জানি না কেন লিখি! তবু লিখি মনের খেয়ালে, পরিবর্তন করার মানসে, পরিবর্তিত হওয়ার মানসে। যদিও জানি সব ব্যর্থ হচ্ছে। তবুও আমি আছি সেদিনের সেই আলোকময় প্রত্যুষার আগমনের অপেক্ষায়
কোন একটি দেশের গণমাধ্যমকে গণ্য করা হয় ঐ দেশ বা জাতীর বিবেক হিসেবে। কিন্তু দেশি কিংবা বিদেশি এসব গণমাধ্যমগুলোকে প্রায়শঃই মিথ্যাচার, কোন তুচ্ছ বিষয় কিংবা সংবাদকে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে অতিরঞ্জণ করাসহ নানা ধরনের বিতর্কিত ভূমিকার জন্য প্রশ্নবিদ্ধ ও সমালোচিত হতে দেখা যায়। বিশেষ করে আমাদের দেশের মিডিয়াগুলো এই অভিযোগে অতিমাত্রায় অভিযুক্ত।
এসব মিডিয়ার কাদের নিয়ন্ত্রণে তা খুঁজতে গেলে দেখা যায় কোন না কোন রাজনৈতিক দল এবং বড় বড় ব্যবসায়ীক প্রতিষ্ঠানের মালিকগণ এসবের পেছনে বিনিয়োগ করেছেন। একটা বড় ব্যবাসায়িক প্রতিষ্ঠানের যেমন অনেকগুলো সহযোগী প্রতিষ্ঠান (Sister Concern) থাকে, মিডিয়াও তাদের তেমনি আরেকটি বাহু (Wing). এদের অনেকেরই আবার আছে মিডিয়া গ্র“প, যাতে একাধিক টেলিভিশন চ্যানেল ও ইংরেজি ও বাংলায় একাধিক সংবাদপত্রসহ অনলাইন নিউজ পোর্টাল। এই ডানাগুলো (Wings) নির্লজ্জভাবে তাদের পক্ষপাতিত্ব করে তাদেরই হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য এবং ব্যবসায়ীক স্বার্থোদ্ধার করে চলে। প্রতিপক্ষের উপর নিজেদের আধিপত্য বজায় রাখতে গিয়ে এবং পত্রিকার কাটতি কিংবা টেলিভিশনের টিআরপি বাড়ানোর জন্য তারা নানা ধরনের চটকদার ও বানানো কাহিনী প্রচার করে থাকে, যা স্পষ্টত মিথ্যাচারে পূর্ণ থাকে। এ সকল মিডিয়ার যার যার উদ্দেশ্য থাকলেও কিছু বিষয়ে তাদের সকলের দৃষ্টিভঙ্গি ও স্বভাব প্রায় একই রকম।
বিশেষ করে কোন একটি সংবাদে যদি চমকে দেওয়ার মত কিছু থাকে তাহলে তারা একযোগে এর পেছনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কে কার চাইতে চমক দেখাবে তা নিয়ে রীতিমত প্রতিযোগিতা শুরু করে। তাদের এক তরফা প্রচার-প্রচারণার ফলে বাস্তব বিষয়টি তুচ্ছ হলেও ব্যাপক গুরুত্ব পেয়ে যায়। তাদের সমস্বরে গাওয়া গীতের সুর এতই প্রকট ও জোরালো হয় যে একে অনেকটা সব শেয়ালের এক ‘রা’ প্রবাদ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। আবার এই প্রচার-প্রচারণার ভিড়ে অনেক বড় বড় ঘটনা থেকে যায় আড়ালেই।
এভাবেই মিডিয়া মানুষের চিন্তা-চেতনা কিনে নিয়ে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত, মানুষের সাধ্য নেই তাদের তাদের দেখানো পথের বিকল্প চিন্তা করা।
