আমরা কীভাবে জানলাম পৃথিবী গোলাকার? -আইজ্যাক আসিমভ (প্রথম পর্ব)
আমরা কীভাবে জানলাম পৃথিবী গোলাকার? -আইজ্যাক আসিমভ (দ্বিতীয় পর্ব)
দূরে বিলীয়মান হওয়া জাহাজের কথা
অ্যানাক্সিম্যান্ডারের তত্ত্বটা কিছু প্রশ্নের উদ্রেক করে।
প্রথমত, যদি পৃথিবী সিলিন্ডারের মতই হয়ে থাকে, তবে দেখতে কেন সমতল মনে হয়?
এটি অবশ্য বেশ সহজ প্রশ্ন। পৃথিবী এত বড় আর আমরা এতো ছোট যে আমরা শুধু পৃথিবীর ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র অংশই দেখি, এবং সেই অংশে সিলিন্ডারের বক্রতা এত ক্ষুদ্র যে আমাদের কাছে সমতল মনে হয়। ধরুন, একটা বেলুন আছে আপনার কাছে যাকে আপনি মোটামুটি কয়েক ফিট পর্যন্ত ফোলাতে পারেন। যদি সেই বেলুনে আপনি একটা মার্কার দিয়ে ছোট্ট একটা বৃত্ত আকেন, সেই বৃত্তটি কি সমতল মনে হবে না? যদিও বৃত্তটি কিন্তু বেলুনের অংশ, যা সমতল নয়।
তবে দ্বিতীয় প্রশ্নটির উত্তর একটু কঠিন। যখন আমরা উত্তরে বা দক্ষিণে যাই, তাহলে কেন পাহাড় থেকে নিচে নামার মত অনুভূতি আমাদের মাঝে তৈরি হয় না? আমরা কেন পিছলে পড়ে যাই না?
হয়ত আপনি ভাবতে পারেন স্থলভাগ এতই অমসৃণ যে তার ঘর্ষণ বলের প্রভাবে আমরা পিছলে যাই না। আচ্ছা, তা না হয় মানা গেল, কিন্তু সাগরে নামলে? তখন কী হবে? তখন কী হবে যখন আপনি জাহাজে করে উত্তর বা দক্ষিণে যাবেন? জাহাজ কেন তখন পিছলে যায় না? সবচেয়ে বড় ব্যাপার হল, সাগরের পানিই বা কেন পৃথিবী থেকে উপচে পড়ে না?
অ্যানাক্সিম্যান্ডারের কাছে এর কোন উত্তর ছিল না। তিনি আকাশের তারাদের অবস্থান দেখে এর চেয়ে বেশি কিছু বলে যেতে পারেননি।
আরও একটি প্রশ্ন, কেন পৃথিবী শুধুমাত্র উত্তর দক্ষিন বরাবরই বাঁকা? যদি আমরা পূর্ব থেকে পশ্চিমে যাই? তখন কি তারাদের অবস্থান পরিবর্তিত হয় না? আগের মত তখনো কি তারাগুলো পশ্চিমে ঢাকা পড়ে না যখন আমরা পূর্বে যাই? তারাগুলো কি পূর্বে ঢাকা পড়ে না যখন আমরা পশ্চিমে রওনা হই?
এটার উত্তর আসলে দেয়া কঠিন।
যদি আকাশ না ঘুরত, তখন হয়ত বলা যেত তারাগুলো আসলে উত্তর-দক্ষিণ বরাবর যে লুকোচুরি খেলে তা পূর্ব পশ্চিম বরাবরও খেলে কিনা। কিন্তু আকাশ কখনো স্থির হয় না। তাই এর উত্তর দেয়া আসলে সম্ভব না।
কিন্তু এর মানে এই না যে এই মুহূর্তে কোন প্রমাণ না থাকায় আমরা এখনি একটি সিদ্ধান্তে চলে আসব। কোন বিষয়ে নিশ্চিত হতে হলে আপনার কাছে প্রমাণ থাকতে হবে।
হয়ত এই বিষয়ে অন্য কোনভাবে অন্য কোন তথ্য আমাদের কাজে লাগতে পারে। হয়ত তা এমন কিছু যা আকাশের সাথে সম্পর্কিত না, এবং আকাশের ঘূর্ণনের সাথেও যার সম্পর্ক নেই।
যে তথ্য আমরা চাচ্ছি, তা হয়ত সমুদ্রের মাঝেই পাওয়া যাবে, যা আকাশের সাথে সম্পর্কিত না।
যদি পৃথিবী সমতল হত, তাহলে একটা জাহাজ যত দূরে যাবে তত ছোট হতে থাকবে, শেষে একটা বিন্দুতে পরিণত হবে এবং একসময় আর দেখা যাবে না তাকে।
তবে তা ঘটে না।
দূরে যেতে থাকলে একটা নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত পুরো জাহাজটাই দেখতে পাওয়া যায়। জাহাজের উপরের পাল আর নিচের কাঠামো দুটোই দেখা যায়। কিন্তু একটা দুরত্বে যাওয়ার পর জাহাজের কাঠামোটা আর দেখা যায় না, তবে পাল তখনো দেখতে পাওয়া যায়। মনে হয় পানি জাহাজের উপরে উঠে এসেছে আর জাহাজটা হয়ত ডুবতে বসেছে। একসময় মনে হয় পুরো জাহাজটাই ডুবে যাচ্ছে পালসহ, তখন শুধু পালের উপরের প্রান্ত দেখতে পাওয়া যায়।
এর কিছু সময় পরে আর কিছুই দেখতে পাওয়া যায় না। যেন পুরো জাহাজটাই ডুবে গেছে।
কিন্তু তা তো হয় না। বেশিরভাগ জাহাজই দেখা যায় আবার নিরাপদে ফেরত আসে। এবং কোন নাবিকের কাছেই জাহাজের পাল পর্যন্ত পানি উঠে যাওয়ার গল্প কেউ শোনেনি কোনদিন।
তাহলে এর ব্যাখ্যা কী হতে পারে?
