আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ধর্মের চাদরে অদৃশ্য মওলানা ভাসানি

এখানে দিন-রাত্রি সমান মওলানা ভাসানীর পরিচয় নতুন করে দেবার খুব একটা প্রয়োজন নেই বরং দেয়াটাই বোকামী। কারণ তার সম্পর্কে জানাশোনা লোকের অভাব এই বাংলায় নেই। তিনি যেমন মওলানা ছিলেন তেমনি ছিলেন মজলুমেরও নেতা। তার সুনির্দিষ্ট একটি রাজনৈতিক জীবন ও আদর্শ ছিল এবং তার মানসপটে আঁকা ছিল ভবিষ্যত বাংলাদেশের নীল নকশা। নীল নকশা শব্দটি যদিও আমরা বেশ নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করি কিন্তু এখানে শব্দটি আমি ইতিবাচক ও বহৎ অর্থেই ব্যবহার করেছি।

কারণ বৃটিশ ভারত থেকে শুরু করে পাকিস্তান হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে তিনি ছিলেন একটি উজ্জ্বল নক্ষত্র। তিনি যেমন পাকিস্তানের রাজনীতিকে নিয়ন্ত্রণ করেছেন তেমনি স্বাধীন বাংলাদেশেও বিস্তার করে গেছেন গভীর রাজনৈতিক প্রভাব। অবশ্য স্বাধীন দেশে বিচরণের খুব একটা সময় মৃত্যু তাকে দেয়নি। (আওয়ামী লীগের ইতিহাস, আবু আল সাইদ, পৃষ্ঠা: ৬৬) মওলানা ভাসানী একজন উঁচু মাপের নেতা হলেও তারও কিছু নেতিবাচক দিক ইতিহাসে স্পষ্ট হয়ে আছে। আওয়ামী লীগ গঠন, শেখ মুজিবের সাথে দ্বন্দ্ব এবং শেষ পর্যন্ত নিজ প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন সৃষ্টিতে তিনি নিজেও যথেষ্ট ভূমিকা রেখেছিলেন।

হতে পারে নিজ বিবেচনায় কিংবা হতে পারে তাকে ঘিরে থাকা কথিত তাত্ত্বিকদের প্ররোচনায়। তাছাড়া ভাসানী সম্পর্কে এ কথাও বলা যায়, তার এক ধরণের রহস্যময় অবহেলার কারণেই শেখ মুজিবর রহমান আওয়ামী লীগের কান্ডারি হতে উঠেছিলেন। কারণ শেখ মুজিব যখন পূর্ব পাকিস্তানের জনপদ থেকে জনপদে ঘুরে বেড়িয়েছেন সে দিনগুলোতে মওলানা ভাসানী অজানা কারণে অবস্থান করেছেন বিদেশে। ১৯৫৫ সালের নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা পিছিয়ে দিয়ে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর দাওয়াত কবুল করেছিলেন করাচিতে অনুষ্ঠিত কাশ্মির সংক্রান্ত একটি আলোচনা সভার। ভাসানীর এমন সিন্ধান্তের প্রতিবাদ করে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ইত্তেফাকে লিখেছিলেন, ‘নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির মিটিং-এ যাওয়ার চেয়ে সর্বদলীয় কাশ্মীর সংক্রান্ত সংলাপ কোন ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ নয়।

’ তাছাড়া শেখ মুজিবর রহমানের সাথে তার যে দ্বন্দ্ব চলছিল তা এক অর্থে শেখ মুজিবর রহমান নিজেই মিটিয়ে ফেলার সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। ১৯৫৭ সালে মুজিব নিজে সন্তোষ গিয়ে ভাসানীর সাথে কথা বলেন এবং যুক্ত বিবৃতি প্রদান করে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি গঠনের ব্যপারে ঐকমত্যে পৌঁছেন। কিন্তু এই সিদ্ধান্ত থেকে বের হয়ে মওলানা ভাসানী নতুন বিবৃতি দিয়ে এককভাবে কমিটি সংক্রান্ত নতুন সিদ্ধান্ত ঘোষনা করেছিলেন। যা আওয়ামী লীগকে ক্ষত-বিক্ষত করে প্রচন্ডভাবে। যা শেষ পর্যন্ত সমাপ্ত হয় ভাঙনের মধ্য দিয়ে।

(আওয়ামী লীগের ইতিহাস, আবু আল সাইদ, পৃষ্ঠা: ৮৪-৮৫) যাই হোক, জীবিত মওলানা ভাসানী সে সময় আবৃত ছিলেন বামপন্থী তাত্ত্বিকদের দ্বারা। এসব তাত্ত্বিকেরাই তাকে বুঝাতেন, পরামর্শ দিতেন এবং মূলত তাদের কারণেই তিনি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলেন মূল ধারার রাজনীতি থেকে। তার বামপন্থী উপদেষ্টারা নাস্তিক্যবাদী হলেও ভাসানীর মধ্যে আধ্যাত্তিকতাও ছিলো। ধর্মের প্রতি তিনি ছিলেন অনুরক্ত। লোকে বলে, তার মধ্যে কিছু কিছু অলৌকিক নিদর্শনও নাকি বিভিন্ন সময় লক্ষ করা গেছে।

মানুষ অলৌকিকতা পছন্দ করে। আর এই মেকি পছন্দই দিনে দিনে গ্রাস করেছে ভাসানীকে, তার রাজনীতিকে। বাস্তবতায় মওলানা ভাসানী এখন আর কোন রাজনীতিবিদ নন। জনতা ও তার এ যুগের কিছু অনুসারী তাকে পীর বানিয়ে ছেড়েছে। মৃত মওলানা ভাসানী এখন হয়ে উঠেছেন পীর সাহেব; তাদের ভাষায় হুজুর।

ভাসানীর মৃত্যু দিবস ছাড়া অন্য সময়ে কেউ যদি টাঙ্গাইলে যান তবে দেখবেন ভাসানী কোন রাজনৈতিক নেতার নাম নয়, খুঁজে পাবেন না তার রাজনৈতিক কোন দর্শন। মনে হবে, মওলানা ভাসানী একজন আদর্শ পীর বাবা। তার ওরশ হয়, তার দাড়ি-টুপিওয়ালা কিছু ভক্ত আছে, যাদের মধ্যে ধর্মের লেশ মাত্র নেই আছে শুধু পীর ভাসানীর (!) প্রতি অগাধ অনুরাগ। এই সব ভক্তদের মুড়ে দেওয়া চাদরে প্রকৃত ভাসানী আজ তিরোহিত। দুদিন আগে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও লেখক ফরহাদ মাজহার এসেছিলেন কাগমারীতে।

ভাসানী, তার রাজনীতি ও ধর্মের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে ফরহাদ মাজহার খুব চমৎকার ভাষণ দিয়েছেন। পরে আমি তাকে ব্যক্তিগতভাবে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ধর্মের চাদরে ভাসানীকে আবৃত করা নিয়ে আপনার অভিমত কী? তিনি বলেছিলেন, এ সমস্যা দূর করতে টাঙ্গাইলবাসীকেই অগ্রনী ভূমিকা রাখতে হবে। কারণ সমস্যাটার সূত্রপাত এখান থেকেই। তাই টাঙ্গাইলবাসীদের প্রতি আহ্বান, আসুন মওলানা ভাসানীকে ধর্মীয় নেতা হিসেবে নয় তুলে ধরি রাজনৈতিক নেতা হিসেবে। আমাদের মনে রাখা উচিত, ভাসানী একজন কিংবদন্তি।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.