীরা বাবুলকে জিজ্ঞাসাবাদও করছেন না। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য যোগাযোগ করা হলেও নুরুল ইসলাম বাবুল কোনোরকম পাত্তাও দিচ্ছেন না।
গত বছরের ৩১ ডিসেম্বর বেলা ১১টার দিকে নির্মাণাধীন যমুনা ফিউচার পার্কের শাটার ভেঙে পড়ে মোটরসাইকেলে বসা শাহীন মিয়া (৩৫) নিহত হন।
তার নিহত হওয়ার ঘটনায় অসহায় হয়ে পড়েন স্ত্রী ও তিন নাবালক সন্তান। শুরুতে শাহীন হত্যা মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা ছিলেন ভাটারা থানার এসআই আরিফ। তিনি জানান, ঊধর্্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে মামলাটির তদন্তভার মহানগর ডিবিতে হস্তান্তর করা হয়েছে। এ মামলার ব্যাপারে ভাটারা থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মোহাম্মদ আলী বলেন, শাহীনের ময়নাতদন্ত রিপোর্টটি এখনো থানায় পেঁৗছায়নি। আসামিরাও জামিনে আছেন।
এখন মামলাটি তদন্ত করছে ডিবি। নিহতের স্বজনদের হুমকি দেওয়ার অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে অবশ্যই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এনবিআরের সাত মামলা
২০০৬-০৭ থেকে ২০১১-১২ অর্থবছর পর্যন্ত বিভিন্ন করবর্ষে সঠিকভাবে আয়কর রিটার্ন দাখিল না করা, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে প্রকৃত আয় গোপন রাখাসহ শতাধিক কোটি টাকা কর ফাঁকির অভিযোগে নুরুল ইসলাম বাবুল, তার স্ত্রী সালমা ইসলাম এমপি ও ছেলে শামীম ইসলামের বিরুদ্ধে সাতটি মামলা হয়েছে। বারবার তাগাদা দেওয়ার পরও বকেয়া রাজস্ব পরিশোধ না করায় এনবিআর থেকে মামলাগুলো রুজু করা হয়। এসব মামলায় ১৫৫ কোটি ১৯ লাখ ১৪ হাজার ২৩০ টাকার তথ্য গোপন এবং এর ওপর প্রযোজ্য ৪৫ কোটি ৩১ লাখ ২৮ হাজার ৮৮ টাকা কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়েছে তাদের বিরুদ্ধে।
এ সাত মামলায় গত বছরের ২০ মে হাইকোর্টের বিচারপতি সালমা মাসুদ চৌধুরী ও বিচারপতি মো. জাহাঙ্গীর হোসেনের বেঞ্চ তাদের এক মাসের আগাম জামিন দেন। এর পর থেকেই আয়কর বিভাগ থেকে দায়ের করা মামলাগুলোর তদন্ত কার্যক্রম ঝিমিয়ে পড়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, মামলাগুলোর বাদী এনবিআরের উপকর কমিশনার মোহাম্মদ আতাউল হক, মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ও দীপককুমার চক্রবর্তী এখন মামলার ব্যাপারে কোনো তৎপরতাই চালাচ্ছেন না। বাবুলের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের পর তারা নিজেরাই নানারকম হয়রানির শিকার হয়েছেন। নতুন করে আর কোনো তৎপরতা চালিয়ে নুরুল ইসলাম বাবুলের রোষের শিকার হতে চাইছেন না তারা।
এনবিআর সূত্র জানায়, বকেয়া রাজস্ব আদায়ে বারবার এনবিআর তাগাদা দিলেও তারা (নুরুল ইসলাম বাবুল, সালমা ইসলাম এবং শামীম ইসলাম) হিসাবমতো রাজস্ব পরিশোধ করেননি। প্রকৃত আয় গোপন করে আয়কর বিবরণীতে মিথ্যা হিসাব উল্লেখ করেন। যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান যমুনা টেলিভিশন এখনো হিসাবমত আয়কর বিবরণী জমা দেয়নি। যমুনা টেলিভিশনের নামে এরই মধ্যে এনবিআর থেকে অডিট আপত্তি করা হয়েছে।
