রাজধানীর ধানমন্ডি ১৫ নম্বর এলাকার ব্যস্ততম সড়কের পাশেই অবস্থিত কাকলী উচ্চবিদ্যালয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সামনে সাইনবোর্ডে বড় করে লেখা 'হর্ন বাজাবেন না, নীরবতা বজায় রাখুন'। শব্দদূষণ রোধে স্কুল কর্তৃপক্ষ পরিবেশ অধিদফতরের নির্দেশনায় লাগিয়েছে এটি। কিন্তু গতকাল সরেজমিন উপস্থিত থেকে ওই সাইনবোর্ডের লেখা মেনে চালকদের গাড়ি চালাতে দেখা গেল না। বরং দেখা গেল, ধানমন্ডির ব্যস্ততম ওই সড়কে চালকরা যানজটে পড়ে অপ্রয়োজনেই হর্ন বাজিয়ে যাচ্ছেন।
এতে ভয়াবহ শব্দদূষণের কবলে পড়তে হচ্ছে ওই শিক্ষার্থীদের। তবে এ দৃশ্য শুধু এখানকারই নয়, রাজধানীর অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালের সামনে নিয়ম ভেঙে হর্ন বাজাতে দেখা যাচ্ছে চালকদের।
শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে ২০০৬ সালে বিধিমালা পাস করা হলেও বাস্তবে এর প্রয়োগ নেই। আর নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণে শব্দদূষণ এখন ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা) ঢাকার বিভিন্ন স্থানের শব্দের মাত্রা নিরূপণ ও পর্যবেক্ষণ করে দেখতে পায়, স্থানভেদে সহনীয় মাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি শব্দ উৎপন্ন হচ্ছে।
আর এ কারণে ভুক্তভোগীদের মধ্যে দেখা দিচ্ছে উচ্চ রক্তচাপ, অনিদ্রা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, মনঃসংযোগ কমে যাওয়া, মাথাব্যথা, খিটখিটে মেজাজ, বিরক্তি ভাবসহ নানা রোগের উপসর্গ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মতে, শব্দের সহনীয় মাত্রা ৪৫ থেকে ৫০ ডেসিবল। ৬০ ডেসিবল শব্দ মানুষের শ্রবণশক্তি সাময়িক নষ্টও করে দিতে পারে। আর ১০০ ডেসিবল শব্দে মানুষ তার শ্রবণশক্তি চিরতরে হারিয়ে ফেলতে পারে। পরিবেশ অধিদফতরের মতে, একটি শহরের শব্দের সর্বোচ্চ মাত্রা আবাসিক এলাকার জন্য দিনে ৪৫ এবং রাতে ৩৫ ডেসিবল।
মিশ্র এলাকায় (আবাসিক, বাণিজ্যিক ও শিল্প) দিনে ৬০ ও রাতে ৫০ ডেসিবল এবং শিল্পাঞ্চলের জন্য ৭০ ডেসিবল। পবার জরিপে দেখা যায়, নীরব এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৫ থেকে ৯৭ ডেসিবল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় থেকে দুই গুণ বেশি। আবাসিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭৬ থেকে ৮৭ ডেসিবল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণের বেশি। বাণিজ্যিক এলাকায় দিবাকালীন শব্দের মাত্রা ৭১ থেকে ১০৭ ডেসিবল, যা মানমাত্রার চেয়ে দেড় গুণ বেশি। শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা, ২০০৬-এ হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস-আদালত বা একই ধরনের প্রতিষ্ঠান এবং এর চারপাশের ১০০ মিটার পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা 'নীরব এলাকা' হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।
এসব এলাকায় চলাচলকালে হর্ন বাজানো সম্পূর্ণ নিষেধ। মহাখালীর নাক, কান ও গলার চিকিৎসালয়ের (সাহিক) এক গবেষণায় জানা যায়, বর্তমানে ধানমন্ডি এলাকায় শব্দদূষণের মাত্রা ৭৮, শাহবাগে ৮২, গুলশানে ৯০, ফার্মগেটে ১০০, গাবতলীতে ১০২ ও সায়েদাবাদে ১০৬ ডেসিবল। বিশেষজ্ঞদের মতে, তিন বা এর চেয়ে কম-বয়সী একটি শিশু যদি খুব কাছ থেকে ১০০ ডেসিবল শব্দ শোনে, তাহলে সে চিরতরে শ্রবণশক্তি হারাতে পারে। বিগত সেনাসমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদে নগরীর বেশ কয়েকটি সড়কে হাইড্রোলিক হর্ন বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। কিন্তু ক্রমেই সে নির্দেশনা ভঙ্গ করায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন নগরবাসী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) সাধারণ সম্পাদক আবদুল মতিন বলেন, রাজধানীতে শব্দদূষণ ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। ঢাকা এখন 'উচ্চ শব্দের নগরী'। ওই শব্দ মানবদেহের ওপর মারাত্দক প্রভাব ফেলছে। রাজধানী ত্রুটিপূর্ণ ইঞ্জিনবিশিষ্ট অধিক গাড়ি চলাচল, সচেতনভাবে হর্ন ব্যবহারে অনাগ্রহ, উচ্চ শব্দে মাইকের ব্যবহারের কারণে শব্দদূষণ ঘটছে। সরকারকেও শব্দদূষণ রোধে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে দেখা যাচ্ছে না।
ওয়ার্কিং ফর বেটার লাইফ নামের একটি সংগঠন ২৫০০ লোকের ওপর শব্দদূষণের প্রভাব নিয়ে সম্প্রতি পরীক্ষা চালায়। সেখানে দেখা যায়, ৬৯ ভাগ লোকের শব্দদূষণে মাথাব্যথা হয়েছে, ৬৮ ভাগের আচরণ খিটখিটে হয়েছে। এর মধ্যে ৪২ ভাগের শ্রবণে সমস্যা, ৪২ ভাগের হদরোগ ও ৩৯ ভাগের নিদ্রাহীনতার রোগ হয়েছে।
বাপার নির্বাহী সদস্য ও 'সুন্দর জীবন' প্রতিষ্ঠাতা সিরাজুল ইসলাম মোল্লাহ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০০৬ সালের শব্দদূষণ নীতিমালায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও হাসপাতালকে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়। কিন্তু বর্তমানে এটি সম্পূর্ণ লঙ্ঘিত হচ্ছে।
যারা এর তদারক করবে খোদ সেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর জনবল স্বল্পতার কারণে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। শব্দদূষণ নীতিমালার যেসব দুর্বল জায়গা ছিল তা নতুন করে তুলে সংস্কার করতে বেশ কয়েকবার সভা-সেমিনারের মাধ্যমে সরকারকে অনুরোধ করা হয়। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেয়নি। শব্দদূষণের ভুক্তভোগীরা থানায় বা কোর্টে মামলা করারও সুযোগ পাচ্ছেন না। তিনি বলেন, শব্দদূষণ বিধিমালা পাস হওয়ার পর ২০০৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০০৭ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত শেরাটন হোটেল থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট পর্যন্ত এলাকাকে নীরব এলাকা ঘোষণা করা হয়।
ওই আইন ভঙ্গকারীদের জরিমানা প্রদান করতে বাধ্য করা হয়েছিল। কিন্তু পরে আইনটি আর কার্যকর থাকেনি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।