(আইজ্যাক আসিমভের "হাউ ডিড উই নো আর্থ ইস রাউন্ড" বইটির ভাবানুবাদের একটি প্রয়াস)
পৃথিবী কি সমতল?
বহুকাল আগে, মানুষ ভাবত পৃথিবী বুঝি সমতল। কেননা তা দেখতে ফ্ল্যাটস্ক্রিন টিভির মতই ফ্ল্যাট।
আপনি যদি একটা নৌকা বা জাহাজে চেপে মাঝসমুদ্রে চলে যান, পানির তলকে তখন সমতলই মনে হবে, এবং তা সমানভাবে সবদিকেই সমতল। আর মনে হবে আকাশ যেন উলটানো বোল (ভাত রাখার থালা), পানির সাথে জুড়ে আছে। বহুদূরে মনে হবে আকাশ আর সমুদ্র যেন একত্রে মিলিত হয়েছে।
যে রেখায় আকাশ আর সমুদ্র মিলিত হয়, তার নাম দিগন্ত। দিগন্ত দেখতে একটা মসৃণ বৃত্তের মত, যার কেন্দ্রে দাঁড়িয়ে আছেন আপনি।
যদি তুমি ভূমিতে থাক, তখনো একটা দিগন্ত দেখতে পাবে, তবে সেটা সমুদ্রের মত না। বাড়িঘর, গাছপালা, পাহাড়-পর্বতের কারণে সেই দিগন্ত সমুদ্রের মত মসৃণ হবে না, উঁচু-নিচু হবে খানিকটা।
প্রাচীনকালে মানুষ ভাবত পৃথিবী হয়ত অসীম পর্যন্ত বিস্তৃত আর সমুদ্রেরও নিশ্চয়ই কোন সীমা পরিসীমা নেই।
কিন্তু এটাই যদি হয়ে থাকে, তাহলে সূর্যের কী হবে? সূর্য প্রতিদিন পুবে উদয় হয়, সারাদিন আকাশে ঘুরে বেরিয়ে সন্ধ্যায় পশ্চিমে অস্ত যায়। পরের দিন আবার নতুন করে পূর্ব দিক থেকে সূর্য উঠে।
প্রাচীনকালে কেউ এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, প্রতি সকালে একটি করে নতুন সূর্য আকাশে তৈরি হয়, এবং সে উঠে। সন্ধ্যায় সে ধ্বংস হয়, এবং অস্ত যায়।
অন্যরা বলে, সন্ধ্যায় সূর্য সমুদ্রে অস্ত গেলে একে বিশালআকৃতির নৌকায় করে পরেরদিন সকালে আবার তাকে পূর্বে নিয়ে আসা হয়।
এছাড়া, কেউ কেউ ভাবত সূর্যদেবতার অগ্নিরথই হল সূর্য, যেই রথে চড়ে দেবতা আকাশে উড়ে বেড়ান। তিনি অগ্নিরথে করে প্রতি সকালে পূর্ব থেকে যাত্রা শুরু করেন, তারপর উড়তে উড়তে দুপুরে মধ্যগগনে চলে আসেন, ঠিক আমাদের মাথার উপর। সন্ধ্যা হতে হতে অগ্নিরথ নিয়ে দেবতা পশ্চিমে চলে আসেন এবং কোন এক অভিনব উপায়ে রাতের বেলা সবার আড়ালে আবার পূর্বে চলে আসেন, অগ্নিরথে চড়েই, কিন্তু তখন অগ্নিরথ কোন আলো ছড়ায় না!
ধ্রুবতারা থেকে অন্যান্য যে তারাগুলো বহু দূরে অবস্থান করে, সেগুলো এত বিশাল কক্ষপথে ঘুরে যে তা দিগন্তের নিচে নেমে যায়। সেই তারকাসমূহেরও উদয় হয় পুবে, অস্ত পশ্চিমে- ঠিক সূর্যের মত। চাঁদও পুবে উঠে, পশ্চিমে অস্ত যায়।
এই ব্যাপারগুলোও ব্যাখ্যা করা জরুরী ছিল।
প্রাচীন ব্যাখ্যাগুলো কেমন যেন গোলমেলে ছিল। ধরুন, আমাদের একটা সমতল পৃথিবী আছে যা সবদিকে সমানভাবে ছড়ানো। সেই সমতল পৃথিবীটা কত গভীর? যদি আপনি গর্ত খুঁড়ে ভেতরের দিকে যেতে থাকেন, তবে কতদূর পর্যন্ত যেতে পারবেন? পৃথিবী কি অসীম গভীর? নাকি এটা এক মাইল বা দশ বারো মাইলের মত গভীর? নাকি পঞ্চাশ মাইল? এটা যদি একটা মাটির পাতই হয়ে থাকে, তাহলে এটা নিচের দিকে পড়ে যাচ্ছে না কেন?
