কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯৩২ সালে পারস্যরাজের নিমন্ত্রন পেয়ে কলকাতা থেকে বিমানে উঠেছেন এলাহাবাদ হয়ে বম্বে যাবার উদ্দেশ্যে। সেখান থেকে জাহাজে করে পারস্যে। তিনি কলকাতা থেকে যখন বিমানে রওনা হলেন তখনকার অনুভূতি আর লন্ডন থেকে প্যারিস যাবার উদ্দেশ্যে যখন বিমানে উঠেছিলেন সে অনুভূতি- এ দুটোতে যে দুস্তরমত পার্থক্য বিদ্যমান তা তিনি প্রকাশ করেছেন এভাবে, “পূর্বে আর –একবার এই পথের পরিচয় পেয়েছিলুম লন্ডন তেকে প্যারিসে। কিন্তু সেখানে যে ধরাতল ছেড়ে উর্ধ্বে উঠেছিলুম তার সঙ্গে আমার বন্ধন ছিল আলগা। তার জল-স্থল আমাকে পিছুডাক দেয় না, তাই নোঙর তুলতে টানাটানি করতে হয়নি।
এবারে বাংলাদেশের মাটির টান কাটিয়ে নিজেকে শূন্যে ভাসান দিলুম, হৃদয় সেটা অনুভব করলে। "( সূত্র: পারস্যে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পরিচ্ছদ-১) কবি গুরু এই যে বললেন বাংলাদেশের মাটির টান -এটাকে আমরা কি বলব? এর নাম-ই কি দেশপ্রেম? এটাই যদি দেশপ্রেম হয় তাহলে তা সকল মানুষের উপলব্ধিতে, কাজে-কর্মে, চিন্তা ও চেতনায়, মননে ও মগজে সমানভাবে প্রকটিত ও প্রকাশিত হয় কি?
বস্তুত দেশপ্রেম হচ্ছে একটি হৃদয় উৎসারিত উপলব্ধির বিষয়। তাই, এটা শুধুই শেখানোর ব্যাপার নয়; নিজ দায়িত্বে শিখে নেওয়ার বিষয়ও বটে। যদিও পরিবার ও সমাজের কাছ থেকে দেখে-শুনে-বুঝে মানুষ দেশপ্রেমের মহিমায় উদ্ভাসিত হয় তবুও নিজ দায়-দায়িত্ব কে অবহেলা করার সুযোগ নেই। কারণ, কোনটি দেশপ্রেমিকের কাজ আর কোনটি দেশদ্রোহী, সমাজবিরোধদের কাজ সেটা নিজে থেকেই আশেপাশের মানুষদের কর্মকান্ডের মাধ্যমেই ধীরে ধীরে জেনে –বুঝে নিতে হয়; যদিও দেশদ্রোহী, সমাজবিরোধীরা অনেক সময় দেশপ্রেমিক সেজেই সমাজে অর্ন্তঘাতমূলক কর্মকান্ড চালিয়ে যায়।
এ সমস্ত কর্মকান্ডই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, মানুষে মানুষে দেশপ্রেমের উপলব্ধি ও তা প্রকাশে তারতম্যের কথা। কেউ দেশপ্রেমের মহিমায় নিজের জীবন বিলিয়ে দেয় আর কেউ শত্রুর সাথে বন্ধুত্ব করে আয়াসে থাকাটাকেই বাঞ্ছণীয় মনে করে।
এজন্যে-ই একই সমাজে অন্তত আমাদের দেশে দেশপ্রেমিক মানুষের সাথে দেশদ্রোহী কুলাঙ্গারদেরও আমরা দেখতে পাই। অপরিসীম দেশপ্রেমের নিদর্শন হিসেবে যেমন আমরা মোহনলাল, মীরমদন প্রভৃতি দেশপ্রেমিক সূর্যসন্তানদের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি তেমনিভাবে দেশদ্রোহী কুলাঙ্গার হিসেবে মীরজাফর, ঘষেটি বেগম গংদেরও নামও ঘৃণাভরে সমভাবে মনে করি। এ কুলাঙ্গার, ষড়যন্ত্রকারীদের কারণেই ১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিলো।
১৯৭১ এ আবার বাঙালীরা যখন একতাবদ্ধ হয়ে বাংলার স্বাধীনতা ফিরে পাওয়ার আশায় অদম্য সাহস নিয়ে রণাঙ্গনে যুদ্ধে লিপ্ত; ঠিক সেসময় মীরজাফরদের প্রেতাম্তারা আবারো সক্রিয় হয়ে উঠলো। রাজাকার, আলবদর, আলশামস নামক জল্লাদ বাহিণী গঠন করে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনীকে সকল রকম সাহায্য ও সহযোগিতা করে গেলো যেন বাংলার মানুষ চিরকালের জন্য পদানত হয়ে যায়। স্বাধীনতার স্বপ্নসুখ যেন বিলীন হয়ে যায়। কিন্তু তারা সফল হয়নি।
