আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

পুরনো বই এর আলাপঃ ঊনিশ শতকে ঢাকার থিয়েটার

বইমেলায় বাংলা একাডেমীর উঠোনের অংশে এবার ভিড় কম ছিলো, বেশিরভাগই সরকারী প্রতিষ্ঠানের স্টল।
বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর স্টলে এসে বই দেখতে গিয়ে চোখে পড়লো ছেঁড়াখোঁড়া বেগুনী রঙা একটা বই, 'ঊনিশ শতকে ঢাকার থিয়েটার'
ছেঁড়াখোঁড়া হলেও, প্রচ্ছদের চেহারা পছন্দ হওয়ায় আর শাড়ির রঙের সাথে মিলে যাওয়ায়, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে সেই ছেঁড়া বই এর মালিকানা প্রাপ্ত হলাম।
বই খুলে দেখি, মূল্যঃ পনের টাকা, প্রকাশকালঃ জুন, ১৯৭৯।

মুনতাসীর মামুনের লেখার সাথে প্রথম পরিচয় ক্লাস সিক্স-সেভেনে থাকতে, ছোটচাচার আলমারি থেকে বহু অনুনয়-বিনয়ের পর ধার পাওয়া গিয়েছিল, 'ঢাকা স্মৃতি-বিস্মৃতির নগরী (প্রথম খন্ড)'।


গল্পের বই নয়, ঢাকার নানান রাস্তা, পাড়া-মহল্লা, পুরনো বাড়ির আদি নাম, নামমকরণের ইতিহাস, আরো হাবিজাবি হিস্ট্রি আছে বই এর ভেতর। এ বই পড়েই ঢাকা শহরের ওপর অধিকার বোধ জন্মেছিল খুব! (আমি তো জানি নারিন্দার নাম এসেছে 'নারায়ণ দিয়া' থেকে, যার মানে ঈশ্বরের দ্বীপ, নারিন্দার কোন ক্লাস সিক্সের পড়ুয়া কি এটা জানে? হুঁহু!)
এক বই এর গল্প করতে এসে ডিরেইলড হয়ে আরেক বই এর গল্প শুরু করেছি। ফিরে আসি এ বইতে।
বই এর পরিচিতি তে তৎকালীন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীর মহাপরিচালক সৈয়দ জিল্লুর রহমান সাহেব মুনতাসীর মামুনকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছেন 'তরুণ গবেষক' হিসেবে। এখনকার সাদা গোঁফ সম্বলিত চেহারার সাথে ৭৯ সনের 'তরুণ' বিশেষণ তুলনা করে মজা লাগলো।


ঢাকা সম্পর্কে তরুণ গবেষক মুনতাসীর মামুন ইতিমধ্যে একনিষ্ঠ সাধনার দ্বারা বহু বিচিত্র সংবাদ সংগ্রহ করেছেন। তাঁর দৃষ্টিপথে শতবর্ষের ঢাকার ক্ষদ্র, নগণ্য ঘটনার যে মনোমুগ্ধকর চিত্র সম্মিলিন তা আমাদের পাঠের নিমিত্তেও সুখকর।


যে সময়ে বইটা লেখা, সে সময়ে ঢাকায় থিয়েটার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল অনেক। সেটারও ইঙ্গিত আছে লেখকের ভূমিকায়ঃ
স্বাধীনতার পর ঢাকায় নতুন উদ্যমে আবার থিয়েটার চর্চা শুরু হয়েছে। এবং বর্তমানে, বলা যেতে পারে, বিনোদন মাধ্যম হিসেবে থিয়েটার আবার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

এই থিয়েটার চর্চার পরিপ্রেক্ষিতেই মনে প্রশ্ন জেগেছে, উনিশ শতকে কলকাতায় যখন থিয়েটার নিয়ে হৈচৈ চলেছে তখন ঢাকা কি একেবারে নিশ্চুপ ছিল? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করার জন্যে উনিশ শতকের ঢাকার থিয়েটার সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ শুরু করি।


১৯৭৯ খুব দূরের সময় নয়। কিন্তু তখনের সাথেই এখনকার সময়ের বিস্তর পার্থক্য। স্বাধীনতার পর ঢাকায় থিয়েটার আসলেই নতুন জীবন পেয়েছিল, চমৎকার সব নাটক লেখা হয়েছিল, সেসব মঞ্চে অভিনীত হতো।
আর এখন এত রকম এন্টারটেইনমেন্টের মাঝে খুব অল্প লোকই টিকেট কেটে মঞ্চ-নাটক দেখতে যাবার আগ্রহ বোধ করে।


বই এর শুরুর কয়েক পাতা পড়ে বুঝলাম উনিশ শতকের ঢাকা থাকার জন্য মোটেও সুবিধার জায়গা ছিল না। ঘন জঙ্গল, ময়লা আবর্জনা, সুপেয় পানির অভাব, সব মিলে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা। কিন্তু একটা কথা জেনে সেই উনিশ শতকের ঢাকাকেই ভালো লেগে গেলঃ
কর্নেল ডেভিডসন নামে এক ইংরেজ ইঞ্জিনিয়ার ১৮৪০ এর দিকে এসেছিলেন ঢাকায়। তাঁর রোজনামচায় তিনি আশ্চর্য হয়ে লিখেছেন, দিনে রাত্রে যে কোন সময় ঢাকায় বেহালার শব্দ শোনা যায়। আর বেহালাগুলিও খুব সুন্দর।

কিন্তু দামে এতো সস্তা! মাত্র দুটাকায় একটি বেহালা পাওয়া যায়। তারপর তিনি উপসংহারে পৌঁছেছেন এ ভাবেঃ বাঙালীরা আসলেও 'মিউজিকাল পিপল'।