ভারতের লোকেরা বলত দানবাকৃতির কতকগুলো হাতি পৃথিবীকে ধরে রেখছে তাদের মাথার উপর, সেই হাতিগুলোকে আবার একটা কচ্ছপ তার পিঠে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
সেই কচ্ছপ তাহলে কার উপর দাঁড়িয়ে আছে? তারা বলত, কচ্ছপটা এক অকল্পনীয় বিশাল সমুদ্রে সাঁতার কাটছে।
আচ্ছা, সেটা না হয় মেনে নিলাম। কিন্তু তাহলে সমুদ্র কি একেবারে নিচ পর্যন্ত বিস্তৃত? এর উত্তর পাওয়া যায়নি কোন।
নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, যদিও পৃথিবীটা খালি চোখে দেখতে ফ্ল্যাট ফ্ল্যাটই লাগে, কিন্তু এই ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া কঠিন। ফ্ল্যাট হওয়ায় সমস্যা আছে।
গ্রিকরাই প্রথম পৃথিবীর সমতল হওয়ার সমস্যা নিয়ে চিন্তা করেছিল, ২৫০০ বছর আগে।
অ্যানাক্সিম্যান্ডার হলেন তাদের মধ্যে একজন যিনি সূর্য দেবতা আর তার অগ্নিরথের গল্পে সন্তুষ্ট ছিলেন না।
কোন এক পরিষ্কার রাতের আকাশে তিনি দেখলেন তারাগুলো। রাতের বেলা সেগুলো যেন আকাশে ঘুরে বেড়ায়, সবগুলোই; শুধু একটি ছাড়া- ধ্রুবতারা। এটি উত্তরের আকাশে সবসময় একই জায়গায় ঠায় দাঁড়িয়ে থাকে। এর আশেপাশের তারাগুলো একে কেন্দ্র করে ঘুরতে থাকে, কাছের তারাগুলো ছোট বৃত্তে, আর দূরেরগুলো একটু বড় আকারের বৃত্তে।
সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার যা অ্যানাক্সিম্যান্ডার পর্যবেক্ষণ করেছেন, তা হল তারাগুলো বিশেষ একটি প্যাটার্নে আকাশে ঘুরে। মৌমাছির ঝাঁকের মত উল্টা পাল্টা যে যার পথে ঘুরে বেড়ায় না। বরং সব তারা একত্রে ঘুরে।
অ্যানাক্সিম্যান্ডার সিদ্ধান্তে আসলেন আকাশ হল একটা বিশাল ফাঁপা গোলক। সেই গোলক একটা কাল্পনিক অক্ষের উপর ঘুরে বেড়াচ্ছে।
ধ্রুবতারা উত্তর আকাশের যেখানে অবস্থিত, সেখানে কাল্পনিক অক্ষের এক প্রান্তবিন্দুর অবস্থান (যেহেতু ধ্রুবতারা অন্য সবার সাপেক্ষে স্থির, তার মানে একে কেন্দ্র করেই সবাই ঘুরছে। এটি তাই অক্ষের উপর থাকবে)। অন্য প্রান্তটি গোলকের ঠিক উল্টো প্রান্তে, ফলে আমরা তা দেখতে পাই না।
প্রতিদিন আকাশ-গোলক ঘুরে, ফলে আকাশের গায়ে সেঁটে থাকা তারাগুলোও একসাথে ঘুরে এবং এর ফলেই তারাগুলো একটা প্যাটার্ন মেনে চলে। সূর্য আর চাঁদও আকাশের সাথে লাগানো, তারাও একই কারণে উঠে আর অস্ত যায়।
আকাশ যদিও গোলাকৃতির, তারপরও পৃথিবী সমতল হতে পারে। অ্যানাক্সিম্যান্ডারও তাই ভাবলেন। তিনি চিন্তা করলেন পৃথিবী একটা সমতল পাত, যা আকাশের সীমানা পর্যন্ত বিস্তৃত।
আকাশগোলক যখন ঘুরে, তার সাথে সাথে সূর্য পুবের আকাশে উঠে আর পশ্চিমে অস্ত যায়, যেহেতু আকাশের সাথে এটি লাগানো। এবং যেহেতু আকাশ ঘুরতে থাকে, একসময় সূর্য গোলকের নিচের প্রান্তে চলে যায়।
যখন সূর্য পাতের নিচের প্রান্তে চলে যায়, তখন পৃথিবীতে হয় রাত। যখন ঘূর্ণায়মান আকাশ সূর্যকে সাথে নিয়ে আবার পূর্বে উঠে আসে, তখন আবার দিন সৃষ্টি হয়। অ্যানাক্সিম্যান্ডারের ধারণাটি তুলনামূলক গ্রহণযোগ্য মনে হয় আগের ধারণাগুলোর চেয়ে। সূর্যকে এর ফলে প্রতিদিন ধ্বংস হতে হয় না বা নৌকা দিয়ে তাকে পশ্চিম থেকে পূর্বেও আনার দরকার হয় না।
এতকিছুর পরেও অ্যানাক্সিম্যান্ডার সন্তুষ্ট ছিলেন না।
তিনি চিন্তা করতে লাগলেন।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।