ঘড়ির কাঁটার মত টিক টিক করে সময় যখন সামনের দিকে এগিয়ে চলে, ঠিক সেরকম বদলে যেতে পারি না কেন
রুম নম্বরঃ ২৩। আমরা চার বন্ধু থাকি। চলুন পরিচয় করিয়ে দেই তাদের সাথে।
নাহিয়ান – গার্লফ্রেন্ড, বই এই দুই নিয়েই তার জীবন। ভাল গান গায়, তবে লাজুক এই ছেলেটি কোন প্রোগ্রামে গান করতে পারল না আজও।
অবশ্য এই নিয়ে তার কোন আক্ষেপ নেই। সে আছে প্রথম দুইটা নিয়ে। ওহ! বলতে ভুলেই গেছি, এত ভাল গলা কিন্তু তার গান গার্লফ্রেন্ডের ভাল লাগে না। বড়ই আফসোস!
মাঞ্জার – মা, বাবা টিচার। সেও টিচার হওয়ার পথে।
তবে অন্য সব ফার্স্ট থেকে ব্যাতিক্রম। ভাল খেলাধুলা করে। তার মত ফাজিল খুব কমই আছে।
সাদমান – সাস্থ্যের প্রতি বেশ যত্নবান। রেগুলার জিম করে।
ভদ্র ছেলে। লেখাপড়ায় আমার চেয়ে অমনযোগী। কারন প্রথমটার জন্য তার বেশ সময় দিতে হয়, রাত জাগতে পারে না। তারপরও নাকি মুটিয়ে যাচ্ছে!
আমি – গুণহীন। ফারিয়ার মতে বোহেমিয়ান লাইফ স্টাইল।
ফারিয়ার কারণে ক্যম্পাসে আলোচিত ও সমালোচিত। রুমমেটদের কাছে ঈর্ষার পাত্র। একাডেমিক খরচ বড় ভাই দেয়। মাস শেষে পুঙ্খানুপুঙ্খ হিসাব দিতে হয়। নিজের খরচ চালাই টিউশনি করে।
সাত দিন ধরে প্রচণ্ড শৈত্যপ্রবাহ চলছে। সূর্যের দেখা মাঝে মাঝে মিললেও ঠাণ্ডা মোটেই কমছে না। গত রাতে মাঞ্জার এর সাথে এই নিয়ে কথা হচ্ছিল।
মাঞ্জারঃ তোর তো লেপ এর কাভার নেই। এক কাজ কর কম্বলটা সেলাই করে নে কাভারের মত।
শুনতে খারাপ হলেও বুদ্ধিটা খারাপ না। ভেবে দেখার মত। পুরাই ইউনিক ব্যাপার।
আজ ঘুম ভেঙ্গে দেখি ১১.৩৭ বাজে। ফ্রেশ হতে হতে ১২টা বাজবে।
এসব দিনে আমি আর কষ্ট করে দুপুরের নাস্তা করি না (১২ টার পরের নাস্তাকে সকালের নাস্তা বলা আমার মতে অনুচিত)। তাই আর কিছুক্ষণ ঘাপটি মেরে থেকে ১২.৩০ এ গোসল করে ১টায় খেতে যাব। নাস্তার টাকাটা সেভ। নিচ তলার বাসিন্দাদের কি হয়েছে জানি না। কানে তালি লাগানো ডেথ মেটাল ছেড়ে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনছে।
তুমি কোন্ ভাঙনের পথে এলে সুপ্তরাতে
আমার ভাঙল যা তা ধন্য হল চরণপাতে
আমি রাখব গেঁথে তারে রক্তমনির হারে
বক্ষে দুলিবে গোপনে নিভৃত বেদনাতে
রবীন্দ্রসঙ্গীত আমার শুয়ে থাকার ইচ্ছাটা ত্বরান্বিত করছে। এমন সময় কার যেন মোবাইল বেজে উঠল, আমার রিংটোন আবার চুরি করেছে কোন জনা। সাদমান এসে ধাক্কা দেয়াতে বুঝতে পারলাম ফোন আমারটাই বাজছে। এরকম আনন্দঘন মুহূর্তটা মাটি করে দেয়ার জন্য দায়ী কলারকে গালি দিতে গিয়ে দেখি স্ক্রিনে ফারিয়ার নাম।
কি ব্যাপার? আজ তো ফারিয়ার প্রাইভেট থাকার কথা না।
ফোন রিসিভ করা মাত্রই অপজিট এন্ড থেকে রাজ্য জয়ের হাসি। বাসায় কেউ নেই, নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারবে। কিন্তু আমার সিক্সথ সেন্স বলছে আমার জন্য নিরাপদ নয়। আমার সেন্স ফারিয়ার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ সময় ঠিক কথা বলে।
ফারিয়াঃ কি করছ?