এমন বেহালা বাদন এখন কই পাই। গাড়ির হর্ন কে যদি মিউজিক ধরা হয়, তাহলে এখনো আমরা মিউজিকাল পিপলই বটে।
ঊনিশ শতকে ঢাকার থিয়েটার সম্পর্কে খোঁজ করতে গিয়ে লেখক দেখলেন এ সম্পর্কিত প্রায় কোন তথ্যই কোথাও লিপিবদ্ধ নেই।

সে সময়ের পত্রপত্রিকাও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। কিন্তু পরে খুঁজতে খুঁজতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারে তখন প্রকাশিত 'ঢাকা প্রকাশ' এর ১৮৬৩-১৯০০ সন পর্যন্ত অনেকগুলো সংখ্যা সহ একটা ফাইল উনি খুঁজে পান। সেই পত্রিকা থেকে পাওয়া সংবাদের উপর ভিত্তি করেই এ বই লেখা।
একটা মাত্র পত্রিকা আর এখান ওখান থেকে পাওয়া টুকরো-টাকরা খবরের উপর ভিত্তি করে তখনকার থিয়েটারের অবস্থার একটা নিখুঁত চিত্র যে পাওয়া যাবে না সেটা লেখক নিজেও জানেন এবং এই সীমাবদ্ধতার কথা বইয়ের ভূমিকাতেই তিনি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এছাড়া আর কোন তথ্য যেহেতু নেই, তাই নাই মামার চেয়ে কানা মামা পেয়েই খুশী থাকতে হচ্ছে।


একবসাতেই পড়া শেষ হোল।
যা বুঝলাম, সে সময়ে থিয়েটারের শুরু হয়েছিল মধ্যবিত্তের বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে। উচ্চ আর নিম্নবিত্ত মানুষের বিনোদনের রকম ছিল একটু ভিন্ন ঃ
ঊনিশ শতকের ঢাকার মানুষদের প্রধান বিনোদন ছিল ঘোড়দৌড় এবং বারবনিতা গৃহ


এ সময় সুস্থ্য একরকম বিনোদনের উৎস হিসেবে থিয়েটারের প্রতি মধ্যবিত্তদের মাঝে আগ্রহ জন্মে। শুরুর দিকে বেশিরভাগ নাটক মঞ্চস্থ করেছিল সৌখীন নাট্যদলগুলো । পেশাদার অভিনেতা, নাট্যদলের আবির্ভাব ঘটে আরো বহু পরে।


আরো একটা তথ্য জেনে মজা লেগেছে। শুরুতে থিয়েটারে নারী অভিনেত্রী ছিলই না, পুরুষেরাই নারী ভূমিকায় অভিনয় করতেন। পরে আস্তে ধীরে নারীরা থিয়েটারে অভিনয়ে আসেন ঠিকই, কিন্তু তৎকালীন সময়ে গৃহবধূরা তো আর থিয়েটারে অভিনয় করতে সুযোগ পেতেন না, অভিনেত্রী হিসেবে তাই আনতে হোতো বারাঙ্গনাদের। এটা আবার অনেকেরই পছন্দ হোতো না। তখনকার ব্রাহ্ম সমাজ, মান রক্ষা করতে ছাত্রদের নিয়ে তাই থিয়েটার বিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলেছিল।

আন্দোলন গড়ে তুলতেই পারেন, ভালো কথা। কিন্তু আন্দোলনের সপক্ষে যুক্তির নমুনা পড়ে হাসতে হাসতে বিষম খেলামঃ
তাহাদের (ব্রাহ্মদের) মতে দুইতিনঘন্টা সমানে মেয়ে সংযুক্ত অভিনয় দেখিলে মানুষের মন উত্তেজিত হয়, সুতরাং সেরূপ অভিনয় একেবারে না দেখাই উচিত।


পড়ে বুঝলাম, ধর্ম-বর্ণ-কাল নির্বিশেষে, একমাত্র তেঁতুল-তত্বই যুগে যুগে অক্ষয় হয়ে টিকে থাকবে।
তেঁতুল তত্বের মত, আরো একটা জিনিসও দেখলাম কালোত্তীর্ণ।
বই এর দ্বিতীয়াংশে, ঢাকা-প্রকাশের কিছু খবর হুবহু তুলে দেয়া হয়েছে।

সেখানে দেখি সম্পাদক সমীপে চিঠি লেখা হয়েছে। কয়েকটা চিঠির মূল-বক্তব্য এই, ঢাকা প্রকাশের মত এমন জ্ঞানী-গুণীদের পত্রিকা, এত কিছু নিয়ে লেখে, অথচ এই যে থিয়েটারে মহিলা অভিনেত্রী দিয়ে অভিনয় করিয়ে সমাজের ধ্বংশ ডেকে আনা হচ্ছে, কই, সেটা নিয়ে তো তেমন কোন লেখা এলো না?!
পড়েই দিব্যদৃষ্টিতে অনলাইন নিউজপেপারের মন্তব্য সেকশন দেখতে পেলাম।
আমরা হয়তো এখন ফেইসবুকে বা পত্রিকার অনলাইন ভার্সনে উঠেছি, কিন্তু মন-মানসিকতা ঢাকা-প্রকাশের সম্পাদক বরাবর চিঠির কলাম থেকে খুব একটা সরতে পারে নি। (দেঁতো হাসি)
আজকের মত, বই নিয়ে গল্প এখানেই সমাপিত।

***



সোর্স: http://www.sachalayatan.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।