অপহরণ ও অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়ে গেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পরিচয়ে বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট, ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান থেকে লোকজনকে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর তাদের আর খোঁজ মিলছে না। এসব ঘটনার দায়দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যেমন স্বীকার করছে না, তেমনি নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধানও তারা মেলাতে পারছেন না। পাশাপাশি অজ্ঞাতনামা লাশের সংখ্যাও বাড়ছে। দাফন হচ্ছে অজ্ঞাত হয়েই।
অন্যদিকে অপহৃতের স্বজনদের দিন কাটছে কান্না আর হাহাকারের মধ্যে। কোথাও অজ্ঞাত লাশ উদ্ধারের খবর শুনলেই ছুটে যাচ্ছেন স্বজনরা। কেউ খুঁজে পাচ্ছেন প্রিয়জনের অর্ধগলিত, বিকৃত, নিথর দেহ। আবার কাউকে যেতে হচ্ছে আরও দীর্ঘপথ। দিন গড়িয়ে মাস, মাস পেরিয়ে বছর গেলেও লাশটি পর্যন্ত মিলছে না।
এভাবে নিখোঁজ হওয়া মানুষের তালিকা দীর্ঘ হচ্ছে।
সম্প্রতি অপহরণের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ভাবিয়ে তুলেছে। নাগরিক জীবনেও এ নিয়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। গত দেড় মাসে এমন অন্তত ২০টিরও বেশি অপহরণের ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামের স্বর্ণ ব্যবসায়ী মৃদুল চৌধুরীকে উদ্ধার করা গেলেও খোঁজ এখনো মেলেনি সেখানকার আরও পাঁচ ব্যবসায়ীর।
এ ছাড়া রাজধানী থেকে অপহৃতদের অধিকাংশের কোনো হদিস পাওয়া যায়নি। তবে লাশ মিলেছে কয়েকজনের। অজ্ঞাত লাশের সংখ্যাও বহু। সর্বশেষ গতকাল বুড়িগঙ্গায় ভাসমান অবস্থায় এক যুবকের লাশ পাওয়া গেছে। আগের দিন পাওয়া গেছে আশুলিয়ায় অপর এক যুবকের লাশ।
নিখোঁজ একাধিক ব্যক্তির পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানতে চাইলেও অনেকেই এ বিষয়ে মুখ খুলতে রাজি হননি। তাদের অধিকাংশের মতে, টিভি ও পত্র-পত্রিকায় খবর বের হলে তাদের সন্তানকে মেরে ফেলা হবে। তাদের ফিরে পাওয়ার সম্ভাবনাই আর থাকবে না। এসব পরিবারের লোকজন বিশ্বাস করেন, তাদের সন্তান ফিরে আসবে, যে কোনো সময়। সে অপেক্ষায় পথ চেয়ে বসে আছেন তারা।
তারা বলছেন, পুলিশ অপহৃতদের উদ্ধারের বিষয়ে কোনো তদন্ত করে না। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয়েছে, এমন তথ্য দেওয়া হলেই পুলিশ জিডি পর্যন্ত নিতে চায় না।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একাধিক সূত্র অবশ্য বলছে, অপহরণের পর মুক্তিপণ আদায়ের একটি ভয়ঙ্কর চক্রও এখন সক্রিয় রাজধানীসহ সারা দেশে। এরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে শিকারের খোঁজে।
র্যাব ও পুলিশ পরিচয়ে চক্রটি বাসাবাড়ি, রাস্তাঘাট থেকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষকে।
এদের আচরণ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মতোই। তাদের কাছে থাকে পুলিশি সব সরঞ্জাম। পুলিশ পরিচয়ে তারা অপহরণ করছে সাধারণ মানুষকে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ও চাকরিচ্যুতরাও এসব গ্রুপে জড়িয়ে পড়েন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরি থাকা অবস্থায়ও মুক্তিপণ আদায়ে অপহরণের মতো বড় ধরনের অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন।