তবে এর একটা ব্যাখ্যা দেয়া যায়। ধরুন, পৃথিবীর পৃষ্ঠটা আসলে সমতল না, বক্রাকার। সেই ক্ষেত্রে একটা জাহাজ যখন বাঁকা পৃষ্ঠের ওপর দিয়ে যাবে, পৃষ্ঠের বক্রতার কারণে তা ধীরে ধীরে তার নিচের অংশ থেকে অদৃশ্য হওয়া শুরু করবে। ব্যাপারটা আকাশের তারাদের মতই।
তবে একটা পার্থক্য আছে, সেটা বিশাল।
আকাশের তারাগুলো অদৃশ্য হয় শুধুমাত্র উত্তর দক্ষিণ বরাবর, কিন্তু আকাশের ঘূর্ণনের কারণে পূর্ব পশ্চিম বরাবর কী হয়, নিশ্চিত হওয়া যায় না।
তবে জাহাজের ক্ষেত্রে, সে যে দিকেই যাক না কেন একইরকমভাবে অদৃশ্য হয়- নিচের কাঠামো থেকে শুরু করে ধীরে ধীরে পালের উপর পর্যন্ত। এবং আরও মজার ব্যাপার হল, সবদিকেই অদৃশ্য হওয়ার সময়টুকু সমান, মানে একই বেগে অদৃশ্য হয়। যদি একটা জাহাজ দুই মাইল দূরে থাকে, তবে কাঠামোর একটা নির্দিষ্ট অংশ পর্যন্ত অদৃশ্য হয়, যেদিকেই জাহাজ যাক না কেন। বোঝা যাচ্ছিল, পৃথিবীর পৃষ্ঠ হয়ত সবদিকেই বাঁকানো, এবং মোটামুটি একই পরিমাণে।
কিন্তু সবদিকে বাঁকানো পৃষ্ঠ, তাও আবার সমান পরিমাণে- এই রকম আকৃতি আছে মাত্র একটি। সেটি হল গোলক। আপনি যদি একটি ফুটবল নিয়ে সেটার উপর একটা বিন্দু আঁকেন আর সেই বিন্দু থেকে কয়েকটা রেখা যে কোন দিক বরাবর এঁকে ফেলেন, তখন দেখতে পাবেন সবগুলো রেখাই সমান পরিমাণ বাঁকানো।
জাহাজ যেভাবে সমুদ্রে অদৃশ্য হয়, তা থেকে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় পৃথিবী আসলে সিলিন্ডার না, বরং ফুটবলের মত গোল। সেই গোলকটা মোটামুটি বিশাল আকারের যেটা কিনা আবার তার চেয়েও বিশাল আকাশের কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
যেহেতু আমরা খুব ছোট একটা অংশ আমাদের চোখ দিয়ে দেখি, তাই আমাদের কাছে পৃথিবীর পিঠটা সমতল লাগে।
তবু একটা প্রশ্ন মনে থেকে যায়। আমরা কেন পিছলে পড়ে যাই না পিঠ বাঁকানো পৃথিবী থেকে? আর সমুদ্রের পানিই বা কেন পৃথিবী থেকে উপচে পড়ে না? অন্য কিছু কি আছে যা আমাদের এই প্রশ্নের উত্তর দিতে পারবে? পৃথিবীর আকার সম্পর্কে একশ ভাগ নিশ্চিত করতে পারবে?
তা আছে। কিন্তু সে জন্য আমাদের ফিরতে হবে আকাশে।
(চলবে)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।