"লেখার চেয়ে পড়ি বেশি, বলার চেয়ে শুনি বেশি"
আমি সিরাজগঞ্জের ছেলে। স্বভাবতই এলাকায় গেলে আঞ্চলিক ভাষায় কথা বলি। যা হোক, যা বলতে চাই- ৯০% (নব্য)শহুরে লোকজন তাদের আঞ্চলিক ভাষা নিয়ে হীনমন্যতায় ভোগে। আসলে ভাষার শুদ্ধ বা অশুদ্ধ বলে কিছু নাই। শুদ্ধ বলতে যা বুঝি, তা হল প্রমিত বাংলা।
এখন আমার প্রশ্ন হল, কার বা কোন্ এলাকার ভাষাকে প্রমিতকরণ করা হয়েছে। উপমহাদেশ ভাগের আগে পশ্চিমবঙ্গ (রাজধানী কলকাতা) পূর্ববঙ্গের (বাংলাদেশ) চেয়ে অনেক উন্নত ছিল। তারা ছিল ঐ সময় আমাদের মডেল, সেলেবৃটি টাইপের আর কি! তাই ওখানকার নদীয়া বা শান্তিপুরের লোকজনের ভাষা ও accent কে প্রমিত হিসাবে মেনে নেয়া হয়েছে। আজ যেমন আম্রিকা আর্থসামাজিক ভাবে সারাবিশ্বকে ডমিনেইট করছে, তাই ইংরেজি ভাষা আমাদের মডেল। ইংলিশ বলতে পারলে আমরা নিজেকে গর্বিত মনে করি, সেরকম আর কি!! আজ যদি চায়না আম্রিকার যায়গায় থাকতো, আমরা চায়নিজ ভাষা শেখার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়তাম।
আজকাল অনেকে চৈনিক ভাষা শিখসেও ব্যবসায়িক কারণে। তো ঐ সময়কার পশ্চিমবঙ্গ আমাদের কাছে সেরকম একটা ব্যাপার ছিল।
২০০৯ এ চেন্নাইতে আমার বড়ভাইয়ের চিকিৎসা করাতে গিয়ে নদীয়া জেলার এক পরিবারের সাথে আমার কথা হয়েছিল। তারা তাদের আঞ্চলিক ভাষায় মানে প্রমিত উচ্চারনে কথা বলতে ছিল। এটাতো তাদের আঞ্চলিক ভাষা, যা আমরা শুদ্ধ বা প্রমিত হিসেবে মেনে নিয়েছি।
কাজী নজরুল অথবা রবি ঠাকুরের বাড়ি যদি পশ্চিমবঙ্গ না হয়ে সিরাজগঞ্জে হতো, তাহলে অশুদ্ধ হতো ‘আমাদের’, আর শুদ্ধ হতো ‘আঙ্গরে’। বইতে লেখা হতো এভাবে- ‘আঙ্গরে বাড়িত্ আইসো’। ‘পেয়ারা’ হতো ‘হব্রি আম’। আর ‘খুঁজে আনা’ হতো ‘উট্কিয়ে আনা’ ব্লা ব্লা ব্লা.........।
আজ থেকে ১০০ বৎসর আগে বাংলাভাষা (বা যে কোন ভাষা) এমন ছিল না, এবং ১০০ বৎসর পরও এমন থাকবে না।
বাংলাভাষা হল অনেকগুলো ভাষার কক্টেল (সংমিশ্রণ)। প্রতিনিয়ত অন্য ভাষার শব্দাবলি আমাদের ভাষায় ঢুকে পরছে। রবি ঠাকুর, মধুসূধন দত্ত বা প্রমথ চৌধুরীর আমলে বাংলা ভাষা এমন ছিল না। তাঁরা উচ্চারন করত ‘খেয়েছিনু’ ‘গিয়েছিনু’ ‘তাহার কথা মনে পড়িলো’ ‘হস্তীটি দেখিতে মস্ত বৃহৎ’ ইত্যাদি। অপরদিকে, পৃথিবী থেকে অনেক ভাষা বিলুপ্ত হয়ে গেছে; আরও ভাষা বিলুপ্ত হওয়ার অপেক্ষায় আছে।
অর্থাৎ, লোকজনের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট ভাষার ব্যাবহার না থাকলে তা টিকে থাকবে না।
আমাদের পারিবারিক বা দৈনন্দিন জীবনে আমরা ভাষার ব্যবহার নিয়ে দোটানায় পরে যাচ্ছি। ফলস্বরূপ, আমাদের বাবা-মায়ের মুখের কথাকে আমরা মনে করছি অশুদ্ধ। অথচ, একুশ মানে মাথা নত না করা। নিজের স্বরূপ যা আছে তাই নিয়ে অন্যায়ের সামনে গর্জে ওঠা এবং বুক ফুলিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
আজ সময় এসেছে একুশের চেতনাকে ধারণ করার; আঞ্চলিক বাংলাভাষাকে যত্ন করে আগলিয়ে রাখার। তা না হলে আমাদের আঞ্চলিক ভাষাগুলো দ্রুতগতিতে তাঁর আপন সৌন্দর্যকে হারিয়ে ফেলবে। [শেষ]
---------------------------------------------------------------------------
[ সবধরণের বাংলা ভাষাভাষী পাঠকের জন্য লেখাটি প্রমিত (!!) বাংলায় লেখার চেষ্টা করা হয়েছে। এ লেখায় কিছু ইংরেজি শব্দ ইচ্ছে করেই ব্যবহার করা হয়েছে, কারনটা লেখাটাতেই বলে দেওয়া আছে। কোন তথ্যগত ভুল থাকলে সেটা নিজ দায়িত্বে রূপক অর্থে অনুবাদ করে নিবেন।
এ নিয়ে যুক্তিতর্ক স্বভাবতই সংগতহীন। লেখকের গ্রামের নামে ফেইসবুকে গ্রুপ আছে এবং সেখানে গ্রুপের সবাই মিলে আঞ্চলিক ভাষার প্র্যাকটিস করা হয়। কাজেই এটাকে স্রেফ লেখা হিসেবে না দেখার জন্য অনুরোধ করছি। ]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।