সরকারবিরোধী আন্দোলন নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়েছে বিএনপি। সারা দেশের নেতা-কর্মীরা দলীয় হাইকমান্ডের সঙ্গে একাত্দতা পোষণ করলেও ঢাকার বেশির ভাগ নেতাই সরকারবিরোধী আন্দোলনের বিপক্ষে। রাজধানী ঢাকায় যে কোনো কর্মসূচি পালনে তাদের শতভাগ অনীহা। পরীক্ষাবিহীন লেখাপড়ার মতোই তারা শুধু গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবি দখল করে কোনো রকমের আন্দোলন ছাড়াই দিন কাটাতে চান। খুব বেশি প্রয়োজন হলে ছোটোখাট দু'একটি সভা-সমাবেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে চান রাজপথের আন্দোলন।
সেটাও পুলিশের অনুমতি সাপেক্ষে। তবে ঢাকার বাইরে ভ্রমণেই আগ্রহ বেশি তাদের। কর্মীরোষের ভয়ে ব্যক্তিগত সফরে যেতে না পেরে চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে সফরে যেতে চান তারা। তাও আবার আওয়ামী লীগ সমর্থন অধ্যুষিত এলাকা সফরে আগ্রহ বেশি তাদের। ফলে ঢাকার বাইরে বেগম খালেদা জিয়ার সাম্প্রতিক জনসভাগুলোর স্থান নির্ধারণসহ সফরসূচি সেভাবেই সাজাচ্ছেন তারা।
আর আন্দোলনের কথা এলেই জেলা-উপজেলাকে বিকেন্দ্রীকরণ করছেন তারা। কোনো নেতা-কর্মী হতাহত, গুম কিংবা বড় ধরনের কোনো বিপর্যয়ে পড়লে শুধু সংশ্লিষ্ট এলাকায় হরতাল বা বিক্ষোভ কর্মসূচির পরামর্শ দিচ্ছেন। অবস্থাটা এরকম যে, মরলে গ্রামগঞ্জের মানুষই মরুক। তার বিপরীতে ঢাকাকে যে কোনো মূল্যে আন্দোলনমুক্ত রেখে বক্তৃতা-বিবৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রাখতে বদ্ধপরিকর তারা।
অন্যদিকে সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকার বাইরে বিভাগ থেকে শুরু করে জেলা ও উপজেলা এমনকি ইউনিয়ন, ওয়ার্ড পর্যন্ত নেতা-কর্মীরা সরকারবিরোধী ব্যাপক আন্দোলনের পক্ষে।
৫ জানুয়ারির নির্বাচন এবং আওয়ামী লীগ সরকারকে প্রকারান্তরে ঢাকার নেতারা মেনে নিলেও তৃণমূল বিএনপি কিছুতেই মানতে পারেনি। সরকারের কর্মকাণ্ডে অতিষ্ঠ তারা। কারণ নির্বাচন-পূর্ব ও পরবর্তী সময়ে ঢাকার বাইরের নেতা-কর্মীরাই ভুক্তভোগী হয়েছেন। ২৯ ডিসেম্বরও 'মার্চ ফর ডেমোক্রেসি' কর্মসূচিতে তারাই ঢাকায় এসেছিলেন। কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতাদের কারণে তারা কেউ রাজপথে নামতে না পেরে বাড়িঘরে ফিরে গেছেন।
খালেদা জিয়ার পরিসংখ্যান অনুযায়ী সাম্প্রতিক আন্দোলনে তার দলের আড়াই শতাধিক নেতা-কর্মী জীবন দিয়েছেন। কিন্তু রাজপথে একজন নেতা-কর্মী জীবন দেওয়া তো দূরের কথা, নূ্যনতম অাঁচড়টি পর্যন্ত লাগেনি কারও গায়ে। কারণ তারা কেউ রাজপথেই নামেননি। সবাই যার যার মতো আত্দগোপনে ছিলেন। এমনকি দলের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতাকেও বোরকা পরে আদালতে হাজিরা দিতে যেতে দেখা গেছে।
রাজপথে নামার কথা বললেই শীর্ষস্থানীয় এসব নেতার ভাষ্য হলো- দলীয় চেয়ারপারসনই নাকি তাদের আন্দোলনের কর্মসূচি দিয়ে পালিয়ে থাকতে বলেছেন। এক্ষেত্রে তৃণমূল নেতা-কর্মীদের প্রশ্ন হলো- চেয়ারপারসন কী তাহলে কেন্দ্রীয় নেতাদের একরকম আর তৃণমূলের জন্য আরেক রকম নির্দেশ দিয়েছেন?