আমিঃ ঘাপটি মেরে পড়ে আছি।
ফারিয়াঃ খুব ভাল। আচ্ছা শোন, তুমি কবিতা লিখতে পার?
আমিঃ ছোট বেলায় ছড়া লিখতাম, এর পর আর ট্রাই করি নি। কেন?
ফারিয়াঃ অনন্যার বয়ফ্রেন্ড ওকে নিয়ে কি সুন্দর একটা কবিতা লিখেছে।
আমিঃ অনন্যার বয়ফ্রেন্ড কে? ওই ময়লা পাঞ্জাবি,ছাগল দাড়ি?
ফারিয়াঃ কি ব্যাপার তুমি এরকম করে কথা বলছ কেন?
আমিঃ ওহো! তোমার কাছে সে তো আবার ড্যাম স্মার্ট! তা কয় লাইন লিখতে হবে? আর কবে লাগবে?
ফারিয়াঃ মনে হচ্ছে তুমি ভাড়াটে কবিতা লেখক কিংবা কবিতা বাজার থেকে কিনে আনবে! সাহিত্যের কোন ছোঁয়া নেই তোমার মধ্যে।
আমিঃ (মুখ ফসকে) জানই তো
কিছুক্ষণ মৌনতা।
ফারিয়ার সাথে রিলেশন হওয়ার আগে জানতাম মৌনতা সম্মতির লক্ষণ। কিন্তু পৃথিবীর সমস্ত কবি সাহিত্যিকদের বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ফারিয়া মৌন থাকে যখন রেজাল্ট নেগেটিভ।
ফারিয়াঃ আমি কিছু জানতে চাই না। তুমি কাল কবিতা নিয়ে আসবে। ১১ টায় তোমার ক্যাম্পাসে আসব।
বলেই ফোন কেটে দিল।
মাথার ভিতর কবিতা কথাটা ঘুরতে লাগল।
তুমি যে আমার কবিতা
আমার বাঁশীর রাগিনী
আমার স্বপন আধজাগরণ
চিরদিন তোমারে চিনি
খেয়ে এসে কবিতার টেনশন মাখা ভাত-ঘুম দিলাম। ঘুম থেকে উঠে কবিতা লেখার চেষ্টায় বেশ কয়েকটা পেজ নষ্ট করলাম। কবিতা আসবে কোত্থেকে।
আমি তো আজ পর্যন্ত প্রেমপত্রও লিখি নাই কোনদিন। ব্যর্থতা অস্থিরতায় পরিণত হল।
ব্রেন সিগন্যাল পাঠাতে লাগল, নিকোটিন চাই। ধুম্রশলাকা হাতে নিলাম, হালকা একটা প্রশান্তি। ধোঁয়াটাকে লম্বা দম নিয়ে ফুসফুসে পাঠিয়ে দিলাম।
আহ! কাজ শুরু হয়ে গেছে এখনি। বেড়ে গেছে হার্টরেট, ব্লাড পাম্প। স্বচ্ছ্ব ঝিল্লি, ভেদ করে ফুসফুসের অ্যালভিওলাই’র ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র স্যাক ভরে উঠছে ধোঁয়ায়। এগিয়ে আসছে রেডব্লাডসেল। প্রতি সেলে বহুগুণ অক্সিজেন ধারণ করছে।
সেইসাথে রক্তস্রোতে মিশে যাচ্ছে নিকোটিন। সুন্দরভাবে ঘুম থেকে জাগছে অনেক সেল। অবচেতন মন সচেতন মনকে জানানো শুরু করল নিকোটিন এসেছে। ব্রেন খেলবে এবার, কবিতা উপচে পড়বে।
লিখে ফেললাম-
ফারিয়া আমার নিষিদ্ধ কবিতা
আমি স্বীকৃতিহীন কবি
মোবাইলহীন প্রেম যেন
ব্ল্যাক এন্ড হোয়াইট মুভি
পরদিন ১১ টায় দেখা করতে গেলাম।
