আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দিলীপ চক্রবর্তী: আমার দ্রোণাচার্য বেঁচে নেই

নিজের ভাবনা অন্যকে জানাতে ভালো লাগে। কিছু লেখা আছে ভয়ানক কষ্টের, বুক ফাঁটা কান্নার! আমি সেই কান্নার লেখা লেখছি। অস্বীকার করছি না বিলাপে শুধু শোক থাকে না, থাকে শোক প্রকাশের গৌরবও। এই গৌরবময় স্মৃতিচারণের জন্য আমাকে ফিরে যেতে হবে প্রায় দুই দশক আগের স্মৃতিতে। আমরা ক’জন স্কুলপড়–য়া কিশোর মারবেল ফেলে লাটিম খেলা ছেড়ে কেউ কবি হতে চায়, কেউ গায়ক কেউ বা মঞ্চ নাটকের নায়ক।

আমাদের এই বদলে যাওয়ার কারণ আমাদের পাড়ায় এক আগন্তুক এসেছে। দুধে আলতা গায়ের রঙ, ব্যাকব্রাশ করা চুল আর পাতলা ঠোঁটের উপর হালকা গোফের এই মানুষটার নাম দিলীপ চক্রবর্তী। প্রকাশ দিলীপদা প্রকাশ পলাশের মামা। পলাশ তার ভাগ্নে, না আপন ভাগ্নে নয়, আপন বোন তার একটাই সেটার তখনো বিয়ে হয়নি। গ্রামের কেমন এক দূর-সম্পর্কের বোন।

অসুস্থ পিতার চিকিৎসা আর ক্রমশ লায়েক হয়ে উঠা বোনকে বিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব পড়েছে তার কাঁধে। তাই যে করেই হোক একটা চাকরি তার যোগাড় করতেই হবে। বোনের দুই ছেলে মেয়েকে পড়ানোর বিনিময়ে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা হলো, সেই ফাঁকে চাকরি খোঁজা। কিন্তু আমরা ছেলেপুলের দল যে তাকে ছাড়ার পাত্র নয়, সকাল হলেই তার বোনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে, দিলীপদা বাসায় আছে? সন্ধ্যা হলেই দিলীপদা বাসায় আছে? তার খিটখিটে স্বাভাবের ভগ্নিপতি কখনো ঘরে থাকার পরও মুখে মহাবিরক্তির চিহ্ন একেঁ ‘নেই’ বলে বিদায় দেয়, কখনো জানলার ফাঁক দিয়ে চুপিসারে আমরাই ডেকে নেই, তারপর দলাপুকুরের পাড় কিংবা পানাপুকুরের পাড়ে বসে আমাদের আড্ডা। না, ঠিক আড্ডা নয়, তিনি বলতেন আমরা শুনতাম।

মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনতাম। কী অসাধারণ বলার ঢং ছিল, যেন কবিতা পড়ছে। তখন তার মুখে শুনেছি, মেট্রিক পরীক্ষা চলাকালিন সময় তাঁর মায়ের মৃত্যু হয়, তাই প্রথমবার পরীক্ষা খারাপ করায় দ্বিতীয়বারে পাস করেছে, তার মুখে পরীক্ষা ফেলের কথা শুনে আমাদের সাহস গেল বেড়ে, এমন মানুষও পরীক্ষায় ফেল করে! টাঙ্গাইলের কোন এক কলেজ থেকে ইন্টার মিড়িয়েট পাস করে ঢাকায় গিয়েছিল চাকরির খোঁজে, না চাকরি নয়, জড়িয়ে পড়লেন নাটকের সাথে, সম্ভবত লোকনাট্য দলের সাথে, যে দলের প্রধান ছিলেন সালাউদ্দিন লাবলু। কিন্তু পরিবারের চাপের কারণে তাকে নাটক ছেড়ে চট্টগ্রাম আসতে হয়, যদি একটি চাকরি পাওয়া যায়, কিন্তু চাকরি যে সোনার হরিণ তাও আবার ইন্টার পাসের চাকরি। মনে পড়ছে তাঁর সাথে প্রথম আলাপের কথা, তিনি তাঁর ঘরের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন, তার পাশের ঘরে থাকতেন আমার সহপাঠি, স্কুলে যাবার জন্য তাকে ডাকতে গিয়েছিলাম।

নাকে ভোতকা গন্ধ এসে লাগায় আমি মুখে বিরক্তির চিহ্ন এঁকে বলে উঠলাম ছিঃ কি বাশ। তিনি সুবোধ বালকের মতো আমাকে প্রশ্ন করে বসলেন, বাঁশতো আমি দেখছি না। তিনি তখনো জানতেন না চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষায় দুর্গন্ধকে বাশ বলে। সেই বন্ধু পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন, ইবে আঁরার পলাশ্যার মামু (এটা আমাদের পলাশের মামা) বলে। তারপর তিন বছর আমাদের জীবন শুধুই দিলীপদাময়।

