আমরা কীভাবে জানলাম পৃথিবী গোলাকার? -আইজ্যাক আসিমভ (প্রথম পর্ব)
(আইজ্যাক আসিমভের "হাউ ডিড উই নো দ্য আর্থ ইজ রাউন্ড" বইটির ভাবানুবাদের একটি প্রয়াস)
দূর সীমানার তারাগুলো
যদি পৃথিবী আকাশ গোলকের মধ্যে বসানো একটা সমতল পাত হত, তবে আমরা হেঁটে হেঁটে একসময় পৃথিবী আর আকাশ যেখানে মিলিত হয়েছে সেখানে পৌঁছাতে পারতাম। আকাশের যে বিন্দুতে সূর্য উঠে সেখানেও আমরা পৌঁছাতে পারতাম, হয়ত সূর্যকে একবার স্পর্শ করারও সুযোগ পেতাম, যদি না সেটার তাপে আমরা মারা না যাই।
আমরা যদি পশ্চিমে যেতে থাকি, সূর্য যেখানে অস্ত যায় সেখানেও পৌঁছাতে পারতাম।
আগে কিছু মানুষ বিশ্বাস করত, হয়ত সত্যিই এরকম সম্ভব। অতি উৎসাহীদের কেউ কেউ এমন ছবিও এঁকেছে যে একজন মানুষ আকাশ ছুঁয়েছে।
মানুষটি আকাশের প্রান্তে পৌঁছে নিজের মাথাটি ঝুঁকিয়ে সেই যন্ত্রটিও দেখছে যা আকশকে ঘুরিয়েই চলছে ক্রমাগত।
তবে গ্রিকরা বুঝতে পেরেছিল মানুষ যতই পূর্বে বা পশ্চিমে যাক না কেন, কোনভাবেই সূর্যের কাছাকাছি যাওয়া যায় না। একই সাথে সম্ভব নয় চাঁদ কিংবা তারার কাছাকাছি যাওয়া। তাই তারা এতে সন্দিহান ছিল। হয়ত পৃথিবী আকাশের সীমা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল না।
হয়ত আমাদের চোখ আমাদের ভুল দেখাচ্ছিল যখন আমরা দেখছিলাম আকাশ আর পৃথিবী একত্রে মিলিত হয়েছে।
মানুষ ভাবল হয়ত পৃথিবী একটা সমতল পাতই, কিন্তু তা আকাশের গোলকের তুলনায় বেশ ছোট। এবং তখন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছানোর পরেও সূর্য-চাঁদ-তারা বহুদূরে থাকবে, এদের ধরা যাবে না।
এখন সমস্যা হল মানুষ পৃথিবীর শেষ সীমায়ও পৌঁছাতে পারে না। যদি পৃথিবী আকাশের কেন্দ্রে একটা সমতল পাতই হয়ে থাকে, তবে মানুষ কেন পৃথিবীর শেষ প্রান্তে পৌঁছাতে পারে না?
হয়ত পৃথিবীর স্থলভাগ সমতল পাতের কেন্দ্রে অবস্থিত, যা আবার জল দিয়ে পরিবেষ্টিত।
পরিব্রাজক বা ভ্রমণকারী, যাই বলি না কেন তারা সবসময়ই কিছুদুর গেলে সমুদ্র খুঁজে পায়। হয়ত সমুদ্রের শেষ যেখানে, সেতিই পৃথিবীর শেষ প্রান্ত। আমরা যে সময়ের কথা বলছি, তখন মানুষ নিজের বাসভুমি থেকে খুব দূরে যাওয়ার অভ্যাস করে উঠেনি। একারণেই মানুষ পৃথিবীর শেষ প্রান্তে যেতে পারেনি।
কিন্তু শেষ প্রান্তে যদি সমুদ্রই থাকে, তাহলে সমুদ্রের পানি পৃথিবী থেকে পড়ে যায় না কেন?
হয়ত পৃথিবীর প্রান্তভাগ সামান্য উপরে ওঠানো, অনেকটা বাসার ছাদের রেলিঙের মত, তাই পানি উপচে পড়ে না।
হয়ত পৃথিবী একটা পাত নয়, বরং একটা ভাতের বোলের মত।
যদি তা হয়ে থাকে, তাহলে সম্পূর্ণ পৃথিবীটাই কেন নিচে পড়ে যাচ্ছে না?
পৃথিবী একটা পাত, এটি মানা খুবই কঠিন ছিল, যদিও আকাশ একটা বিশাল গোলক আর সূর্য উদয় আর অস্ত যাওয়ার সমস্যাটির ব্যাখ্যা দেয়াও সম্ভব হয়েছিল।
যদি পৃথিবী সমতল না হয়, তাহলে এটি কোন আকৃতির হতে পারে?