খোলাবাজার থেকে কেনা হ্যান্ডকাফ, পিস্তলের খাপ, খেলনা অথবা বৈধ-অবৈধ পিস্তল, র্যাব-পুলিশ ও ডিবি লেখা জ্যাকেট ও পোশাক পরে তারা অপহরণের কাজটি করে যাচ্ছে।
র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক কর্নেল জিয়াউল আহসান বলেন, এ ধরনের চক্রের সন্ধানে র্যাব কাজ করছে। তাদের কাছে এমন বহু অভিযোগ আসছে। বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
নিখোঁজদের খোঁজ মিলছে না
গত বছরের ৪ ডিসেম্বর রাজধানী থেকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নেওয়া হয় সাত যুবককে। তারা হলেন সুমন, কাওসার, মাসুম, সুমনের খালাতো ভাই তানভীর, রানা, রাসেল ও আল আমিন। ওইদিন দুপুরে র্যাব পরিচয়ে বসুন্ধরা এলাকার একটি নির্মাণাধীন বাড়ি থেকে সুমনসহ ৬ জনকে আটক করে নিয়ে যায় র্যাব। এদের কারও হদিস নেই। এদের স্বজনদের ধারণা, পরিবারের লোকজনের সামনে থেকেই যেখানে তুলে নেওয়া হয়েছে, সেখানে থানায় জিডি করলে তো আরও সমস্যা।
তখন বলবে, ছেলে নিখোঁজে জিডি করেছেন, এখন পুলিশ তদন্ত করে দেখবে। গত ৩ ফেব্রুয়ারি দুপুরে হাইকোর্ট এলাকা থেকে ডিবি পুলিশ পরিচয়ে নাটোরের তিন বিএনপি কর্মীকে অপহরণ করা হয়েছে। তারা হলেন ইব্রাহিম খলিল ফটিক, রিপন এবং শাহ আলম।
অপহৃতকে জীবিত উদ্ধারের ঘটনাও ঘটেছে। পুরান ঢাকার সূত্রাপুর এলাকার কলতাবাজার থেকে হাত-পা বাঁধা ও মুখে স্কচটেপ পেঁচানো অবস্থায় বস্তাবন্দী জীবিত উদ্ধার হয়েছেন রবিউল ইসলাম (২৪)।
গত ১০ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টার দিকে কলতাবাজার আবদুল মজিদ লেন থেকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধারের পর পরই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাকে আগের দিন দুর্বৃত্তরা অপহরণ করে নিয়ে যায়।
গড়ে ৬ অজ্ঞাত লাশ
এদিকে প্রায় প্রতিদিনই অজ্ঞাত লাশ উদ্ধার হচ্ছে। পুলিশের এক পরিসংখ্যন অনুযায়ী, শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন গড়ে এ ধরনের ৬টি লাশের নাম-পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় না। অজ্ঞাত এসব লাশের ছবি প্রকাশ করার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় লাশগুলো অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে।
স্বজনরাও তাদের প্রিয় মানুষগুলোর দাফনে বঞ্চিত হচ্ছেন। রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে আহত হওয়া ব্যক্তিদের চিকিৎসার জন্য সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। ঘটনাস্থলেই নিহত বা লাশ উদ্ধার হলে মৃতদেহ ঢাকা মেডিকেল কলেজ ও সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। মৃতদেহের ময়নাতদন্তের পর লাশ তাদের স্বজনদের কাছে হস্তান্তর করা হয়। কিন্তু যেসব লাশের নাম-পরিচয় পাওয়া যায় না সেগুলো মর্গের সংরক্ষণাগার (মরচ্যুয়ারি)-তে রাখা হয়।
সর্বোচ্চ ৩ দিন লাশগুলো রেখে দাফনের জন্য আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। ওই প্রতিষ্ঠানই লাশের সৎকারের কাজটি সারে।
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১৩ সালে উদ্বেগজনক হারে বাড়ছে নিখোঁজের ঘটনা। তাদের হিসাব মতে, চলতি বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দ্বারা অপহরণের শিকার হয়েছেন ১৬ জন। এর মধ্যে সাতজনের লাশ পাওয়া গেছে।
এ ১৬ জনের মধ্যে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী রয়েছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।