এরপর একদিন মাথায় বাজ পড়লো, টাঙ্গাইল থেকে খবর এলো দিলীপদার পিতা মৃত্যু শয্যয়। কিন্তু তার কাছে বাড়ি যাবার টাকা নেই, আমরা সব বন্ধুরা মিলে তার বাড়ি যাবার টাকা যোগাড় করলাম। তিনি বাড়ি গেলেন, পরে ডাকযোগে সেই টাকা আমাদের কাছে ফেরত আসলো সেই সাথে চোট্ট চিরকূটে লেখা হলো পিতা আগেই মারা গেছে, আমার কাছে খবরটা গোপন রাখা হয়েছে মাত্র। আমি এখন ঢাকায় দেখি চাকরি-বাকরি কিছু হয় কিনা, বোনটাকে বিয়ে দিতে হবে। এরপর আর বছর তিনেক কোন খবর নেই, না, আমরা একটা মুহূর্তের জন্যেও ভুলতে পারিনি দিলীপদার কথা, আমাদের কথা তাঁর মনে ছিল কিনা সেটা বলতে পারছি না।

একদিন আমাদের আড্ডার শ্রমিক বন্ধু দিলীপদার সার্বণিক সঙ্গী পেয়ারু দিলীপদাকে খুঁজে বের করতে রওনা দিলেন ঢাকার উদ্দেশ্যে। ঢাকার নাটক পাড়ায় খবর নিলে দিলীপদার খোঁজ পাওয়া যেতে পারে এটাই ছিল তার এক মাত্র ভরসা। তিনদিন পর পেয়ারু ঢাকা থেকে ফিরে এলো দিলীপদার খবর নিয়ে, হ্যাঁ ঠিকই সে দিলীপদাকে খুঁজে বের করেছে, তবে আমাদের দিলীপদা নাকি আগের সেই দিলীপদা নেই! অনেক বদলে গেছে বড় চাকরি করে, একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে, নিয়মিত নাটক করে অনেক বড় বড় মানুষের সাথে তার চলাফেরা। পেয়ারুর সাথে আলাপেও নাকি খুব আন্তরিক ছিলেন না দিলীপদা। খুব আগ্রহ নিয়ে জানতে চাইলাম, আমার কথা কিছু বলেনি? পেয়ারু মুখের উপর বলে দিল - না।

বুকের ভিতর চাপা অভিমান জমা হলো। মনে মনে ইচ্ছা রাখলাম একদিন দেখা করবো অবশ্যই, সেদিন দু’কথা শুনিয়ে দিব। সত্যি সত্যি একদিন ঢাকা যাবার উপল এলো, পেয়ারু থেকে আগেই নিয়ে রেখে ছিলাম দিলীপদার ঠিকানা আর ফোন নাম্বার। ঢাকা গিয়ে বুঝলাম পেয়ারু মিথ্যে বলেনি, সত্যিই দিলীপদা অনেক বড় হয়ে গেছে। চাকুরি করছে দেশ নাটকে, পাশাপাশি চালিয়ে যাচ্ছেন মঞ্চের কাজ।

সম্ভবত তখন তার নিত্যপূরাণ নাটকের কাজ চলছে পুরোদমে। কিন্তু দিলীপদা ঠিক আগের মতই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরলেন, আগের মতই তার অন্তরঙ্গতা। অনেক কথায় হলো, সে কথা বিনিময়ে জানতে পারলাম ঢাকায় এসে গ্রেজুয়েসনটা কমপ্লিট করেছেন, ভাল করে শিখে ফেলেছেন কম্পিউটার অপারেটিংটাও, বর্তমান চাকরিতে তার মাইনে বিশহাজার টাকা। কিন্তু এত আলাপের পরেও আমি কিছুতেই যেন স্বাভাবিক হতে পারছি না। কিছু সময় পর দিলীপদা আমাকে নিয়ে গেলেন একটা টি’স্টলে।