২০০১ সালের এর ‘নাইন ইলেভেন’ খ্যাত টুইন টাওয়ার ধ্বংসের পর পৃথিবীর পুরো রাজনৈতিক চিত্রপট হঠাৎ করেই বদলে গেছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন মোড়ল রাষ্ট্রগুলো এর মধ্য দিয়ে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ (War on terror) নামে বিশ্বব্যাপী একটি যুদ্ধের সূচনা করে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ সে সময় পুরো মানবজাতির প্রতি একটি শর্ত ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘এ যুদ্ধে কাউকে হয় আমাদের পক্ষে থাকতে হবে, না হয় সকলকেই বিপক্ষ শক্তি বলে গণ্য করা হবে।
’ সেই থেকে শুরু হওয়া সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যারা পক্ষ নিয়েছে তাদের গলা অনেক উঁচুতে উঠে গেছে। অন্যদিকে যারা এর পক্ষে নয়, আবার বিপক্ষেও নয়, শক্তি না থাকায় তাদের সুর স্বাভাবিকভাবেই মিনমিনে হয়ে গেছে। মেইন স্ট্রিমে তাদের মতামত, মনোভাব প্রকাশের আর কোন স্থান রইল না। এক পাক্ষিক উচ্চগ্রামে উঠা ঐ সুরের প্রকাশ হচ্ছে এ সভ্যতারই বাহন গণমাধ্যমগুলোর কণ্ঠ দিয়ে।
বর্তমানে মিডিয়ার কাছে আন্তর্জাতিকভাবে ‘সন্ত্রাসবাদ’ এবং দেশীয় ভাষায় ‘জঙ্গিবাদ’ প্রধান অস্ত্র, তাদের প্রধান খোরাকে পরিণত হয়েছে।
যখন কোন চমক দেওয়ার মত খবর থাকে না তখনই সন্ত্রাসবাদ এবং জঙ্গিবাদের জুজুকে সামনে নিয়ে আসা হয়। ডেস্কে বসে পুরনো খবরের অংশবিশেষ কপি-পেস্ট করে, সাথে মনের মাধুরি ও কল্পনার রং মিশিয়ে লাল কালিতে চটকদার শিরোনাম করা হয়। অবাক করা বিষয় এই যে, যখনই তারা এই বিষয়টি নিয়ে প্রোপাগান্ডা শুরু করে তার কিছুদিনের মধ্যে সত্যি সত্যি চাঞ্চল্যকর কিছু ঘটনা ঘটে। কয়েকদিন আগে আমাদের দেশের গণমাধ্যমগুলোতে আল-কায়েদা নেতা আইমান আল জাওয়াহিরির একটি ভিডিও বার্তা নিয়ে তোলপাড় হয়। ভিডিও বার্তাটিতে জাওয়াহিরি বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষমতাসীন সরকারকে ‘নাস্তিক’ ও ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ আখ্যা দিয়ে সাধারণ মুসলমানদেরকে আহ্বান করেছেন ‘সত্যিকারের নেতাদের’ সাথে মিলিত হয়ে জেহাদের ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য।
প্রথমে কয়েকটি মিডিয়া এটি নিয়ে হৈ চৈ শুরু করলেও পরবর্তীতে হুক্কা হুয়া সুরে বাকিরাও একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। কিন্তু জানা গেছে এই ভিডিও বার্তাটি নিয়ে তোলপাড় হওয়ার প্রায় এক মাস আগেই ইন্টারনেটে সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে। তখন এটি নিয়ে তেমন কোন উচ্চ-বাচ্য হয় নি। কিন্তু হঠাৎ করেই মিডিয়ার মূল প্রবাহ এটিকে লুফে নিয়ে ব্যাপক প্রচারণা শুরু করে। তাতে দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষক থেকে শুরু করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, বামপন্থী-ডানপন্থী সকলের মধ্যে হৈ হৈ রৈ রৈ পড়ে যায়।
