জিএমও নিয়ে সিরিজের তৃতীয় লেখা। এটাও অনুবাদ, এটাও সম্পাদকীয়। এবার আরেকটি সুবিখ্যাত বিজ্ঞান পত্রিকা সায়েন্স থেকে। লিখেছেন এমন কিছু ব্যক্তি যাদের পরিচিতি ইচ্ছাকৃতভাবে আমি হাইলাইট করে দিয়েছি। কেন বারবার লিখছি, কেন আবার পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত দুইটি বিজ্ঞান প্রত্রিকার উদাহরণ দিচ্ছি, কেন লেখকদের হাইলাইট করছি এসব নিয়ে ছোট্ট করে বলে নেই।
জিএমও নিয়ে যারা যখনই লিখছেন তারা শোনা কথা লিখছেন। আগের পর্বে একজায়গায় সম্পাদক লিখেছেন যে- আমাদের কাছে যেই জিনিস আদরনীয়, নিজের এবং সন্তানের খাদ্য, সেটার মধ্যে যদি সংশয় ঢুকিয়ে দেয়া যায় তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেই সংশয়টিই জয়ী হয়। আর এরকম সংশয় সমর্থিত গুজব ছড়াতে ছড়াতে এমন জায়গায় চলে যায় যে সেটা আর নিয়ন্ত্রণে থাকেনা। তবে, নতুন কোন কিছুর প্রবর্তন বা প্রতিষ্ঠা কখনই খুব মসৃণ হয়নি পৃথিবীতে। প্রথম যখন টিকা বা ভ্যাক্সিন দেয়া শুরু হল তখনও প্রতিরোধ শুরু হয়েছিল।
তখন যদি এতগুলো সহজলভ্য পত্রিকা এবং সোশ্যাল মিডিয়ার অস্তিত্ব থাকতো তবে 'ভ্যাক্সিন দেয়া জরুরী' এই বিষয়টা প্রতিষ্ঠিত করতে বেশ বেগ পেতে হতো। এমনকি এখনও, ভ্যাক্সিন দিয়ে সন্দেহাতীতভাবে শিশুর জীবন বাঁচানোর অসংখ্য প্রমাণ স্বত্ত্বও, অদ্ভুত সব সাইট খুঁজে পাবেন যারা ভ্যাক্সিনের বিরুদ্ধে বলছে। কিন্তু এই ভুল তথ্যের সাগর তৈরির দায় বিজ্ঞানীদেরও, তারা খুব ভালভাবে মানুষকে ব্যাখ্যা করে সহজকরে বুঝিয়ে দিতে পারেন নি। যেই পরিমান প্রতিরোধ আসছে সেটার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারেন নি। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কের ব্যাপারটা অনেকখানি উপেক্ষিত থেকেছে।
সেই সঙ্গে আছে কোম্পানি ফান্ডিং ভিত্তিক গবেষণার জন্য বীজের স্বত্ত্ব কোম্পানির কাছে থাকার ফাঁড়া।
তাই আমার মনে হচ্ছে জিএমও (জিনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম) কি জিনিস, কেন দরকারি, বৈজ্ঞানিক তথ্য কতটুকু আছে সেটা মানুষের সামনে নিয়ে আসা। এ সংক্রান্ত বাংলা লেখাগুলি খুবই একপাক্ষিক এবং পর্যাপ্ত নয়। বলে রাখি, বৈজ্ঞানিক তথ্য সত্য প্রমাণিত হলে কে সেটা বলল তা নিয়ে বিজ্ঞান মহলে তেমন মাথাব্যাথা থাকেনা। কিন্তু বুঝতে পারছি সাধারন মানুষের পক্ষে এই ব্যাপারটা বোঝা বেশ কষ্টকর।
কে বললেন, কোন দেশ বললেন, কোন পত্রিকা বলল সেটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তাই আমি পৃথিবীর সবচেয়ে বিখ্যাত দুইটি বিজ্ঞান পত্রিকা, সায়েন্স এবং নেচার, এর সম্পাদকীয়'র উদাহরণ এখানে দিলাম। আর কারা এসব লিখছেন? লিষ্টটা দেখে নিন- দু'জন নোবেলজয়ী, বিশ্ব খাদ্য পুরষ্কারজয়ী, ওলফ পুরষ্কারজয়ী ব্যক্তিবর্গসহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীগণ।
লেখক পরিচিতি
Roger Beachy is a Wolf Prize laureate; President Emeritus of the Donald Danforth Plant Science Center, St. Louis, MO, USA; and former director of the U.S. National Institute of Food and Agriculture.
David Baulcombe is a Wolf Prize laureate and Royal Society Professor in the Department of Plant Sciences of the University of Cambridge, Cambridge, UK. He receives research funding from Syngenta and is a consultant for Syngenta.
Gunter Blobel is a Nobel laureate and the John D. Rockefeller Jr. Professor at the Rockefeller University, New York, NY, USA.
