আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মওলানা ভাসানী এবং পোড়াবাড়ির চমচম (দ্বিতীয় পর্ব)


(ছবি ইন্টারনেট থেকে)

শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

ইটের হেরিমন করা এবরো থেবরো রাস্তা। রিক্সার অনবরত ঝাঁকিতে কোমরসহ পুরো শরীরের অবস্থা কাহিল। ঘটর ঘটর করতে করতে রিক্সা সোজা পশ্চিম দিকে যাচ্ছে। ধরলা নদীর কিছু পূর্বে থাকতেই দক্ষিণ দিকে মোড় নিল। মোড় নেয়ায় আমি রিক্সাওয়ালাকে জিজ্ঞেস করলাম, চাড়াবাড়ি এখান থেকে কতদুর?
রিক্সওয়ালা হাত উঁচিয়ে পশ্চিম দিকে দেখিয়ে বলল, ওই তো দেখা যায়, ওইডাই চাড়াবাড়ি।


তার কথায় আমি পশ্চিম দিকে মুখ করে চাড়াবাড়ি দেখছি। রিক্সাওয়ালা আমার দেখার আগ্রহ দেখে নিজের থেকেই বলল, বাপ চাচার কাছে গল্প হুনছি, একসময় নাকি চাড়াবাড়ি ঘাটে জাহাজ ভিড়ছে। এখন নদী মইরা বালুচর পরছে। নদীটদি আর কিচ্ছু নাই। জাহাজ তো দুরের কথা এখন নৌকাও ভিড়ে না।


আমি রিক্সাওয়ালার কথায় ভাল মন্দ কিছু বললাম না। রিক্সা ইটের রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় চলছে। পূর্ব দিকে ফাঁকা মাঠ। পশ্চিম পার্শ্বে মরা নদী। বালুচর পরে নদীর চিহ্ণ বিলীন হওয়ার অবস্থা।

সামান্য একটু রেখ আছে। কাঁচা রাস্তায় চলতে চলতে রিক্সওয়ালা আমাকে জিজ্ঞেস করল, ভাইয়ের বাড়ি কোন জায়গায়?
-- ঢাকা থেকে এসেছি।
-- আপনি তাইলে ঢাকা থাকেন?
-- হা।
-- আপনি এর আগে কোন দিন টাঙ্গাইল আসেন নাই।
-- আসছি তবে পোড়াবাড়ি আসি নাই।


-- আপনি কি পোড়াবাড়ির চমচম খাইছেন?
-- সে তো অনেক খেয়েছি।
-- খাইছেন তবে আসল চমচম খান নাই।
-- কেন?
-- আসল পোড়াবাড়ির চমচম পাইবেন কইত্থিকা। আসল ঘোষেরা তো বেশির ভাগ মইরা গ্যাছে। বাকিরা ইন্ডিয়া চইলা গ্যাছে, এখন মাত্র দুইটা ঘোষ হাটে আছে।

এই দুই ঘোষের মধ্যে মদন লাল ঘোষ যে আছে, মওলানা ভাসানী পোড়াবাড়ি আইলেই এই দোকানে বইসা মিস্টি খাইতো।
ভাসানীর মিস্টি খাওয়ার কথা শুনে আমি আগ্রহ নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, মদন লাল ঘোষের দোকান কি এখনও আছে?
রিক্সাওয়ালা আমার আগ্রহমুলক পশ্নের জবাবে মৃদু হাসি দিয়ে বলল, আছে, আমি আপনারে হেই দোকানেই নিয়া যামু। চমচম তো ম্যালা খাইছেন। আইজকা খায়া দেইহেন আসল চমচম আর নকল চমচম কেমুন লাগে।
আমি বললাম, সারা বাংলাদেশে যে পোড়াবাড়ির চমচম পাওয়া যায় সেগুলা কি আসল না?
রিক্সাওয়ালা আমার কথা তুচ্ছ তাচ্ছিল্য ভাব করে বলল, হেইগুলা কি চমচম নাকি! দুধের ছানা গোল গোল চ্যাপ্টা কইরা চিনির সিরার মধ্যে চুবাইলেই চমচম হইল! চমচম বানানের টেকনিক এই দুই ঘোষ ছাড়া আর কেউ জানে না।

আর সামন্য একটু চমচমের কাজ শিখছে টাঙ্গাইলের পাঁচ আনি বাজারের চার পাঁচটা ঘোষ। এ ছাড়া যত ঘোষ আছে, তারা হুদা চিনির সিরার মধ্যে ছানা চুবায়া চমচম বানায়।

রিক্সাওয়ালার সাথে কথা বলতে বলতে একসময় হাটের মাঝে চলে এলাম। রিক্সা সোজা মদন লাল ঘোষের মিস্টির দোকানের সামনে গিয়ে থেমে গেল। আমি কিছু বলার আগেই রিক্সাওয়ালা বলল, ভাই এইডাই মদন লাল ঘোষের দোকান।

মদন লাল ঘোষের নাম শুনে আমি তাড়াতাড়ি রিক্স থেকে নেমে গেলাম। দোকানটি তেমন জাঁকজমক নয়। গ্রামের হাটের সাদামাটা একটি মিস্টির দোকান। টিনের ঘর টিনের বেড়া। মাঝখানে কিছু অল্পদামি কাঠের চেয়ার টেবিল।

তাও আবার অনেকগুলি নড়বড় করে। ইটের কোন বালাই নেই। মাটির মেঝে। তবে ঝাড়– দিয়ে পরিস্কার করা। দুই পাশে বেড়ার অনেকখানি খুলে ফাঁকা করে দেয়ায় পর্যাপ্ত পরিমাণ আলো বাতাস আছে।