বন্ধের দিন হওয়ায় ক্যাম্পাস নীরব। অল্প কিছু স্টুডেন্ট আড্ডা দিচ্ছে। ফারিয়ার দিকে তাকালাম, শীতের কাপড়চোপড় যেন আলাদা একটা মাধুর্য নিয়ে এসেছে তার মধ্যে। উলের টুপি, মাফলার; বিড়াল, বিড়াল একটা ভাব নিয়ে এসেছে। বেয়াড়া চুলগুলোকে কষে পিছনে বেঁধে এসেছে।
তারপরও কিছু অবাধ্য চুল কপালের উপর এসে পড়েছে। চুলগুলো হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু সেটা সম্ভব না।
১০ টাকার বাদাম কিনে শীতের মিষ্টি রোদে বসলাম। বাদাম আমার বেশ ভাল লাগে ( কস্ট ইফেক্টিভ)।
ফারিয়াঃ কবিতা এনেছ?
আমি কবিতা লেখা দুমড়ানো-মুচড়ানো কগজটা বের করে দিলাম।
ফারিয়াঃ (একবার দেখে) বাংলা-ইংলিশ মিশিয়ে এত ছোট কি লিখেছো এটা?
আমিঃ মিশ্রানুকাব্য ও ব্যাস্তানুকাব্য।
ফারিয়াঃ আমাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে না। ভাল হবে না বলে দিচ্ছি। উঠে সোজা হাঁটা দিব।
আমিঃ (আবহাওয়া অনুকূলে মনে হচ্ছে না) ব্যাখ্যা দিচ্ছি। মিশ্রানুকাব্য-মিশ্র ভাষায় লিখিত, ব্যাস্তানুকাব্য-কবির নির্দিষ্ট সময়ে কবিতা ডেলিভারি দেয়া জনিত ব্যাস্ততার মধ্যে লিখিত। আর প্রতিটার শেষে অনুকাব্য সংক্ষিপ্ত আকারের কারণে। ট্যাবলেট পিসির মত এর পরবর্তী সংস্করণ পরমানুকাব্য ।
ফারিয়াঃ ( ফারিয়া হতভম্ব হয়ে গেল) চুপ, একদম চুপ।
কি আবলতাবোল বল এই সব, পাগল হয়ে গেলে নাকি?
আমিঃ হই নি। তবে তোমার আবদার মেটাতে গিয়ে হব এবার।
ফারিয়া মুখ নিচু করল। চোখের কোনে জল চিকচিক করতে লাগল। বাম হাত অটোম্যাটিক উঠে এল তা লুকাতে।
কথা ঘুরানোর জন্য বলল-
ফারিয়াঃ গাঞ্জা খেয়ে লিখেছ নাকি?
এই কথা শুনে প্রচন্ড মেজাজ খারাপ হল। কিন্তু ওই অশ্রু-সজল চোখ আমাকে বিচলিত করে তুলল। এই মেয়েটিকে দুঃখ দেয়ার ক্ষমতা কিংবা ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। তাই রুড কোন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকলাম।
আমিঃ গাঞ্জা এবং ছ্যাঁকা কোনটাই খাই নি, তাই কবিতা ভাল হয় নি।
ফারিয়া চোখ মুছে হাসতে লাগল। মনে হল সে এই রোদ এই বৃষ্টি টাইপ কোন মুভির নায়িকা। আপনার জীবনে কি কখনো এমন একজন এসেছে যে আপনার জীবন কে পুরো বদলে দিয়েছে আপনার জীবনের একটা অংশ হয়ে। যে আপনাকে উপলব্ধি করতে শিখিয়েছে পৃথিবীটা অনেক সুন্দর। ফারিয়া আমার এমনি একজন।
তুমি আমার এমনি একজন
যারে এক জনমে ভালোবেসে
ভরবে না এ মন
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।