ভূমিকা
জাহীদ রেজা নূর
উপ-ফিচার সম্পাদক
প্রথম আলো
দীপংকরকে কোনোভাবেই অন্যের সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা যাবে না। এ সময়ের বেশিরভাগ তরুণের মধ্যে যে ধরনের সৃষ্টিছাড়া আশা-আকাঙ্ক্ষা, ভাবনা, স্বপ্ন থাকে, দীপংকরের মধ্যে সেগুলো কম দেখি। যেকোনো বিষয়ের তল পর্যন্ত যাওয়ার একটা চেষ্টা থাকে ওর। সরল পথে ওপরে ওঠার তাড়না দীপংকরের মধ্যে একেবারেই নেই। ওর সঙ্গে যেকোনো বিষয়ে কথা বলতে গেলেই মনে হয়, গভীর সমুদ্রের সঙ্গেই হচ্ছে কথোপকথন।
বিনয় ওকে ছেড়ে যায় না। অন্যরা কষ্ট পাবে কি না, সে ভাবনাকেই মূল্য দেয় সবার আগে। সব দিক ভেবে নিয়ে যখন কথা বলার মতো পরিসর মেলে, তখনই সে কথা বলে। বলার মধ্যেও থাকে ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি।
সেই কবে, সাত বছর তো হয়েই গেছে বোধহয়, প্রথম আলোয় প্রথম এসেছিল দীপংকর চন্দ।
কী বিষয়ে হতে পারে লেখালেখি, সেটা ঠিক করার একটা তাগিদ আমরা দুজনেই অনুভব করি। যখন জানা যায়, কাজের প্রয়োজনেই ওকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেতে হয়, তখন একটা বিষয় বেরিয়েও আসে। কাজের ফাঁকে ফাঁকে সেই অঞ্চলের কোনো বিশেষ দ্রষ্টব্য স্থান কিংবা ইতিহাসের সাক্ষী কোনো ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে ফেলে সে। তারপর বিষয়টি ওর অসাধারণ কাব্যিক ভাষায় বর্ণনা করার চেষ্টা করে দীপংকর। ‘চলতি পথে’ নামে ধারাবাহিকভাবে ফিচারগুলো ছাপা হতে থাকে প্রথম আলোর পাতায়।
দীপংকর চন্দের কাব্যময়তা ও ভাষা ব্যবহারে সংযম আমাকে মুগ্ধ করে। একটি শব্দ সুপ্রযুক্ত হলো কি না, তা নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাবতে থাকে ও। মনে হয়, এই শব্দটির জায়গায় আরও মনোমুগ্ধকর একটি শব্দ বসিয়ে না দিতে পারা পর্যন্ত ওর শান্তি নেই। ভাষার প্রতি এই দরদ আর বিষয়ের প্রতি এই নিষ্ঠা ওকে অনেকদূর নিয়ে যাবে।
এত কথা যে বললাম, তা সত্যি কি না, সেটা যাচাই করে দেখাও তো দরকার।
বেশিদূর যেতে হবে না, একটি লেখার প্রথম কয়েকটা বাক্য তুলে দিচ্ছি,
‘ঘন মেঘে আঁধার হওয়া আকাশ ছিল মাথার ওপর- বৃষ্টি হবার সম্ভাবনা ছিল ভীষণ- শেষ অবধি সম্ভাবনার অপমৃত্যু হলো না- দিকভাসানো বৃষ্টি এল-
ঘণ্টা খানেক পর বৃষ্টি থামলে মেঘ সরিয়ে আবার শুরু হলো সূর্যের উঁকিঝুঁকি- শুরু হলো আলোর নাচন- সেই আলোর নাচন দেখতে দেখতে ধলেশ্বরী পার হলাম আমরা। ’
কেউ হয়তো মনে করবেন, দেখে-শুনে বেছে বেছে এই বাক্যগুলো তুলে দিলাম। অন্যগুলো হয়তো এত উঁচু মানের কবিতা নয়। ঠিক আছে, তাহলে আরেকটি লেখা থেকে পড়ুন:
‘গুলিস্থান থেকে চলতে থাকা বাসটা বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরীর মতো দু’দুটো নদী পেরিয়ে হাঁসাড়া, ষোলোঘর পেছনে ফেলে যখন আমাদের নামিয়ে দিয়েছিল ছনপাড়া চৌরাস্তায়, আশ্বিনের আকাশে মেঘের আনাগোনা তখন মন্দ তো নয়ই, বরং তার সঙ্গে যোগ হয়েছিল খেয়ালী বাতাসের গদ্যছন্দ।
‘সুতরাং আসন্ন বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হবার একটা আবেগ এবং একটা আশঙ্কা যুগপৎ তৈরি হয়েছিল মনের ভেতর।
কিন্তু বাস্তবভাবনায় আবেগকে মনের ভেতর চেপে আশঙ্কাকে সর্বোচ্চ সম্মান প্রদর্শন করে নাগরিক শরীরটাকে রক্ষা করার এক প্রাণপণ চেষ্টায় রিকশায় চেপে বসলাম দ্রুত। ’
মনে হতে পারে, কাকতালীয়ভাবে দুটো লেখায়ই বৃষ্টির সম্ভাবনা বা আশঙ্কার প্রকাশ ঘটেছে। আসলে তা নয়। ওর ভালো লেখাগুলো আমাকেও যে ভালো কিছু পড়ার আনন্দে বৃষ্টির জলের মতোই ভিজিয়ে দিল, স্নান করিয়ে দিল, সেটা জানানোর জন্যই এত আয়োজন।
আমি জানি, দীপংকর চন্দ’র এই লেখাগুলোকে মোটা দাগে বিচার করা যায় না।
ভালো লেখার উদাহরণ হিসেবে এই লেখাগুলো নবীন লেখকদের সৃজনশীলতা বিকাশে সহায়ক হবে- এটা আমার ধারণা নয়, বিশ্বাস।
এই বিশ্বাস আছে বলেই দীপংকরের প্রতি আমার এই পক্ষপাতিত্ব। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।