আলোচনামুখর হয়ে উঠে পত্রিকার কলামগুলো, টেলিভিশনের টকশোগুলো হয়ে উঠে সরগরম। এ নিয়ে রাজধানীর হোটেল রেডিসনে ‘বাংলাদেশ সেন্টার ফর পিস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট’ এর আয়োজনে জঙ্গিবাদ বিরোধী ‘জঙ্গিবাদ হুমকি, বাংলাদেশ ভাবনা’ শীর্ষক জাতীয় সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে দেশের প্রথম সারির সংবাদপত্রগুলোর সম্পাদক থেকে শুরু করে বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক, রাজনীতিকরা হাজির হয়ে আলোচনামুখর করে তোলেন। দু’একটি অতি উৎসাহী টেলিভিশন চ্যানেল গুরুত্ব দিয়ে তা সরাসরি স¤প্রচারও করে। একই সাথে পরদিন সবগুলো সংবাদপত্র এ অনুষ্ঠানকে শিরোনাম করে সংবাদ পরিবেশন করে।
এই এত হৈ হৈ রৈ রৈ কেন পড়েছিল তা এর একদিন পরেই পরিষ্কার হয়ে যায়। নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন জেএমবির শীর্ষ নেতাদেরকে অনেক আগেই ফাঁসির দড়িতে ঝুলানো হয়েছে। বাকিদের অনেককেই ফাঁসিসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে, অনেকেই জেলে বন্দী আছেন। আবার অনেকের বিচার প্রক্রিয়া চলমান। এদের মধ্য থেকেই তিনজন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামীকে গত ২৩ ফেব্র“য়ারি কাশিমপুর কারাগার থেকে ময়মনসিংহ জেলা আদালতে হাজির করার জন্য প্রিজন ভ্যানে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল।
প্রিজন ভ্যানটি ত্রিশালের কাছে পৌঁছতেই হঠাৎ গতিরোধ করে পুলিশের উপর বোমা ও গুলি ছুঁড়ে তিন জনকে ছিনিয়ে নেয় তাদের দোসরগণ। এতে এক পুলিশ নিহত এবং আরো দুই জন মারাত্মকভাবে আহত হন। প্রমাণিত হয় মিডিয়ার ঐ গরম গরম আলোচনা মোটেই বৃথা নয়।
প্রশ্ন হচ্ছে, আলোচিত এ ঘটনাটি আগে পরে না ঘটে ঠিক ঐ গরম অবস্থায় কেন ঘটলো? এতে কি পরিষ্কার হয়ে যায় না যে, জঙ্গিবাদী কর্র্মকাণ্ড কখন সংগঠিত হবে তা মিডিয়ার কাছে অজ্ঞাত নয়? অথবা বলতে হবে মিডিয়া যেসব কাল্পনিক তথ্য প্রকাশ করে তা থেকে জঙ্গিরা উদ্ধুব্ধ হয়, অনুপ্রাণিত হয়। সেই সাথে জঙ্গিরাও নিজেদের শক্তি- সামর্থের প্রমাণ দিতে গিয়ে এসব সহিংস কর্মকাণ্ড ঘটিয়ে চলে।
মিডিয়ার এ সকল কর্মকাণ্ডের পেছনে নিজেদের স্বার্থোদ্ধার ছাড়াও আরো একটি বিষয় কাজ করে। আর তা হলো- শিক্ষিত শ্রেণির যে অংশটি মিডিয়ায় যায়- প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার কারণে তারা পাশ্চাত্য সভ্যতা দ্বারা সাংঘাতিকভাবে প্রভাবিত হয়ে থাকে। মনের অজান্তে প্রায় সর্ব ক্ষেত্রেই তারা অন্ধভাবে পাশ্চাত্যের অনুসরণ-অনুকরণ করে থাকে। কোন বিষয়ে পাশ্চাত্য যে মানদণ্ড গ্রহণ করে, এরাও সাত সমূদ্র তেরো নদীর এপারে বসে স্থান- কাল ও পাত্রের ব্যবধান ভুলে তাকেই উৎকৃষ্ট বলে গ্রহণ করে। পাশ্চাত্যের সাধুবাদ পেতে এরা সদা গদগদ চিত্ত।
