ছাগুরা ১০০ হাত দূরেথাক। হনুরা দূরেথাক ২০০ হাত। আর হনু নামধারী চটিলেখকগো দেখামাত্র পিডামু।
আল্লারাখা রহমান। এআর রহমান নামে অবশ্য তিনি সবার কাছে সমান পরিচিত।
ভারতের এ সংগীতজ্ঞ, কম্পোজার, গীতিকার, মিউজিক প্রডিউসার এবং মিউজিশিয়ান হিসেবে যতোখানি সমাদৃত, একজন মানবহিতৈষী হিসেবে কম তার চেয়ে কম শ্রদ্ধার্হ নন। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে প্রভাবশালী মিজউজিয়ান বলা হয় তাকে। তার কম্পোজিশনের বিভিন্ন যন্ত্র, অভিনব সব বিষয়ের ব্যবহার এবং ফিউশন যে কাউকে সম্মোহিত করতে পারে। তিনি চিরাচরিত ঐক্যতানের (অরকেস্ট্রা) ধারণাই বদলে দিয়েছেন। সংগীতে এনেছেন নতুন ও বৈপ্লবিক ধারা।
আর এর স্বীকৃতিও পেয়েছেন অঢেল। ঝুলিতে ভরেছেন সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড বা অস্কার।
১৯৬৭ সালের ৬ জানুয়ারি ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যের চেন্নাইয়ে (মাদ্রাজ) ঐতিহ্যবাহী মুদালিয়ার তামিল সংগীত অন্তঃপ্রাণ এক পরিবারে এআর রহমানের জন্ম। তার নাম রাখা হয় এএস দিলীপ কুমার। বাবা আর কে শেখর ছিলেন তামিল ও মালায়লাম চলচ্চিত্রের সংগীত পরিচালক।
ছোট্ট রহমান বাবার অ্যাসিস্টেন্ট ছিলেন। সেই থেকে বলতে গেলে বাবার হাতেই সংগীত যন্ত্রে তার হাতেখড়ি। সিনেমার গান রেকর্ড করার সময় বাবার কি-বোর্ড নাড়াচাড়া করতেন। কিন্তু এ সুযোগ তিনি বেশিদিন পাননি। মাত্র নয় বছর বয়সে বাবা মারা যান।
এরপরই তার পরিবার অর্থকষ্টে পড়ে। বাবার সংগীত যন্ত্রগুলো ভাড়া দিয়ে চলতো তাদের সংসার। মা কস্তুরির অপত্য স্নেহে বড় হন। অবশ্য সংগীত চর্চা থেমে থাকেনি তার।
প্রথম দিকে কি-বোর্ড প্লেয়ার হিসেবে কাজ করতেন এএস দিলীপ কুমার।
এসময় শৈশবের বন্ধু মিউজিশিয়ান শিবামানির সঙ্গে জন অ্যান্থনি, সুরেশ পিটার, জোজো এবং রাজাকে নিয়ে ‘রুট’ নামে একটি ব্যান্ড দল গঠন করেন। চেন্নাইয়ের রক ব্যান্ড ‘নেমেসিস অ্যাভেনিউ’ এরও প্রতিষ্ঠাতা তিনি। কি-বোর্ড, পিয়ানো, সিনথেসাইজার, হারমোনিয়াম এবং গিটারসহ বেশ কিছু সংগীত যন্ত্রে তার রয়েছে অসারধাণ দক্ষতা। তবে বিশেষ করে সিনথেসাইজারে তার অন্যরকম আসক্তি। সংগীতে তার আদর্শ হলো- পূর্ব, পশ্চিম, আফ্রিকা সব সংগীত ধারা এবং প্রযুক্তির সমন্বয়।
প্রথম জীবনে এআর রহমান ওস্তাব ধনরাজের তালিম নেন। মাত্র ১১ বছর বয়সে বাবার বন্ধু মালায়লাম কম্পোজার এমকে অর্জুনানের অরকেস্ট্রাতে বাজানোর সুযোগ পান। খুব শিগগিরিই সেসময়ের প্রখ্যাত মিউজিশিয়ানদের সঙ্গে বাজান এবং জাকির হোসেন, কুন্নাকুদি বিদ্যানাথান এবং এল শঙ্করের সঙ্গে বিদেশে বেশক’টি ট্যুরে যান। এরপরই লন্ডনের ট্রিনিটি কলেজে স্কলারশিপ পান তিনি। ওই কলেজ থেকে স্নাতক হওয়ার পর পশ্চিমা সংগীতের ওপর ডিপ্লোমা করেন।
এরপরই এএস দিলীপের জীবনে ঘটে অভাবনীয় এ ঘটনা। সেটা ১৯৮৪ সালের কথা। ছোট বোন হঠাৎ প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ে। কোনো ডাক্তার বৈদ্যে কাজ না হওয়ায় তার মা আজমীর শরিফের শরণাপন্ন হন। এবং এতে তার বোন অলৌকিকভাবে সেরে ওঠেন।