সবগুলো চেয়ার টেবিল ফাঁকা। আমি ছাড়া আর কোন খরিদ্দার চোখে পড়ল না। রিক্সাওয়ালা নিজেও রিক্সা থেকে নেমে আমার সাথে সাথে দোকানে ঢুকল। আমাকে একটি ফাঁকা টেবিল দেখিয়ে বসতে বলল। আমি চেয়ারে বসতেই সে সোজা দোকানের ক্যাশে বসে থাকা অল্প বয়সী কিশোরকে বলল, এই গ্যাদা, এই ভাই ঢাকা থিকা আইছে, ভাইরে ভাল দেইহা চমচম দে।

খায়া জানি ঢাকায় যায়া গল্প করে।
রিক্সওয়ালার কথা শুনে ছেলেটি চেয়ার থেকে উঠে কড়াই থেকে দু’টি বড় বড় চমচম টিনের প্লেটে করে এনে দিল। বিশাল সাইজ। একেকটি এক পোয়ার কম নয়। ছোট চামচ দিয়ে দু’টি মিস্টি খেয়ে পেট ভরল না বটে কিন্তুু মুখ মেরে গেল।

আর কোন মিস্টিই খেতে ইচ্ছে হলো না। দু’টি মিস্টর দাম নিল বিশ টাকা। নিবে না কেন? এতোবড় ঢাউস সাইজের মিস্টি এর আগে কখনও দেখিনি। পরে হিসাব করে দেখি কমই নিয়েছে। কারণ দু’টি মিস্টি কম করে হলেও আধা সের হবে।

ঢাকার তুলনায় অনেক কম দাম।
মিস্টি খেয়ে পুরো এক গ্লাস পানি খেয়ে উঠে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছি এমন সময় পাকা চুল দাড়িওয়ালা সত্তরোর্ধ্ব এক বৃদ্ধ এসে আমার পাশের টেবিলে চেয়ারে বসল। আমাকে দেখে জিজ্ঞেস করল, বাবাজি আপনে কার বাড়ি আইছেন?
আমি বললাম, আমি কারো বাড়ি আসি নাই, এমনি বেড়াতে এসেছি।
বৃদ্ধ আশ্চার্য হয়ে বলল, কারো বাড়ি আসেন নাই, এমনি এমনি বেড়াইতে আইছেন। এই গাঁও গেরামে কেউ এমনি এমনি বেড়াইতে আইসে! এইডা কেমুন কথা কইলেন!
আমি বৃদ্ধের সন্দেহমূলক প্যাচানো কথা শুনে তাড়াতাড়ি বললাম, চাচা এমনি এমনি মানে, পোড়াবাড়ির চমচম খাওয়ার জন্য এসেছি।


পোড়াবাড়ির চমচম খেতে এসেছি শুনে বৃদ্ধ টেবিলে একটা থাপ্পার দিয়ে হো হো করে হেসে বলল, এইবার না বুঝবার পারছি। তাই তো কই, কেউ কি এমনি এমনি গাঁও গেরামে আইসে। কোন না কোন উদ্দেশ্য থাকে। তা বাবাজি মিস্টি খাইছেন?
আমি বললাম, হা চাচা, খেয়েছি।
বৃদ্ধ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, তা মিস্টি কেমুন লাগল?
আমি হাসি হাসি ভাব করে বললাম, হা চাচা, খুব ভাল লাগল।


বৃদ্ধ হাসি হাসি মুখে বলল, আরে বাবা, এই দোকানের মিস্টি খারাপ কইবার পারবা না। এই দোকানের মিস্টি ভাসানী খাইছে, আর পি সাহা খাইছে, পি সি সরকার খাইছে, সরোয়ার্দী খাইছে, শেরে বাংলা খাইছে বলেই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাবাজি কইলে বিশ্বাস করবেন কিনা জানি না, শুধু চমচমের কারণে জমিদার ওয়াজেদ আলী খান পন্নী, নবাব আলী চৌধুরী, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, প্রমথ নাথ চৌধুরীর মত লোকেরাও এই হাটে আইসা মিস্টি খায়া গ্যাছে। অনেকরেই আমি নিজের চোখে দেখছি।
বৃদ্ধ আরো জানালো, পোড়াবাড়ির হাটে প্রথম চমচম তৈরী করেন দশরথ গৌড়। তিনি আসাম থেকে এসেছিলেন।

তার মিস্টি লঞ্চ স্টীমার যোগে ভারতবর্ষের অনেক জায়গায় চলে যেত। বৃদ্ধের কথা শুনে খুব ভাল লাগল। বৃদ্ধ পুরানো দিনের অনেক কাহিনী শোনাল। এই এলাকায় নাকি কুছুমুদ্ধি নামে এক কুখ্যাত ডাকাত ছিল। সবাই তাকে কইচা ডাকাত নামে ডাকত।

সে এতো গুনমন্ত্র জানতো যে, দারগা পুলিশ তাকে ধরে নিয়ে রাখতে পারতো না। হাতে হ্যান্ডকাপ লাগিয়ে থানা হাজতে রেখে দিলে ইঁদুর বিড়াল হয়ে পুলিশের চোখে ধাঁ ধাঁ লাগিয়ে কোন ফাঁকে যে বেড় হয়ে যেত কেউ বলতেই পারতো না।
(চলবে)

ভাসানীর বেগুন টাল এবং পোড়াবাড়ির চমচম।

সোর্স: http://prothom-aloblog.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.