আমাদের পূর্বসুরীরা আমাদের জন্য চরম ত্যাগের বিনিময়ে এ ভূখন্ডটাকে পাকিস্তানী হানাদার মুক্ত করেছিলেন- এটা নতুন করে বলার কিছু নেই।
সেদিন তারা স্বাধীনতা এনেছিলেন বলেই আমরা যারা তরুণ তারা জন্মলাভ করেছি স্বাধীন দেশে, স্বাধীন মানুষ হিসেবে। সত্যি আমরা মহা ভাগ্যবান।
কিন্তু আমরা বর্তমান প্রজন্ম কি স্বাধীনতার মর্মার্থ যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারছি? আমরা কি পরাধীনতা ও স্বাধীনতার ভেতর যে যোজন যোজন মাইলের ব্যবধান তা কি প্রকতপক্ষেই হৃদয়ে ধারন করতে পারছি? স্বাধীন এবং অধীন ব্যক্তির মধ্যে যে তফাৎ তা কি আমরা বুঝতে পারছি? নাকি একরকম স্বাধীনভাবে দিন কেটে যাচ্ছে বলেই আমরা অতীতের এত ত্যাগ আর কষ্টকে এখন আর মনে রাখতে চাইছি না? নাকি আমাদেরকে ইতিহাস ভুলিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তের কাছে আত্মসমর্পন করেছি? স্বাধীন দেশের তরুণ প্রজন্মের প্রতিনিধি হিসেবে এ প্রশ্নগুলোর উত্তর আমাদেরকে বারবার খুঁজে নিতে হবে এবং সে আঙ্গিকে দেশপ্রেমের সর্ব্বোচ্চ নিদর্শন প্রদর্শন করতে হবে আমাদের সকল কাজে-কর্মে, চিন্তা ও চেতনায় ।
আমাদের মাঝে এখন এমন অনেক তরুণ আছে যারা বিভ্রান্তি পড়ে ৭১ এর চেতনার বিপক্ষ শক্তির সাথে হয়ত না বুঝেই হাত মিলিয়েছে। এটা আমাদের জন্য অত্যন্ত লজ্জার ও হতাশার।
তারা স্বাধীন দেশের নাগরিক হয়ে জন্মেছে বলেই কি স্বাধীনতা ও অধীনতার পার্থক্য ভুলতে বসেছে? গায়ক ও গীতিকার শিলাজিতের গানে সে পার্থক্য মূর্ত হয়ে উঠে এরূপে-“তুমি হায় বুঝবে কি ভাই, ফুরফুরে দিন কেটে যাই / বোঝাচ্ছ স্বাধীনতার মানে
যে অধীন দিনে রাতে, বুলেটে যে বুক পাতে / সে বুঝেছে স্বাধীনতার মানে"। সত্যিই স্বাধীনতার মানে বোঝা এত সহজ নয় বলেই বিভ্রান্তি সহজেই জেঁকে বসেছে। ।
তাই, আমরা যারা তরুণ প্রজন্ম স্বাধীনতার স্বপ্নসাধ অন্তরে অনুভব করি আজ তাদের দায়িত্ব অনেক। যারা আজও আমাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে নস্যাত করতে চাই তাদের কাছ থেকে তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করতে হবে অপরাপর সকল মানুষকে স্বাধীনতার মর্মকথা প্রচার ও প্রসারের মাধ্যমে।
স্বাধীনতার মূল্য আমরা ভুলে গেছি বলেই এখনও এক শ্রেণীর বিভ্রান্ত তরুণদের কে আমরা দেখতে পাই যারা খেলার মাঠে মুখে ও গায়ে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে ও হাতে নিয়ে স্টেডিয়ামে হাজির হয়। তার ভুলে যায় এ পতাকা তাদেরেকেই প্রতিনিধিত্ব করছে যারা আমার ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে, ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রম লুটেছে; যারা আমার মায়ের ভাষা বাংলাকে নির্বাসিত করতে চেয়েছিলো। সেটি আমরা এত সহজে ভুলি কেমন করে? বেশ কয়েক বছর আগে Afridi, pls marry me- প্ল্যাকার্ড হাতে জনৈক তরুণীকেও আমরা স্টেডিয়ামে হাজির হতে দেখেছিলাম। স্যাটেলাইটের বদৌলতে সারা বিশ্ব তা দেখেছে। আমরা লজ্জায় হেট হয়েছি।