এ ঘটনার পর থেকেই মা ইসলামের সুফি ধারায় অনুরক্ত হয়ে পড়েন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৯৮৯ সালে ২৩ বছর বয়সী এএস দিলীপ কুমার সপরিবারে ধর্মান্তরিত হয়ে মোসলমান হন। তার নাম রাখা হয় আল্লা রাখা রহমান। মা কস্তুরি হয়ে যান করিমা।
বাবার আদর্শের এক নাস্তিক পরিবার এভাবেই কাদিরি তরিকার এক ধর্মপ্রাণ মুসলিম পরিবার হয়ে যায়।
এআর রহমানের ক্যারিয়ার শুরু হয় মূলত ১৯৯২ সালে যখন তিনি নিজ বাড়িতে ‘পঞ্চাথান রেকর্ড ইন’ নামে একটি রেকর্ড ও মিক্সিং স্টুডিও চালু করেন। খুব দ্রুতই এটি ভারতে এবং পরে এশিয়ার সবচেয়ে চৌকস রেকর্ডিং স্টুডিও হিসেবে পরিচিতি পায়। শুরুর দিকে তিনি বিভিন্ন ডকুমেন্টারি, বিজ্ঞাপনের জিঙ্গল, ভারতীয় টিভি চ্যানেলের বিজ্ঞাপন এবং কিছু প্রকল্প নিয়ে কাজ করতেন। ১৯৮৭ সালে তখনো তিনি এআর রহমান নন দিলীপ কুমার- আলৌইন শীর্ষক একটি জিঙ্গেল কম্পোজের সুযোগ পান যা অনেক বেশি মানুষের কাছে পরিচিতি পেতে তাকে সহায়তা করে।
তখন তিনি পরিচালক মনি রত্নমের নজরে আসেন। রত্নমের তামিল ‘রোজা’ চলচ্চিত্রে সংগীত পরিচালনা করেন তিনি। এরপর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। রোজা নির্মাণের সময়ই চিত্রনাট্যকার সন্তোষ শিবান মালায়লাম চলচ্চিত্র ‘যোধা’ এ এআর রহমানকে চুক্তিবদ্ধ করান। এ চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেন সন্তোষের ভাই সংগীত শিবান।
এটি মুক্তি পায় ১৯৯২ সালের সেপ্টেম্বরে।
মায়ের সঙ্গে এআর রহমান
আর প্রথম সুযোগেই বাজিমাত করেন রহমান। রোজা চলচ্চিত্রে ন্যাশনাল ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা সংগীত পরিচালকের পুরস্কার ‘রজত কমল’ পান তিনি। এরপর আরো তিনবার এ পুরস্কার পেয়েছেন: তামিল ‘মিনসারা কানাভু’, হিন্দি ‘লগন’ এবং তামিল ‘কান্নাথিল’। কোনো কম্পোজার এই রেকর্ড করতে পারেননি।
শুধু কম্পোজার বা সাউন্ডট্র্যাক নয় আবহসংগীতেও তার প্রতিদ্বন্দ্বী এখনো কেউ নেই। রোজা, যোধা, থিরুডা থিরুডা, বোম্বে, দিল সে, লগন, ওয়ারিওর্স অব হেভেন অ্যান্ড আর্থ, দ্য লিজেন্ড অব ভগত সিং, স্বদেশ, মঙ্গল পান্ডে, গুরু, জোধা আকবর, স্লামডগ মিলিয়নেয়ার, এনথিরান এবং ১২৭ আওয়ার্স এই চলচ্চিত্রগুলোতে তার আবহসংগীত ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। তিনি ‘জয় হো’ এবং ‘ও সাইয়া’ গান দুটি গাওয়া ও কম্পোজিশনের জন্য স্লামডগ মিলিয়নেয়ার চলচ্চিত্রে সেরা আবহসংগীতে অস্কার জেতেন।
শুধু সিনেমায় মিউজিক কম্পোজিশনের মধ্যেই নিজেকে আবদ্ধ রাখেননি এআর রহমান। ভারতের ৫১তম স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৯৯৭ সালে তার অ্যালবাম ‘বন্দে মাতরম’ বাজারে আসে।
চলচ্চিত্রের বাইরে কোনো অ্যালবাম ভারতে এ-ই প্রথম এতোটা ব্যবসাসফল হয়। এরপর ভারতের ধ্রুপদ সংগীত নিয়ে ‘জন গণ মন’ মিউজিক ভিডিও বের করেন যাতে ভারতের সেরা সব শিল্পীরা পারফর্ম করেন।