অনেকণ বুকের ভিতর চেপে রাখা ক্ষোভ এবার প্রকাশ করার উপলটা পেয়ে গেলাম, বললাম, দাদা সুসময় আসলে দুঃসময়ের বন্ধুদের এভাবে ভুলে যাওয়া উচিত নয়, পেয়ারু আপনার জন্য...। কথা পুরো শেষ করতে পারলাম না, দিলীপদা তার ঐতিহাসিক অট্টহাসিতে আমার কথা থেমে গেল, এবার ধীরে ধীরে বলতে শুরু করলো, এতণে বুঝলাম তোমার গাল ফুলিয়ে রাখার কারণ, এবার হঠাৎ করে উদাসভাবে আকাশের দিকে তাকালেন, তারপর বলতে শুরু করলেন, জসিম আমার নিকট-আত্মীয় বলতে তোমরা ছাড়া আর কে আছে? পেয়ারু আমার কাছে এসেছে সে ঢাকায় থেকে নাটক করতে চায়। সে যদি সব ফেলে নাটক করে তবে তার বিধবা মা বিবাহ উপযুক্ত বোন আর ছোট ভাইয়ের কী হবে বলোতো। সত্যিই দিলীপদা মিথ্যে বলেননি। তার কথা শুনে বুক থেকে যেন একটা পাথর সরে গেল।

আবারও দীর্ঘবিরতি, এবারের সাক্ষাতে দিলীপদা স্বয়ং আমার ঘরে এসে হাজির। ঘাড়অবধি নামানো লম্বা চুল, মুখে সেই ঐতিহাসিক মনজুড়ানো হাসি। বললেন, নাটকের দল নিয়ে এসেছেন। তার নাটক দেখতে যেতে হবে। আমরা সব বন্ধুরা দলবেঁধে তার নিত্যপূরাণ নাটকটা দেখলাম।

রক্ত হিম হয়ে আসা সেই নাটক একলব্য চরিত্রে দিলীপদার দুদান্ত অভিনয় দেখলাম। নাটক শেষ মঞ্চ থেকেই ঘোষিত হলো, নিত্যপূরাণ নাটক কলকাতা একটা বিশেষ পুরস্কারে ভূষিত হলো এবং একলব্য চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দিলীপদা বাসাস পুরস্কার পেয়েছেন। আবারও তাকে হারিয়ে ফেললাম, যোগাযোগ নেই এদিকে আমিও ২০০৫সালের চলে গেলাম ঢাকায়, ঢাকায় যাবার পর মনে মনে খুঁজছি কোথায় গেলে আবার দিলীপদাকে পেতে পারি। একদিন সেই কাঙ্ক্ষিত সুযোগ এলো ভোরের কাগজের অফিসে বন্ধু অশোক দাশগুপ্তের সাথে আড্ডা দিচ্ছিলাম সেই আড্ডায় আমাকে কামাল উদ্দীন কবিরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন অশোক। কামাল ভাইয়ের কাছে পেলাম আবারও দিলীপদার মোবাইল নাম্বার।

ততদিনেতো নিজের হাতেই একটা মোবাইল চলে এসেছে। যোগাযোগটাও হয়ে গেল অনেক সহজ। আমাদের যোগাযোগে আর কখনো ছেদ পড়েনি। আলাপের সেই স্মৃতিগুলো আজও কানে বাজে। তার সাথে অসংখ্য আলাপের মধ্যে থেকে একটা কথা যখন মনে পড়ে আমি রীতিমতো শিউরে উঠি।

সেটা ছিল হাঁড়কাঁপানো শীতের রাত, কুয়াশা ঠেলে তার সাথে দেখা করতে গেলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে। তিনি সেখানে মাঝেমধ্যে ব্যাডমিন্টন খেলতে আসতেন। আমি আসার পর তিনি রেকেটটা অন্যের হাতে দিয়ে ছুটে আসলেন আমার সাথে আলাপ করতে। সেই দিন আমরা প্রায় মধ্যেরাত পর্যন্ত আলাপ করে ছিলাম। সেই আলাপের একটা প্রশ্ন ছিল, আচ্ছা দাদা আমরা না হয় কাউয়্যার (কাক) মতো বলে সঙ্গী জুটে না, আপনার তো দেওয়ার মতো পরিচয় আছে, দেখার মতো চেহারা আছে, এতো চমৎকারভাবে বলেন, আপনে বিয়ে করছে না কেন? তিনি আকাশের দিকে একপলক উদাসভাবে তাকালেন, তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে।

জসিম, সবার জীবনে প্রেম হবে এমন কোন কথা নেই, আমার জীবনে হয়নি। এক্ষেত্রে যা প্রয়োজন তা হলো ধরেবেঁধে বিয়েটা করিয়ে দেওয়া। আমার কে আছে যে এই দায়িত্বটা পালন করবে! তার কথায় প্রচণ্ড একটা ধাক্কা খেলাম, সত্যিইতো মা-বাবার মৃত্যুর পর তার একমাত্র বোন স্বামী সংসার নিয়ে ব্যস্ত। এই পৃথিবীতে তার আপন বলতে কেউ নেই। তার মৃত্যু-সংবাদ শোনার পর সেই সংলাপটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে।

তাড়াবে না কেন! আমিও যে তার মতো পিতৃ-মাতৃহারা অনাথ। ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.