আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রূপকথার নায়ক সাহারা সম্রাটের অজানা জীবন

শাসক দল ।।









বাবা সুধীরচন্দ্র রায় ছিলেন নদিয়ার বেথুয়াডহরির জমিদার বাড়ির বংশধর৷ কর্মসূত্রে চিনিকলের সাহেব৷ বিহার, উত্তরপ্রদেশের বিভিন্ন্ জায়গায় বদলির চাকরি৷ তাঁর চার সন্তানের দ্বিতীয়জন জন্মেছিলেন পূর্ণিয়া জেলার আড়ারিয়ার মামারবাড়িতে ৬৬ বছর আগে৷
পড়াশোনায় মোটেই ভালো ছাত্র ছিলেন না সেই পুত্র৷ স্কুলে ফেল করেছিলেন৷ চম্পারণে হরিনগর স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাস করেছেন সাপ্লিমেণ্টারিতে৷ বেনারসে আইএসসি পড়তে গিয়ে দু'বছর নষ্ট করেছেন৷ চণ্ডীগড়ে বিএসসি-র পাঠ নিতে গিয়েও ফিরে এসেছেন বাড়ি৷
বারবার পরিবারের মুখ ডোবালেও বাবা কিন্তু আস্থা হারাননি৷ বলেছেন, ফেল করছিস, চন্দন৷ ঠিক আছে৷ এখন ভালো করে খাওয়াদাওয়া কর৷ পরে পুত্র কোনোরকমে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা সংগ্রহ করেছেন গোরখপুর থেকে৷
এই হলো আজকের কাহিনির নায়ক চন্দন মানে সাহারাশ্রী সুব্রত রায়ের ছোটবেলার বায়োডাটা৷ কিন্তু তার পরবর্তী জীবনে উত্থান যেন রূপকথা৷ কেন বলব না? বছর দুই আগে ইন্ডিয়া টুডে-র সমীক্ষায় তাকে বলা হয়েছিল .. ‘দেশের সবচেয়ে প্রভাবশালী ৫০ জনের অন্যতম'৷ টাইম ম্যাগাজিন জানিয়েছিল .. ‘ভারতীয় রেলের পর তিনি দেশের বৃহত্তম কর্মদাতা'৷ ৩৫ বছরের মধ্যে তিনি সম্পদের পাহাড় বানিয়েছেন৷ সঠিক হিসাব কারো কাছেই নেই, কেননা, তার আয়-ব্যয়ের ব্যালান্সশিট দুর্লভ৷ তবে, অনেকেরই অনুমান, দু'লাখ কোটি টাকারও বেশি অর্থের মালিক তিনি৷
কী করে কুবের হলেন সেই চন্দন?
শোনা যায়, কাজের জীবনের শুরুতে প্যাকেটে ভরা স্ন্যাক্স বিক্রিতে নেমেছেন৷ ইলেকট্রিক ফ্যানের যন্ত্রপাতি বাজারে পাঠিয়েছেন৷ কিন্তু পকেটে দু'পয়সাও আসেনি৷ হাতড়াতে হাতড়াতে যেন আলিবাবা কাহিনির গুহা পেয়েছেন–‘টাকা কালেকশন'৷ 
এর শুরুটাও বেশ গল্পের মতো৷ গোরখপুরে একচিলতে ঘর৷ বাবার দেয়া একটি স্কুটার৷ একজন ক্লার্ক৷ পিওন একজন৷ একটি টেবিল৷ আর একজোড়া বেতমোড়া মেঠো চেয়ার৷ ঠিকঠাক ধরলে হাতে ১৩৭০ টাকা৷ টো টো করে পাড়ায় পাড়ায়, দোরে দোরে ঘোরা৷ দু'টাকা, পাঁচ টাকা, দশ টাকা জমা নেওয়া৷ তাঁর ক্লায়েণ্ট ধোপা, পানের দোকানি, রিকশাচালক, সবজির ব্যাপারি, টায়ার মেরামতকারী৷ আজকের সাহারা ইন্ডিয়ার এই হলো আদিরূপ৷
অন্যদিকে ফিরি৷ কলেজে এনসিসি'র ক্যাডেট ছিলেন চন্দন৷ মিলিটারির দিকে প্রবল টান৷ লখনউয়ে তাঁর কুবের সাম্রাজ্যের হেড কোয়ার্টারের নাম দিয়েছেন, ‘সাহারা কম্যান্ড অফিস'৷ দু'টি ছোট্ট কথা জানাই৷ সাহারাশ্রীর ইচ্ছায় সমস্ত সদস্যকে একই রকম পোশাক পরতে হয় মহিলাদের সাদা-কালো শাড়ি৷ পুরুষদের সাদা শার্ট, কালো ট্রাউজার, লোগো লাগানো কালো টাই৷ কোনো কর্মী হেলমেট ছাড়া স্কুটার চড়লে ১০ শতাংশ বেতন কেটে নেওয়া হয়৷ আর যে কেউ আসুন না কেন, সাহারা কর্মীদের ডান হাত বুকে রেখে বলতে হবে–‘সাহারা প্রণাম'৷ আর এয়ারপোর্টে চোখে পড়েছে, সাহারাশ্রীকে স্বাগত জানাতে সব কর্তা-ব্যক্তি সার বেঁধে করজোড়ে দাঁড়িয়ে৷ তার কর্মীসংখ্যা দেশজুড়ে ১২ লক্ষ৷ অফিস সাড়ে চার হাজারেরও বেশি৷