১৯৯৯ সালে জার্মানির মিউনিখে মাইকেল জ্যাকসনের কনসার্টে কোরিওগ্রাফার শোবানা এবং প্রভুদেবার সঙ্গে কাজ করেন। এরপর তিনি অনেকগুলো অ্যালবাম ও মিউজিক ভিডিওতে কাজ করেছেন।
২০০৪ সালে তিনি বিশ্বভ্রমণে বের হন।
সিঙ্গাপুর, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া, দুবাই, যুক্তরাজ্য, কানাডা এবং যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপাক সাড়া ফেলেন। ২০০৯ সালের ২৪ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র সফরে তিনি হোয়াইট হাউজে কনসার্ট করেন এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার আমন্ত্রণে ডিনারে অংশ নেন।
২০১২ সালের লন্ডন অলিম্পিকের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের জন্য স্লামডগ মিলিয়নেয়ার পরিচালক ড্যানি বয়েলের আয়োজনে একটি পাঞ্জাবি গানের কম্পোজিশন করে দেন এআর রহমান।
২০১২ সালে ডিসেম্বরে তিনি শেখর কাপুরের সঙ্গে মিলে ‘কিয়ুকি’ (qyuki) নামে একটি সোশ্যাল নেটওয়ার্কে ওয়েবসাইট তৈরি করেন। এখানে যে কেউ তাদের নিজস্ব চিন্তা নিয়ে লিখতে পারে।
২০১২ সালের ২০ ডিসেম্বর এআর রহমানের একক অ্যালবাম ‘ইনফিনিট লাভ’ বাজারে আসে। এটি হিন্দি ও ইংরেজি দুই ভাষাতেই। এটা মূলত মায়া ক্যালেন্ডারে বর্ণিত পৃথিবীর শেষ দিনটি উপলক্ষে বিশ্ববাসীর আশা, শান্তি আর ভালোবাসা ছড়িয়ে দেয়ার প্রয়াসে তিনি অ্যালবামটি করেন।
কিংবদন্তী কম্পোজার এআর রহমানের গানকে কোনো ঘরানার মধ্যে আবদ্ধ করা যায় না। তিনি কর্ণাটকি, পশ্চিমা, হিন্দুস্থানী এবং নুসরাত ফতেহ আলী খানের কাওয়ালী সব স্টাইলই অনুসরণ করেন।
বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এগুলোর ফিউশন তার প্রধান বৈশিষ্ট্য।
ব্যক্তিগত জীবনে এআর রহমান তিন সন্তানের বাবা। স্ত্রী সায়রা বানু এবং তিন সন্তান খাদিজা, রহিমা ও আমিনকে নিয়ে তার সুখের সংসার। তার ছেলে-মেয়েরাও সিনেমার গানে কণ্ঠ দিয়েছে।
মানবহৈতষী কাজেও রয়েছে তার যথেষ্ট অংশগ্রহণ।
২০০৪ সালে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার স্টপ টিবি পার্টনারশিপ প্রকল্পের গ্লোবাল অ্যামবেসেডর হন তিনি। সেভ দ্য চিলড্রেনেরে সঙ্গেও কাজ করছেন। এছাড়া ইউসুফ ইসলামের ‘ইন্ডিয়ান ওশান’ এও কাজ করেছেন। গানটির মাধ্যমে ২০০৪ সালের সুনামিতে বান্দা আচেহ অঞ্চলে এতিম হয়ে যাওয়া শিশুদের সহায়তার জন্য তহবিল সংগ্রহ করা হয়। চেন্নাইয়ের উদ্বাস্তু নারীদের নিয়ে নির্মিত স্বল্পদৈর্ঘ্য সিনোমা দ্য বেনিয়ান এর জন্য থিম সং কম্পোজ করেন এআর রহমান।
এতেই শেষ নয়। এআর রহমানের সাফল্য ও যশ বর্ণনার জন্য এ ক্ষুদ্র পরিসর যথেষ্ট নয়। এছাড়াও তিনি এখন খ্যাতির শীর্ষে, তার অর্জন করার বাকি আছে হয়ত আরো কিছু। সংগীতে হয়ত আরো নতুন ধারণা, নতুন কিছু উপহার নিয়ে তিনি অপেক্ষা করছেন।
বাংলামেইল
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।