আমরা যদি আরেকবার আকাশের দিকে তাকাই, তাহলে কি কোন সমাধান পাওয়া যায়? আকাশে অনেক উজ্জ্বল বস্তু দেখা যায়, তার বেশিরভাগই তারা।
তারা সম্পর্কে সেই সময় মানুষ খুব বেশি কিছু জানত না। তারা তখনো আকাশে জাজ্বল্যমান কিছু বিন্দু ছাড়া কিছু ছিল না মানুষের কাছে।
এত তারার ভিড়ে দুটি বস্তু ছিল আলাদা- সূর্য আর চাঁদ। সূর্য একটা বৃত্ত, কিন্তু চাঁদ কখনো বৃত্ত, কখনো অর্ধবৃত্ত, আবার কখনো বৃত্ত আর অর্ধবৃত্তের মাঝামাঝি কোন আকার। কখনো কখনো শুধু একটা কাস্তের মত বাঁকা।
গ্রিকদের মধ্যে যারা আকাশ পর্যবেক্ষণ করত, তারা লক্ষ্য করেছিল চাঁদের অবস্থান সূর্যের সাপেক্ষে প্রতিনিয়ত পরিবর্তিত হয়। অবস্থানের সাথে সাথে এর আকারেরও পরিবর্তন হয়।
যখন পৃথিবীর দুই পাশে সূর্য আর চাঁদ থাকে, তখন চাঁদ একটা বৃত্ত। সূর্য তখন চাঁদের উপর আলো ফেলে। যার ফলে চাঁদের পৃষ্ঠের সম্পূর্ণটাই আলোকিত হয়। আবার যখন চাঁদ আর সূর্য পৃথিবীর একই পাশে থাকে, তখন চাঁদ দেখা যায় না। কারণ তখন সূর্য চাঁদের অন্য পাশ আলোকিত করে, পৃথিবীর পাশে যেই পৃষ্ঠ, সেটিকে নয়।
ফলে চাঁদকে সেই সময় দেখা যায় না।
প্রাচীনকালে যারা এই ব্যাপারটি লক্ষ্য করেছেন, তারা সিদ্ধান্তে পৌঁছান যে সূর্যের নিজের আলো থাকলেও চাঁদের তা নেই। চাঁদ সূর্যের প্রতিফলিত আলো দিয়ে নিজেকে আলোকিত করে।
সেই সময় গ্রিকরা জ্যামিতি নিয়ে কাজ করা শুরু করেছিল। তারা চাঁদের এই বিভভিন আকার নিয়ে গবেষণা শুরু করেছিল।
তারা নিশ্চিত হয়েছিল, চাঁদের আলোকিত অংশের এই বিভিন্ন রকম আকার ধারণ করতে হলে তাকে অবশ্যই গোলাকার হতে হবে।
তাহলে সূর্যের আকৃতি কী রকম হবে? এটি চাঁদকে আলোকিত করে, এবং তা করে সব অবস্থান থেকেই সমানভাবে। সূর্য আর চাঁদ পৃথিবীর একপাশেই থাকুক বা বিপরীত পাশে, বা এর মাঝামাঝি কোন অবস্থানে, চাঁদ সব সময়ই সমান আলো পায় সূর্য থেকে। এটা সম্ভব শুধুমাত্র তখনই যদি সূর্য গোলাকৃতির হয়।
অ্যানাক্সিম্যান্ডার দেখলেন সূর্য, চাঁদ আর সাথে সাথে আকাশ নিজেও গোলাকার।
তাহলে কি পৃথিবী নিজেও গোলাকার? সমতল নয়?
তবে গোলাকার হওয়া জরুরী কিছু ছিল না। হয়ত আকাশ আর পৃথিবীর জন্য নিয়ম একই ছিল না; আকাশ আর সূর্য গোলাকার বলে পৃথিবীকেও গোলাকার হতে হবে, এমন কোন কথা নেই। পৃথিবীর তুলনায় সূর্য প্রচণ্ড গরম আর পৃথিবী আকাশকে কেন্দ্র করে ঘুরছেও না চাঁদের মত। আর আকাশের সাথে তুলনা করলে আকাশের মত পৃথিবীর লক্ষ কোটি তারাও নেই।
পৃথিবীর আকার বুঝতে হলে অন্য বস্তুর দিকে না তাকিয়ে পৃথিবীর দিকেই তাকাতে হবে।
তাহলে আবার পৃথিবীতে ফেরত যাই। এবার নিজেকে প্রশ্ন করি, আমরা কি পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্ত থেকে তারাগুলোকে ভিন্ন ভিন্নভাবে দেখতে পাই? নাকি সব জায়গা থেকে আকাশের তারাগুলো দেখতে একই রকম?
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।