চলতি বছরের শুরু থেকেই এনবিআর রাজস্ব আদায়ে নতুন কৌশল গ্রহণ করে।
এসব পদক্ষেপের মধ্যে দীর্ঘ দিন থেকে কর ফাঁকি দিয়ে আসছে এমন বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের তালিকা তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করে। এনবিআরের মূল দফতর থেকে এ বিষয়ে বিভিন্ন কর অঞ্চলে এবং কর সার্কেলে নির্দেশ দেওয়া হয়।
সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চল থেকে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এনবিআর যমুনা গ্রুপকে কর ফাঁকিবাজ হিসেবে চিহ্নিত করে। যমুনা গ্রুপের সব হিসাবপত্র যাচাই-বাছাই করতে সংশ্লিষ্ট কর অঞ্চলের নির্ধারিত কর সার্কেলকে এনবিআরের মূল দফতর থেকে জরুরি ভিত্তিতে নির্দেশ দেওয়া হয়। যমুনা গ্রুপের রাজস্ব ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে বিভিন্ন অনিয়ম উল্লেখ করে অভিযোগমালা তৈরি করে এনবিআর।
এ ক্ষেত্রে যমুনা গ্রুপের সাতটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কর ফাঁকির অভিযোগ আনা হয়।
মামলাগুলোর মধ্যে চারটিতে নুরুল ইসলাম বাবুলকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক, একটিতে চেয়ারম্যান এবং একটিতে প্রধান নির্বাহী হিসেবে আসামি করা হয়েছে।
অন্যদিকে শামীম কম্পোজিট মিলস মামলায় সালমা ইসলামকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও শামীম স্পিনিং মিলস মামলায় ছেলে শামীম ইসলামকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আসামি করা হয়েছে।
যমুনা গ্রুপের কর ফাঁকিবাজ প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে রয়েছে শামীম কম্পোজিট মিলস লিমিটেড, শামীম স্পিনিং মিলস লিমিটেড, যমুনা ওয়েল্ডিং ইলেকট্রোড লিমিটেড, যমুনা স্পিনিং মিলস লিমিটেড, যমুনা ইলেকট্রিক ম্যানুফ্যাকচারিং কেম্পানি লিমিটেড ও শামীম বোটন স্পিনিং মিলস লিমিটেড।
এনবিআরের উপকর কমিশনার মোহাম্মদ আতাউল হক, মোহাম্মদ জহিরুল ইসলাম ও দীপককুমার চক্রবর্তী ঢাকার জ্যেষ্ঠ বিশেষ জজ আদালতে এ মামলাগুলো করেন।
২০০৬-০৭ থেকে ২০১১-১২ পর্যন্ত বিভিন্ন করবর্ষে সঠিক আয়কর রিটার্ন দাখিল না করা, মিথ্যা ঘোষণা দিয়ে আয় গোপন ও কর ফাঁকির অভিযোগে মামলাগুলো করা হয়।
যমুনা গ্রুপের প্রতিষ্ঠান যমুনা টেলিভিশন যার কর শনাক্তকারী নম্বর ০০১২০১৪১৮৬। ২০১২-১৩ করবর্ষে প্রতিষ্ঠানটির নামে রাজস্ব ফাঁকির অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে বড় অঙ্কের অডিট আপত্তি রয়েছে। এ বিষয়ে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, চলতি সপ্তাহে এ বিষয়ে সব অনিয়ম-আপত্তি নিষ্পত্তির জন্য যমুনা টেলিভিশশন কর্তৃপক্ষের মালিকের সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এনবিআরের এক ঊধর্্বতন কর্মকর্তা বলেন, রাজস্ব ফাঁকি দিলেও যমুনা গ্রুপের মতো বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এনবিআর কিছু করতে গেলেই আইনের ফাঁক গলে এসব দুর্নীতিবাজ প্রতিষ্ঠান পার পেয়ে যায়। এসব বড় মাপের প্রতিষ্ঠানের দু-একটিকে শাস্তির আওতায় আনতে পারলেই রাজস্ব ফাঁকির পরিমাণ কমে যাবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।