Swapan Datta is Deputy Director General (Crop Science) of the Indian Council of Agricultural Research, New Delhi, India; the Rash Behari Ghosh Chair Professor at Calcutta University, India; and a former scientist at ETH-Zurich, Switzerland, and at IRRI, Philippines.
Nina Fedoroff is a National Medal of Science laureate; a Distinguished Professor at the King Abdullah University of Science and Technology, Thuwal, Saudi Arabia; an Evan Pugh Professor at Pennylvania State University, University Park, PA, USA; and former President of AAAS.
Donald Kennedy is President Emeritus of Stanford University, Stanford, CA, USA, and former Editor-in-Chief of Science.
Gurdev S. Khush is a World Food Prize laureate, Japan Prize laureate, and former scientist at IRRI, Los Baños, Philippines.
Jim Peacock is a former Chief Scientist of Australia and former Chief of the Division of Plant Industry at the Commonwealth Scientific and Industrial Research Organization, Canberra, Australia.
Martin Rees is President Emeritus of the Royal Society, Fellow of Trinity College, and Emeritus Professor of Cosmology and Astrophysics at the University of Cambridge, Cambridge, UK.
Phillip Sharp is a Nobel laureate; an Institute Professor at the Massachusetts Institute of Technology, Cambridge, MA, USA; and President of AAAS.
২০১৩ সালের অগাষ্ট মাসের ৮ তারিখে ফিলিপিনের একটি 'সোনালী ধান' এর শস্যক্ষেত ধ্বংস করে দেয় দূর্বৃত্তরা। ফিলিপিনের কৃষি বিভাগের কর্মকর্তাগণ, যারা আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ইরি, International Rice Research Institute) এবং ফিলিপিনের ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান (ফিলরাইস, PhilRice, Philippine Rice Research Institute) এর ধান গবেষণা পরিচালনা করেন, তারা আসলে এর আগেই আলোচানার মাধ্যমে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধানের আয়োজন করেছিলেন।
আকষ্মিকভাবে এই আক্রমণ আসে, প্রতিবাদকারীগণ গবেষণাস্থানের ভেতরে ঢুকে পড়ে, পুলিশ এবং গ্রাম প্রতিরক্ষা বাহিনীকে হতচকিত করে দেয় এবং ধানগাছগুলিকে নষ্ট করে দেয়। 'কৃষকের আন্দোলন' দাবী করে যেই ধ্বংস চালানো হয়েছে সেটা আসলে করেছে রাতের আঁধারে ট্রাকভর্তি করে আসা কিছু প্রতিবাদকারী।
পুরো বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানসমাজ মাঠপর্যায়ে পরীক্ষারত ধানগুলির এই ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে দাঁড়ায় এবং বহু হাজার সই সংগ্রহ করে মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই (১)। এই কাজের জন্য যদি কখনো কাউকে বা কিছুকে দায়ী করা হয়, তবে সেটা হবে সোনালী ধান-বিরোধী গ্রীনপিস (Greenpeace) এবং এরকম অন্যান্য এনজিও এবং কিছু মানুষের অপপ্রচারণা। সোনালী ধান হল আণবিক পদ্ধতি ব্যবহার করে জিনগতভাবে পরিবর্তিত বেটা-ক্যারোটিন তৈরি করতে পারে এমন একধরনের ধান (সেজন্য একে জিনেটিকালি মডিফাইড অর্গানিজম (জিএমও) বলা যায়)।
বেটা-ক্যারোটিন দিয়ে ভিটামিন-এ তৈরি হয়। আর ভিটামিন-এ হল আমাদের চোখে থাকা রোডপসিন নামক আলোক-সংবেদী একটি অণুর প্রয়োজনীয় উপাদান। ভিটামিন-এ'র অতি-স্বল্পতা মানুষকে অন্ধ করে দিতে পারে এবং যে ৫ লাখ শিশু পৃথিবীতে এভাবে অন্ধ হয়ে যায় তাদের অর্ধেকই ১ বছরের মাথায় মারা যায়। ভিটামিন-এ স্বল্পতা আবার আমাদের রোগ-প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে দূর্বল করে দেয় এবং বিভিন্ন রোগ তৈরিতে সহায়তা করে। এটাকে বলা যায় 'গরীব এবং অপুষ্টিকর খাবার' এর রোগ, পৃথিবীজুড়ে প্রায় ১৯ থেকে ২৮ লাখ শিশু প্রতিরোধ-সম্ভব এমন রোগে মারা যাচ্ছে প্রতিবছর, যাদের মধ্যে বেশিরভাগই ৫ বছরের কমবয়সী শিশু এবং নারী (২)।
বিশ্বজুড়ে ভিটামিন-এ স্বল্পতার হাল (উইকিপিডিয়া)। অনেকে দাবী করেন শাক-সবজী খেয়েই শুধুমাত্র ভিটামিন-এ স্বল্পতার সমাধান সম্ভব। সম্ভব যদি ধানের মত শস্য, যেগুলি আমরা ক্ষুধা মেটাতে খাই, তার মধ্যে ভিটামিন থাকতো অথবা, যেই পরিমাণ শাক-সবজী প্রয়োজন তা পৃথিবীর সব স্থানে মানুষের কাছে সহজলভ্য এবং আওতার মধ্যে হত। সবজী খাওয়ানোর ব্যাপারে বাংলাদেশে গত ৩০ বছর ধরে ক্রমাগত ক্যাম্পেইনের পরও ভিটামিন-এ স্বল্পতার সমস্যা রয়ে গেছে। প্রধান খাদ্য ভাত থেকেই যদি ভিটামিন-এ পাওয়া যেত তবে কি দারুণ হত ভাবুনতো?