তৃণমূল নেতারা বলছেন, আমরা চেয়ারপারসনের সিদ্ধান্তের দিকে তাকিয়ে আছি। নির্বাচনের পরে দুই মাস পেরিয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ঢাকাভিত্তিক কোনো কেন্দ্রীয় নেতা প্রাণহানির শিকার নেতা-কর্মীদের বাড়িঘর কিংবা এলাকায় গিয়ে এতটুকু সান্ত্বনা দেননি। উপরন্তু বেগম খালেদা জিয়ার আসন্ন ঢাকার বাইরের সফরসূচিগুলো পর্যন্ত সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, কঙ্বাজার কিংবা পাবনা-সিরাজগঞ্জের মতো অধিক ভুক্তভোগী এলাকায় নির্ধারণ করা হচ্ছে না।
তবে খালেদা জিয়ার এ সফরসূচি কিংবা ঢাকার বাইরের এসব জনসভার স্থান নির্ধারণে তার গুলশান কার্যালয়ের কতিপয় কর্মকর্তা ও আমলা নেতারাই বেশি ভূমিকা রাখছেন বলে জানা যায়। আন্দোলন নিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক গুলশান কার্যালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেন, এখন আর আন্দোলন করার প্রয়োজন নেই। অন্তত আরও দুই-তিনটি বছর মানুষ আর হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচি দেখতে চায় না। মানুষ পরিবর্তন চায়। তারা সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে দাবি আদায় দেখতে চায়।
সহিংসতা নয়। সহিংসতা অব্যাহত থাকলে সাধারণ মানুষের মতো আমাদেরও আয়রোজগার কমে যায়। তাছাড়া ইউরোপ-আমেরিকার মতো দাতা দেশগুলোও এ ধরনের সহিংস আন্দোলন আর দেখতে চায় না।
সূত্র জানায়, গত শনিবার রাজবাড়ীর জনসভায় খালেদা জিয়া উপজেলা নির্বাচনের পর আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণার কথা বলার পর থেকেই ঢাকার অনেক নেতার ঘুম হারাম হয়ে গেছে। তারা এখন উঠেপড়ে লেগেছেন কীভাবে আন্দোলন-কর্মসূচি ঘোষণার বিষয়টি দলনেত্রীর মাথা থেকে দূর করে নিজেদের অর্থসম্পদ বজায় রেখে সরকারের সঙ্গে মিলেঝিলে আরও পাঁচটি বছর পার করা যায়।
অন্যদিকে ঢাকার বাইরে বিএনপি নেতা-কর্মীদের প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে ভয় আর আতঙ্কে। প্রতিদিনই দেশের কোনো না কোনো এলাকায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে তথাকথিত 'বন্দুকযুদ্ধের' নামে নেতা-কর্মী নিহত হচ্ছেন। কিন্তু কেন্দ্র থেকে নূ্যনতম কোনো বিক্ষোভ কর্মসূচিও নেওয়া হয় না। সম্প্রতি খালেদা জিয়া এসব নেতা সম্পর্কে বলেছেন, 'এরা দিনে করেন বিএনপি, আর রাতে করেন আওয়ামী লীগ'। যারা বিগত আন্দোলনে রাজধানীতে চরম ব্যর্থতার পরিচয় দেওয়ার পরও গুরুত্বপূর্ণ পদ-পদবিগুলো ধরে রাখার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন।
সূত্র জানায়, হাতেগোনা কয়েকজন ছাড়া বিএনপির অধিকাংশ কেন্দ্রীয় নেতার ওপরই তৃণমূল নেতা-কর্মীরা আস্থা রাখতে পারছেন না। কারণ এসব নেতা কর্মীদের দুঃসময়ে সাহায্য-সহযোগিতা দূরের কথা, কোনো রকমের যোগাযোগও রাখেননি। চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে লবিং-তদ্বির আর অর্থ খরচের মাধ্যমেই তাদের পদ-পদবি আর মনোনয়ন হয়। এ প্রসঙ্গে দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ৫ জানুয়ারির নির্বাচন দেশে-বিদেশে কারও কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়নি। সরকার বিরোধী দলের নেতা-কর্মীদের গুম-হত্যা করে নিপীড়ন চালিয়ে জোরপূর্বক ক্ষমতায় অাঁকড়ে আছে।
এভাবে চলতে পারে না। আমাদের নেত্রী উপজেলা নির্বাচনের পরই আন্দোলনের কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। স্থায়ী কমিটির অপর সদস্য লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান বলেন, এ ধরনের জোরজবরদস্তির সরকার কখনো বেশি দিন টিকে থাকতে পারে না। এ সরকারও পারবে না। নিজেদের কৃতকর্মের জন্য অদূর ভবিষ্যতে তাদের অত্যন্ত অসম্মানজনকভাবে বিদায় নিতে হবে।
দলের ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, জোরজবরদস্তি করে ক্ষমতায় এসে হত্যা, গুম আর দমননীতির মাধ্যমে গোটা দেশবাসীকেই জিম্মি করে ফেলেছে এই সরকার। অবিলম্বে এই গুম-হত্যা বন্ধ না করলে এর জন্য কঠিন মাশুল দিতে হবে তাদের।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।