প্রশ্ন হচ্ছে, এটা কি শুধুই ক্রীড়াপ্রেমিক তরুণ-তরুণীদের খেলার প্রতি ভালোবাসা নাকি পাকিস্তান প্রেমে অতিশয় মশগুল হওয়ার নির্লজ্জ প্রমাণ? এটি শুধুই যে খেলার প্রতি ভালোবাসা ব্যাপারটি তেমন নয় তা বুঝতে হলে ফিরে যেতে হবে অনেকটা পেছনে। সাল, ১৯৭৪। জুলফিকার আলী ভুট্টোর বাংলাদেশ সফরের সময়। তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল ( বর্তমানে রূপসী বাংলা হোটেল) পর্যন্ত রাস্তার দুপাশে দল বেঁধে বিভিন্ন মাদ্রাসার ছাত্র এবং পাকিস্তানী ভাবধারার এক শ্রেণীর বাঙালি দাঁড়িয়ে “ ভুট্টো জিন্দাবাদ", “পাকিস্তান জিন্দাবাদ" ধ্বনি দিয়েছিলো। (সূত্র: রক্ষীবাহিনীর সত্য-মিথ্যা, আনোয়ার উল আলম, ২য় সংস্করন, পৃষ্ঠা-১১৬)
একটু ভেবে দেখুনতো এত জীবন ও সম্ভ্রমের বিনিময়ে যে দেশটি আমরা পেলাম সেই দেশ স্বাধীনের মাত্র আড়াই বছরের মাথায় ঢাকার রাজপথে সেদিন ভুট্টোকে যারা রাস্তার দুধারে দাঁড়িয়ে সংবর্ধনা দিয়েছিলো তারা কারা? ভুট্টোর বাড়াবাড়ি ও চক্রান্তের কারনেই যে ইয়াহিয়া গংরা আওয়ামীলীগকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রক্ষমতায় বসতে দেয়নি এবং ২৫ শে মার্চ থেকে সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে আমাদের নিরস্ত্র মানুষের উপর আক্রমন চালিয়েছে ও লাখ লাখ মানুষকে হত্যা করেছে- তারা কিভাবে তা ভুলে গেলো? দেশ স্বাধীন হওয়ার এত অল্প সময়ের মধ্যে যারা তার ইতিহাসকে পদদলিত করে ভুট্টোকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে সংবর্ধনা দিতে পারে তাহলে স্বাধীনতার এত বছর পরে ফুলে ফেঁপে বড় হয়ে ওঠা ওরা এবং ওদের মগজধোলাইয়ের শিকার হয়ে বেড়ে ওঠা পরবর্তী তরুণ প্রজন্ম মুখে বুকে পাকিস্তানের পতাকা এঁকে খেলার মাঠে হাজির হলে তাকে কি নিতান্তই খেলার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসেবে দেখার ন্যূনতম সুযোগ আছে? নাকি তা প্রবাহমান পাকিস্তানি ভাবধারায় এদেশের একটি তরুণ প্রজন্ম বেড়ে ওঠার অশুভ ইঙ্গিত বহন করে? সে প্রশ্ন আপনাদের কাছে রইলো।
আজকের এমন অবস্থা দেখে মনে প্রশ্ন জাগে, মাত্র ৯ মাস যুদ্ধ করেই আমাদের অগ্রজরা স্বাধীনতা অর্জন করেছিলো বলেই কি আমরা আমাদের স্বাধীনতার মর্মকথা ভুলতে বসেছি? এ কারনেই কি স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আমাদের এমন উন্নাসিকতা? অন্তত আবুল মনসুর আহমেদের জবানীতে তেমনই মনে হয়। তিনি বলছেন, “এটা স্বীকার করিতেই হইবে, ভারতের সহায়তায় আমরা বড় তাড়াতাড়ি স্বাধীনতা পাইয়া ফেলিয়াছিলাম। বস্তুত নয় মাস সংগ্রামে স্বাধীনতা আর কোন জাতি পাই নাই। " ( সূত্র: আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, নয়া অধ্যায়: স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, পৃষ্ঠা-৫৯৩)
আমরা যাই বলি না কেন এটা আজ দিবালোকের মতো স্পষ্ট যে,আমাদের তরুণ প্রজন্মের একটা অংশ আজ পুরোপুরি বিভ্রান্ত। তাদের অনেকেই হয়ত না জেনে বুঝেই স্বাধীনতা বিরোধদের সহযাত্রী হয়েছে।
আর অনেকে সত্য-মিথ্যার মিশেলে জগাখিচুড়ি ইতিহাস জেনে হয়েছে না ঘরকা না ঘটকা গোছের। তাই আমরা (তরুণ প্রজন্মের যে বৃহত্তম অংশটি) যারা স্বাধীনতার মর্মকথা উপলব্ধি করি বলে দাবি করি তাদের দায়িত্ব অনেক বেশি। নিজে সত্যিকারের ইতিহাস জানতে হবে এবং তা তুলে ধরতে হবে। তবেই হয়ত এক সময় অমানিশার মেঘ কেটে ভোরের আলোক রশ্মি দৃশ্যমান হবে। সে সুদিনের প্রতীক্ষায় রইলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।