মিলিটারির বাঁধন সাহারা ইন্ডিয়ার পরিবারের লতায়-পাতায়৷ সুব্রত রায় নিজেকে বলেন, ‘ম্যানেজিং ওয়ার্কার'৷ তবে কাছের মানুষরা জানেন, কোনও ভুল তাঁর পছন্দ নয়৷ বরদাস্তও করেন না৷ মেজাজ মিলিটারির৷
বাইরে সাহারাশ্রী বড়ই মধুর৷ টকটকে ফর্সা রং৷ সরু গোঁফ৷ সাদা শার্ট৷ কালো টাই৷ কালো ভেস্ট৷ হাতের আঙুলে নীলকান্ত মণির আংটি৷ হাসি হাসি মুখ৷ মুলায়ম সিং, অমর সিং, অমিতাভ বচ্চন তাঁর কাছের মানুষ৷ যেকোনো জগতের সেলিব্রিটি তার কাছে ঘেঁষতে পারলে বর্তে যান৷ তবে কোনো দিন টাটা, বিড়লা, আম্বানি, হিন্দুজা, গোদরেজ গোত্রের সম্মান পাননি৷
সাহারাশ্রী রাতারাতি হননি সুব্রত রায়৷ বলতে পারেন, ৩৫ বছরের লং জার্নি৷ যে পথ এ মুহূর্তে তাকে টেনে এনেছে শ্রীঘরে৷
বলাবলি হয়, দেশে তার গড়া প্রতিষ্ঠানে টাকা গচ্ছিত রেখেছেন তিন কোটিরও বেশি মানুষ৷ এমন কোনো গ্রাম বোধকরি নেই যেখানে সাহারার হাত পৌঁছয়নি৷ অদ্ভুত এক মোহিনী কৌশলে জনতার ভরসা আদায় করে তাদের জমা টাকা লাগিয়েছেন অন্য ক্ষেত্রে৷ বিশালভাবে নেমেছেন আবাসন, হোটেল, বিনোদন ক্ষেত্রে৷ গড়েছেন সংবাদপত্র, টিভি চ্যানেল৷ একসময় তৈরি করেছিলেন বিমান সংস্থাও৷ আরো অনেক জগতে অঢেল টাকা ঢেলেছেন তিনি৷ খেলার দুনিয়ায় স্পনসরশিপে তিনিই বাদশা৷ ভারতীয় হকি টিমের স্পনসর৷ অনেক বছর ধরে ছিলেন জাতীয় ক্রিকেট দলেরও স্পনসর৷ ‘সাহারা ইন্ডিয়া' লোগো জার্সির বুকে লাগিয়ে দেশ-বিদেশের মাঠে দাপিয়েছেন সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়, ভারতরত্ন শচীন তেন্ডুলকারের মতো ক্রীড়াবিদরাও৷
এখানেই থেমে থাকেননি৷ ফর্মুলা ওয়ান মোটর রেসিং টিমের মালিক হয়েছেন৷ কিনতে চেয়েছেন ইংল্যান্ডের প্রিমিয়ার ফুটবল টিম৷ এমনকি এমজিএমের মতো আন্তর্জাতিক চিত্র প্রযোজনা কোম্পানি৷ হোটেল কিনেছেন নিউ ইয়র্ক, লন্ডনে৷ দেশে তার সংস্হার দখলে থাকা জমির পরিমাণ ৩৩,৬০ঙ্ম একরের বেশি৷ দুনিয়াকে তাক লাগিয়ে দিয়েছেন অর্থের পেশিশক্তি দেখিয়ে৷ একদা ফেল করা ছাত্রটি পেয়েছেন ডক্টরেট ডিগ্রি, হরেক সম্মান ও পুরস্কার৷ এজন্যই তাঁকে ঘিরে গড়ে উঠেছে এক মোহময় রহস্য, গল্পগাথা এবং মধুশিকারীদের ভিড়৷ 
ধনীশ্রেষ্ঠ কুলে সুব্রত রায় নিজেকে আনতে পেরেছেন দেশের শত শত মফঃস্বল শহর আর গ্রামের হাত ধরে৷ এখানকার অল্প টাকা, খুচরো টাকা দশ লাখেরও বেশি এজেণ্ট দিনের পর দিন নিপুণভাবে সংগ্রহ করে সাহারাশ্রীকে বসিয়েছেন টাকার পাহাড়ে৷ এমন ফর্মুলা তিনি ছকেছেন যে জনতা তাঁকে আরও বিশ্বাস করেছে৷ নাম নয়, তবু নাম হয়ে গিয়েছে ‘সাহারা ব্যাঙ্ক'৷ দেশে প্যারাব্যাঙ্কিংয়ে তিনিই তো সম্রাট৷ 

দু'হাতে টাকা নিয়েছেন, কিন্তু অর্থনীতির সাধারণ নিয়মে ফেরতের ক্ষেত্রে উজাড় হতে পারেনি সাহারা ইন্ডিয়া৷ টাকা সংগ্রহের মডেল অন্তত ৬'বার বদলেও ফল হয়নি৷ রিজার্ভ ব্যাঙ্ক, সেবি, আদালত তাকে চেপে ধরেছে৷ সেই ফাঁস ধাপে ধাপে কঠিন হয়েছে৷ ২০ হাজার কোটি টাকা আমানতকারীদের ফেরত দেয়ার নির্দেশ সামলাতে পারেননি সুব্রত রায়৷ লরিভর্তি পাওনা ফেরতের রসিদ দেখিয়েও পার পাননি৷ সত্যজিত্ রায়ের ‘নায়ক' সিনেমার স্বপ্নদৃশ্যে টাকার পাহাড়ে ডুবে যাওয়া উত্তমকুমারের মতো আলোর জগত থেকে যেন হারিয়ে যাচ্ছেন সাহারাশ্রী৷
- See more at: Click This Link
 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।