মূলত পাশ্চাত্য সভ্যতা এদেশীয়দের শিক্ষা ব্যবস্থায় বস্তুবাদী ধ্যান-ধারণার অনুপ্রবেশ এবং নিজেদের সম্বন্ধে হীনমন্যতা প্রবেশ করাতে সক্ষম হয়েছে বলেই তা সম্ভব হচ্ছে।
সমাজতন্ত্রের পতনের পর পাশ্চাত্য আজ ইসলাম ফোবিয়াতে ভুগছে, তাদের সাথে তাল মিলিয়ে এই দেশের শিক্ষিত শ্রেণিটিও প্রকৃত ইসলাম সম্বন্ধে জ্ঞান না থাকায় এখন ইসলাম ফোবিয়াতে আক্রান্ত। তাদের এই ভয়ের কারণে প্রায়শঃই তারা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে ব্যর্থ হচ্ছে। সব কিছু জানা থাকলেও তারা বোঝার চেষ্টা করছে না যে, কথিত ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটিয়ে প্রকৃত ইসলামকে কালিমালিপ্ত করার পেছনে কাজ করছে পাশ্চাত্য মোড়লদের সুদূর প্রসারী ষড়যন্ত্র। পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা প্রতিটি বড় বড় জঙ্গি সংগঠনগুলোকে পশ্চিমারাই অর্থনৈতিক ও সামরিক প্রশিক্ষণ দিয়ে বড় করে তুলেছে।
আবার তাদেরকেই ধ্বংস করতে এখন সারা পৃথিবী জোড়া চালানো হচ্ছে কথিত ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’। কিন্তু কেউই তাদেরকে প্রশ্ন কিংবা দায়ী করছে না যে, এদের প্রকৃত উদ্গাতা কারা। কারণ অনেক আগেই এদেশীয় শিক্ষিত শ্রেণিটির মন-মগজ কিনে নেওয়া হয়েছে। অবাক করা বিষয় এই যে, মুখে যতই তারা জঙ্গিবাদ দমনের কথা বলুক না কেন, জঙ্গিবাদের উৎসমুখ বন্ধ করতে এরা মোটেই আগ্রহী নয়। মনে রাখা দরকার-বর্তমান বিকৃত ইসলামের দু’টি বাহু দু’দিকে বিস্তার করা আছে।
এর মূল বাহুটি নিয়ন্ত্রিত হয় ধর্মব্যবসায়ী পুরোহিত সদৃশ মোল্লাদের দ্বারা। এরা ধর্মকে জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করায় নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বিনষ্ট হবে বলে এই শ্রেণিটি প্রকৃত ইসলামের প্রকাশ ঘটায় না। বীতশ্রদ্ধ আরেকটি অংশ জঙ্গিবাদকে গ্রহণ করে পাশ্চাত্যের পাতা ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছে। মিডিয়া জঙ্গিবাদ নিয়ে যতই উচ্চ-বাচ্য করুক না কেন, প্রকৃতপক্ষে তারা একে জিইয়ে রাখারই পক্ষপাতী। কেননা তারা পাবলিক সেন্টিমেন্টের নামে জঙ্গিবাদের মূল সুতিকাগার অর্থাৎ ধর্মব্যবসায়ীদের ঘাটাতে মোটেও আগ্রহী নয়।
যেহেতু তাদের অধিকাংশেরই পিতৃ-ধর্ম ইসলাম সেহেতু তারা ইসলামের ব্যাপারে ঐ ধর্মব্যবসায়ী গোষ্ঠীটির উপর দায়বদ্ধ। সুতরাং স্বার্থোদ্ধারে নির্লজ্জ মিথ্যাচারের রীতি, নিজস্ব সত্তাকে পাশ্চাত্যের চিন্তা ধারার কাছে বিক্রি এবং ধর্মব্যবসায়ীদের সাথে আপোষকামী মনোভাব বজায় রেখে যতই মাঠ গরম করা হোক না কেন- কখনো তাতে কাঙ্খিত শান্তি আসবে না। অনন্তকাল ধরে মিডিয়া তার রসদ পেয়ে যাবে। মিডিয়ার এ সকল ভণ্ডামী থেকে সাধারণ মানুষকে সাবধান হওয়া অতীব জরুরি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।