পৃথিবীর অর্ধেকেরও বেশি মানুষের জন্য ধান হল প্রধান খাদ্যশস্য, কিন্তু সাদা চালে ভিটামিন-এ নাই।
বিজ্ঞানী ইনগো পট্রিকাস এবং পিটার বেয়ার এবং তাদের দল এমন একটি ধানের জাত তৈরি করলেন যারা বেটা-ক্যারোটিন মজুদ রাখতে পারে। ইরি'র সহযোগিতায় এই জাত তৈরিতে এসে উপনীত হতে তাদের ২৫ বছর সময় লেগেছে, যা থেকে কয়েক আউন্সের ভাত খেলেই কেউ বেঁচে থাকার জন্য পর্যাপ্ত পরিমান বেটা-ক্যারোটিন পেয়ে যাবে (৩)। এটা করতে অনেক সময় লেগেছে, যেমনটা করতে লাগছে সোনালী ধানের বীজকে বিতরণের অধিকার আদায় করতে, যার মধ্যে আছে স্বত্ত্ব সংরক্ষিত আণবিক বস্তু। কিন্তু এটা গরীব কৃষকদের জন্য একেবারেই বিনামূল্যে বিতরণযোগ্য।
এই শতকের শুরু থেকেই এই ধান কৃষকদের ব্যবহারের উপযোগী হয়ে ওঠে, কিন্তু এখনও পর্যন্ত এটা তাদেরকে কাছে বিতরণ করা হয়নি।
পরীক্ষা করে দেখবার অধিক থেকে অধিকতর বিধিনিষেধের জন্য এই বিতরণ শুরুর প্রক্রিয়া ১০ বছর ধরে থেমে আছে। ইরি এবং ফিলরাইস তারপরও ধৈর্য্য নিয়ে এই ধানের ছাড় পাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পরীক্ষাগুলি করে চলেছে। যদিও এই পরীক্ষাগুলি করার দাবী উঠেছিল কিছু মানুষের 'ক্ষতিকর কিছু হতে পারে এমন' ভয় থেকে, যার কোন প্রমাণই কেউ দিতে পারেনি কখনও। জিএম শস্য বানিজ্যিকভাবে উৎপাদনের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত বেশ নিরাপদে, অর্থাৎ উদাহরণযোগ্য ঝুঁকিহীনভাবে গৃহীত হয়ে এসেছে। আর যেহেতু এই শস্য কৃষক, পরিবেশ এবং ভোক্তার জন্য উপকারী, সেহেতু মানুষের কৃষি ইতিহাসে যেকোন প্রযুক্তির চেয়ে দ্রুত জিএম শস্য সাদরে গৃহীত হয়েছে।
নতুন প্রযুক্তি প্রায়শই 'বিপদ হতে পারে' এমন গুজব ছড়িয়ে দেয়। এগুলো সাধারনতঃ দিন দিন ক্ষীণ হয়ে পড়ে, যেহেতু আসলে তেমন কোন বিপদই ঘটেনা। কিন্তু জিএমও-বিরোধী জ্বর এখনও বেশ তাপ নিয়েই পুড়ছে, যার হালে বাতাস দিচ্ছে ইলেক্ট্রনিক গুজব এবং বিদ্বেষ ছড়ানো সুসংগঠিত সংগঠন বা ব্যক্তি যাদের স্বার্থ কোনভাবে জিএমও দিয়ে ব্যাহত হয়। আমরা, এবং আমাদের মত হাজার হাজার বিজ্ঞানীরা একটি প্রতিবাদলিপি সাক্ষর করেছি, প্রতিপক্ষের সঙ্গে লড়তে তাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছি যারা ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে সোনালী ধান ছাড় পাওয়ার জন্য জরুরী পরীক্ষা ব্যাহত করেছে; যেই পরীক্ষা হয়তো একদিন মিলিয়ন খানেক মানুষকে কষ্ট এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাবে।
সূত্র
১- B. Chassy et al., “Global scientific community condemns the recent destruction of field trials of Golden Rice in the Philippines”; http://chn.ge/143PyHo (2013)
২- E. Mayo-Wilson et al., Br. Med. J. 343, d5094 (2011)
৩- G. Tang et al., Am. J. Clin. Nutr. 96, 658 (2012)
[ছবিগুলি মূল লেখায় ছিলনা]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।